আয়নালের পকেটে মোটা অংকের বেশ কিছু টাকা। খুশিতে গদগদ করে পান চাবাচ্ছে । আঙুলের ফাঁকে জলন্ত সিগারেট। মাঝে মাঝে পান মুখেই সিগারেট ফুকছে সে। আহা তার মতো সুখী মানুষ বোধ হয় এই পৃথিবীতে আর একটাও নাই। রডের বদলে বাঁশ আর সিমেন্টের বদলে বালু দিয়ে তিনি ছোট ব্রিজটা তৈরি করেছেন। ব্রিজটা ছোট হলেও বাজেট কিন্ত কম নয়। ব্রিজের কাজে ইঞ্জিনিয়ার যেন বাধা না দেয় সে জন্য বেশ কিছু টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে, এছাড়া টেন্ডার পেতেও চলে গেছে অনেক গুলো টাকা । এখন বাদ বাকি টাকা দিয়ে রড সিমেন্ট ব্যবহার করে ব্রিজ করলে তার হাতে হারিকেন উঠে যাবে। আরে দূর ভিতরে কি আছে কেউ দেখে নাকি? আয়নালের কাছে এতগুলো টাকা দেখে মরিয়ম বেগমের চোখ কপালে উঠে গেছে।
– বউ, বুঝছ, বিল পাইছি আজকে, ব্যাংকে ভরসা নাই, নজরদারি বাইরা গেছে, তাই টাকা গুলো বাসায় নিয়ে আইলাম। স্টিলের আলমারিতে তুইলা রাখ। তোমার যদি খরচ করবার মনে চায়, খরচ কইরো, তয় আইজারা খরচ কইরোনা। বুঝোইত কষ্টের টাকা।
– আপনি না বলছিলেন বিল পাইলে আমারে একখান নেকলেস বানায় দিবেন?
– আরে অবশ্যই বানাইবা, আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ।
নতুন রাস্তা চালু করা হয়েছে সাথে ব্রিজটাও তবে এ রাস্তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করে না, ঐ রিকশা আর অটো পর্যন্তই শেষ। ভেতরের এলাকাটা বেশ সুন্দর, ঘুরতে যাওয়ার জন্য একেবারে পার্ফেক্ট। আজ হঠাৎ করে শিক্ষা সফরে আসা একটি স্কুল বাস ব্রিজটির উপর দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁশ দিয়ে তৈরি ব্রিজ কী আর বাসটিকে বহন করার ক্ষমতা রাখে ! আর তাই তো বাস সহ ব্রিজটি ধ্বসে পড়েছে । ঘটনার আকস্মিকতায় ভেতরে থাকা স্কুল ছাত্র ছাত্রীরা আর্তনাদ করে আকাশ বাতাস ভারি করে তুলছে। খুব বাজে ভাবে বাসটি খাদে পরে গেছে। ঘটনা স্থলেই চারজন বাচ্ছা মারা গেছে আর অধিকাংশ আহত।
সোস্যাল মিডিয়ার বৌদলতে দেশ ব্যাপি ঘটনাটি প্রচার হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।বাঁশ দিয়ে তৈরিকৃত ভাঙ্গা ব্রিজটির ছবি সবার টাইম লাইনে ভেসে উঠছে বারবার আর তার সাথে ভেসে উঠছে মৃত চারটি শিশুর মুখ আর স্বজনদের আহাজারি। সত্যি সত্যি দেশের জনগণ অনেকটাই ক্ষেপে গেছে, তার সাথে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন, এবং উপরের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে খোঁজা হচ্ছে ব্রিজ কন্ট্রাকটার কে কিন্তু কন্ট্রাকটর স্বাদের বউকে রেখেই পালিয়েছে। ঘটনা গুরুতর হওয়ায় কন্ট্রাকটরের বউকেই এ্যারেস্ট করা হয়েছে তার সাথে ক্রোক করা হয়েছে স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি এবং ঘরের সমস্ত টাকা পয়সা। এছাড়াও এ্যারেস্ট করা হয়েছে ব্রিজ দেখভাল করা সরকারি ইঞ্জিনিয়ার কেও। এই ঘটনায় দেশের জনগন এবং প্রশাসন এতটাই ক্ষুব্ধ যে কন্ট্রাকটরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার, কিন্তু কন্ট্রাকট র আয়নাল কোথায় পালিয়েছে কেউ বলতে পারেনা। এমনকি পুলিশও না।
বর্ডার এলাকায় আত্ম গোপন করেছে আয়নাল, পায়তারা করছে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার, কিন্তু দালাল মেনেজ করতে পারছে না। যে বাসায় আয়নাল উঠেছে সেটা দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের । তারাও চাচ্ছে না আয়নাল এখানে লুকিয়ে থাকুক। কে চায় উটকো ঝামেলা মাথায় নিতে। আর তাই তো আয়নালের মনে প্রচণ্ড ভয়। এখান থেকে অন্যত্র চলে গেলে ধরা পরার ভয় আছে। তবুও কিছু করার নাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বর্ডার পার হতে হবে। এখান থেকে বর্ডার সাত মাইল দক্ষিণে। তারপর জঙ্গল পার হয়ে নদী সাঁতরে বর্ডার পার হতে হবে কিন্তু এই সাত মাইল জনবসতি পূর্ণ এলাকা নছিমন বা ভটভটি ছাড়া যাওয়ার কোন পথ নেই।
আয়নাল বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, শীতকাল না হলেও মাপলার দিয়ে মাথা এবং গলা পেঁচিয়ে নিয়েছে তারপর মাথায় পড়েছে টুপি এবং চোখে সাদা চশমা। এখন সত্যি সত্যি আয়নাল কে চেনা যাচ্ছে না। কেউ বলবেনা এই হামারজাদার জন্য চারটি নিষ্পাপ শিশু মারা গেছে আর পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে অনেক শিশু। বিকট শব্দে ভটভটি এগিয়ে চলছে। দুই পাশে পাঁচজন করে দশজন মানুষ বসে আছে । তার ভেতর একজন আয়নাল। আয়নালের অপর পাশে বসা ছেলেটি বারবার আয়নালের দিকে তাকাচ্ছে, চোখে মুখে তার সন্দেহের আভা। ছেলেটির হাতে মোবাইল, একবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার আয়নালের দিকে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বলছে না। তারপর কাকে যেন ফোন করলো এবং বললো তোরা ইস্টানে আয় একটু দরকার আছে। ভটভটি থেকে আয়নাল নামতেই, খপ করে ছেলেটি আয়নালের শার্টের কলার ধরে ফেলেছে।
– শালা শুয়রের বাচ্ছা কন্ট্রাকটর, সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবিনা। বাঁশ দিয়ে ব্রিজ বানাইছত ? আর কতগুলা বাচ্চারে খুন করছত?
– কি হইছেরে দোস্ত ?
– এই সেই কন্ট্রাকটর, যে বাঁশ দিয়া ব্রিজ বানাইয়া কতগুলা বাচ্চারে মারছে। মাফলার খোল, মান্দার পো, টুপি খোল। মাপলার আর টুপি খুলতেই আয়নালকে আর কারো চিনতে বাকি রইলো না তারপর শুরু হলো ক্ষোভ আর প্রতিশোধের মহাৎসব। যে যেভাবে পারছে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। কিল, ঘুসি, লাঠি দিয়ে পেটানো আর কিছুই বাকি রইলো না। কে যেন থানায় ফোন করেছে, ফোন রিসিভ করতেই ওসির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
– জ্বি, জ্বি আপনারা ওকে আটকিয়ে রাখুন আমরা আসছি। ওসির সামনে দাঁড়ানো হাবিলদার বুঝতে পেরেছে কোন আসামিকে হয়তো জনগণ আটক করেছে আর তাই থানায় ফোন দিয়েছে। কিন্তু সে, কৌতূহলটা ধরে রাখতে পারলো না।
– স্যার, কে ফোন দিয়েছিল আর কাকেই বা আটক করেছে ?
– আটক করেছে সেই কুক্ষাত ব্রিজ কন্ট্রাকটর আয়নালকে, যে বাঁশ ব্যবহার করে ব্রিজ তৈরি করেছিল যার জন্য স্কুল বাস সহ ব্রিজটি ভেঙ্গে পরেছিল। যার দরুণ মারা গিয়েছিল চারটি শিশু আর আহত হয়েছিল অনেকেই। সরকার একে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
– জানি স্যার, টিভিতে এই হারামজাদার ছবি দেখেছিলাম। চলুন স্যার, তাড়াতাড়ি চলুন।
– আস্তে, এতো তাড়াতাড়ির কিছু নাই হাবিলদার। তুমি একটা কাজ করো আমাকে এক কাপ চা দিতে বল, ধীরে সুস্তে খাই তারপর যাই।
– কিন্তু স্যার!!
শোনা মিয়া কখনো কখনো জনগণের হাতে আইন তুলে দিতে হয়। কিছু কিছু মানুষের শাস্তি এতটাই জঘন্য হওয়া উচিৎ যে আদালতের রায় মৃত্যুদণ্ডতেও সেই শাস্তির প্রায়শ্চিত্ত হয় না। ক্ষুব্ধ জনগণের হাতে মার খাওয়া ক্ষত বিক্ষত লাশটা খুব বিশ্রী ভাবে মাটিতে পরে আছে তার সাথে পরে আছে মানুষের ঘৃণা ভরা একদলা থুতু। হাবিলদার লাশটা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা কর, পোস্ট মর্টেম।হওয়া প্রয়োজন।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক