ফাঁসির আগে রায়হানের শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে সে এক অদ্ভুত ইচ্ছার কথা জানায়। তার জীবনের গল্পটা সারা দেশের মানুষকে শুনাতে চায়। সাধারনত ফাঁসির আসামিরা তাদের প্রিয়জনকে দেখতে চায় নতুবা কিছু খেতে চায়। কিন্তু রায়হানের ইচ্ছা পুরোপুরি ভিন্ন। ব্যাপারটায় বিচারক বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলো। তার ইচ্ছা মঞ্জুর করা হলো। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সকল মিডিয়ার লোকদের একটা নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত করা হলো। গুনগুন আওয়াজে সেখানে এক চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
গলায় বেড়ি পড়িয়ে, হাত পায়ে শিকল জড়ানো অবস্থায় আসামিদের পোশাকে মঞ্চে আনা হলো রায়হানকে। পাঁচজন পুলিশ তাকে ঘিরে আছে। পালানোর পথ নেই। সবাই থেমে গেছে। থমথমে পরিবেশ তৈরী হলো।
রায়হান বলতে আরম্ভ করলো, “আমার কোনো ভাই বোন নেই। বাবা মা মারা যাওয়ার পর বিশাল বাড়িতে শুধুমাত্র আমি আর আমার স্ত্রী বসবাস করি। একটা কাজের মহিলা সারাদিন কাজ করে রাতে ফিরে যায়। জয়নাল আমার ছোটোবেলার বন্ধু। সুখে-দুঃখে একমাত্র তাকেই পাশে পেয়েছি। এক সময় আমি আর জয়নাল দুজনেই অন্ধকার জগতে পা রেখেছিলাম। রাতের পর রাত জুয়ার আড্ডায় কাটিয়েছি, মদ্যপান করেছি। আমার স্ত্রীর কারনে আমি ফিরলেও জয়নাল সেই জগৎ থেকে ফিরতে পারে নি।
আমার স্ত্রী শানু গর্ভবতী। ডাক্তার আল্ট্রাসনোর পর ‘আপনি মেয়ের বাবা হতে চলছেন’ বলায় আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। সারাক্ষনই আমার স্ত্রীকে সময় দিতে থাকি। আমি বাবা হবো ভাবতেই মন আনন্দে ভরে উঠে। প্রতিদিনের মতো এক বিকেলে কাজের মহিলা বাড়ির সমস্ত কাজ শেষে বাড়ি ফিরে গেলো। রাতে আমার স্ত্রীর হঠাৎ প্রসব ব্যাথা উঠে। আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। এলাকায় আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় দৌড়ে জয়নালের বাড়ি পৌঁছাই। গিয়ে শুনলাম জয়নাল বাড়িতে নেই। বুঝলাম জয়নাল জুয়ার আসরে। যতোই জুয়ার আসরে মত্ত থাকুক আমি ডাকলে আমার পাশে সে দাঁড়াবেই।
ঠিক যেই মুহূর্তে আমি জুয়ার আসরে পৌঁছালাম, জয়নালকে সেখানে দেখতে পেলাম না। সেই মুহূর্তে পিছন থেকে হুরমুড় করে অনেকগুলো পুলিশ এসে জুয়ার আসরের সবাইকে ধরে ফেললো। আমি তাদের হাতে পায়ে ধরলাম, কান্নাকাটি করে সব বললেও তাদের একটাই কথা, ‘সব পালানোর ধান্দা।’ আমাদের সবাইকে একটা নির্দিষ্ট সেলে রাখা হয়েছে। থানার ইন্সপেক্টর আমার পূর্ব শত্রু। যখন আমি জুয়া খেলতাম তখন একবার আমাদের ধরে ফেলেছিলো। ঘুষের টাকা অফার করায় তিনি রাজি হয়ে যান। আমরা গোপনে সেই টাকার ভিডিও করে ওনার বিরুদ্ধে উল্টা ঘুষ নেওয়ার অপরাধে মামলা করি। ওনাকে ছয় মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। সেই মামলার মূখ্য ভূমিকায় আমি থাকায় আমার উপর ওনার রাগ একটু বেশিই।
সারা রাত শানুর চিন্তায় পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। ভোরের দিকে কখন যে চোখ লেগে গেলো খেয়াল নেই। চোখ মেললাম পুলিশের মার খেয়ে। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই আরো জোরে মেরে বলতেছে, ‘তুই তোর বন্ধুকে মেরেছিস আর এখন বলছিস কি হয়েছে?’ আমি অকস্মাৎ কথাটা শুনে একটা বড় সড় ধাক্কা খেলাম। জয়নাল মারা গেছে! ভাবতেই মাথাটা ঘুরে গেলো। অন্যদিকে আমার স্ত্রীর কোনো খবর নেই। বাচ্চার কি খবর? কি হলো? বাচ্চা ও শানু এখন কেমন আছে? কোনো খবর পাচ্ছিনা। জীবন আসলে কি তা আমি সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছি। জয়নালের লাশটা দেখে বুকটা কেমন ধুঁক ধুঁক করে উঠলো। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কোথাও কোথাও চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের হয়ে আছে। কি বিভৎস ভাবে একটা মানুষকে মারা হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্যমতে মদ্যপ অবস্থায় জুয়ার টাকা নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে আমরা কয়েকজন মিলে নাকি জয়নালকে হত্যা করেছি। এই অপরাধে আদালতে মামলা উঠে। আমি সহ কয়েকজন দোষী সাব্যস্ত হই। আমি মূল আসামী। সাক্ষীগুলো আদালতে এমন ভাবে বক্তব্য পেশ করেছে যেনো সবার চোখের সামনে জয়নালকে হত্যার দৃশ্য ভেসে উঠেছে। জেলের মধ্যে হত্যার অপরাধে আমার ফাঁসির আদেশ হয়। বাকিদের যাবৎজীবন কারাদন্ড। অথচ জয়নালের মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। আর কিছুই করার ছিলোনা আমার। ইতোমধ্যে এই খবর বিভিন্ন টেলিভিশনে, পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। আমার কাজের মহিলাটা দেয়ালে টানানো পত্রিকায় জেলখানার শিকলে ধরে দাঁড়ানো অবস্থায় তুলা একটা ছবি দেখে আমার সাথে দেখা করতে আসে। শুনতে পারি প্রসবে সমস্যা হয়ে আমার বাচ্চা ও বাচ্চার মা দুজনেই সেই রাতে মারা যায়।
কথাটা শুনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নি। সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যাই। জেলের মধ্যেই আমি জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি। আমার কান্না দেখে বাকি জেল সদস্যরা অবাক হয়ে পড়ে। যেদিন আমার ফাঁসির আদেশ হয় সেদিন এমন করিনি অথচ আজ একটা মহিলার কথায় এমন করছি। আমি কাঁদছি আর ভাবছি আমার কেনো এমন হলো? ভাবতে ভাবতেই আমার দুবছর আগের কথা মনে পড়লো। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় একটু বেশি ই ভালোবাসা পেতাম। মোটামুটি একরোখা ধরনের ছেলে ছিলাম। যা চাইতাম তা ই বাবা মা কে দিতে বাধ্য করতাম। এক পর্যায়ে অন্ধকার জগতে পা রাখলাম। আচার আচরনে মা-বাবা দুজনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। আমিও নেশার টাকার জন্য অত্যাচার করতে থাকি।
এক রাতে জুয়ায় হেরে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরলে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। আমি রাগে বাবার উপর হাত তুলি। বাবাকে একটা লাথি দিয়ে ফেলি। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় এতো জোরে লাথি দেই যে বাবাকে আর বাঁচাতে পারি নি। বাবার শোকে অল্পদিনেই মা ও পরপারে পারি জমান। আমি সমস্ত পাপ ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু অদৃশ্যের একটা নিরব প্রতিশোধ আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। যেই আমি বাবা মায়ের কষ্ট বুঝতে পারি নি সেই আমি বাবার স্বাদ পাওয়ার পূর্বেই সব হারালাম। অদৃশ্যের এই প্রতিশোধ কতোই না নির্মম।
আমি ভেবেছিলাম ফাঁসির রায় থেকে বাঁচতে হাইকোর্টে নতুন করে আপিল করবো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম আমার পূর্বের কর্মই এখন কর্মফল হিসেবে ফিরে এসেছে। সুতরাং আমার বিদায় ই উত্তম। আমার চলে যাওয়া আপনাদের কাছে একটা শিক্ষা হিসেবে রেখে যেতে চাই। আর যাই হোক, বাবা মাকে কষ্ট দিলে সেই কষ্ট অন্যকোনো এক রূপ নিয়ে নিজের জীবনে ফিরে আসবেই।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক