প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত
আজ নিবিড়ের বিয়ে।আমার প্রথম প্রেমিক।যে কোনো এক কালে ছিল আমার বয়ঃসন্ধি বেলার প্রথম পুরুষ।কি অদ্ভুত ব্যাপার, প্রায় সাড়ে তিন বছরের একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তার সাথে অথচ সেথা কোনো ভালোবাসা ছিলো না।একজন প্রেমিকা হিসেবে সে হয়তো আমার চেয়ে ভালো কাউকেই পেতো না।আমি এই মানুষটার প্রেমে কত পাগলই না ছিলাম।সে আমায় উঠতে বসলে উঠতাম, বসতে বললে তাও বসতাম।কিন্ত আফসোস তাকে আমি আটকে রাখতে পারিনি।
ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে অন্ধকারে এক কোণায় বসে চোখের জল ফেলছিলাম।সন্ধ্যের দিকে বান্ধবী অহনার মেসেজের শব্দে ফোনটা হাতে নিলাম।কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। আমি জানি এ ছবিগুলো কার।সাহস করে সেগুলো দেখতে লাগলাম।হ্যাঁ, এ ছবিগুলো নিবিড়ের বিয়ের ছবি।কত সুন্দর হেসে হেসে পাশে বসে থাকা মেয়েটির সাথে ছবি তুলেছে।তবে মানতে হবে, দুজনকেই বেশ মানিয়েছে। নিবিড় তখন ভার্সিটি পড়ুয়া আর আমি সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছি।আমাদের পাড়াতেই থাকতো।রাস্তায় আসা-যাওয়ার সময় মাঝে মধ্যে চোখাচোখি হতো।ব্যস, কিভাবে কিভাবে যেন প্রেম হয়ে গেলো আমাদের।
সম্পর্কটা বেশ ভালোই যাচ্ছিলো।ঝগড়া খুনসুটি সবমিলিয়ে ঠিকঠাকই ছিল।কিন্ত সমস্যা বাঁধলো নিবিড়ের এক বান্ধবীর অনুপ্রবেশে।তার প্রতিটা ফেইসবুক পোস্টে থাকত দু’জনের কমেন্ট ছোড়াছুঁড়ি।ধীরেধীরে বুঝতে পারি নিবিড় অনলাইনে থেকেও আমার মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না। ফোনে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দেয়।নিবিড়কে এ বিষয়ে কয়েকবার বলেও “ওতো আমার জাস্ট ফ্রেন্ড” বলে উড়িয়ে দিতো। আমিও কিছু বলিনি আর। এভাবে অবহেলার আঘাত সইতে সইতে আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।তাই রাগ ঝাড়তে নিবিড়ের তথাকথিত বান্ধবীকে মেসেজে ক’টা কথা শুনিয়ে বসি।এদিকে নিবিড়ের কাছে ততোদিনে আমার গুরত্ব নেই বললেই চলে।সে নীরা মানে তার বান্ধবীকেই বেশি গুরত্ব দিতো।সেদিন নিবিড় আমায় ফোন দিয়ে বেশ বাজে কথা শুনিয়েছিলো।
– তুমি নাকি নীরাকে কিসব বলেছো অধরা?
– হ্যাঁ, বেশ করেছি।তুমি কি একটু বুঝতে পারছো না নিবিড় আমাদের সম্পর্কটা তৃতীয়পক্ষের জন্য ভেঙ্গে যাচ্ছে?
– তোমার সাহস কিভাবে হয় নীরাকে কথা শোনানোর?
– ওহ আচ্ছা, এখন তোমার কাছে নীরা ই মূখ্য তাই না নিবিড়?
– শুনো অধরা। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক রাখা পসিবল নয়।
আজকের পর থেকে আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ রেখো না।ভালো থেকো। এইটুকু বলেই নিবিড় ফোন কেটে দিলো।সেদিনের পর থেকে নিবিড় আমায় তার প্রতিটা একাউন্ট এমনি নাম্বার অব্ধি ব্লকলিস্টে ঢুকিয়ে দেয়।কত ক্ষমা চেয়ে মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছিলাম সে আর আমার কাছে ফিরেনি।
দ্বিতীয় প্রেমটা ঠিক প্রেম ছিল না।মোটামুটি পরিচিত। ভালো লাগতো তাকে।তবে কখনো আমি নিহানকে সুযোগ দেই নি।নিহানের সাথে পরিচয় এই ভার্চুয়াল থেকেই।সে আমার প্রতিটা কথা জানতো।বন্ধু হিসেবে সেই দুর্দিনগুলোয় পাশে ছিল সে।এক পর্যায়ে আলাপ জমতে জমতে বুঝতে পারি নিহান আমায় পছন্দ করে এবং আমিও।কিন্ত কেউ কাউকে বলিনি।তার প্রধান কারণ, আমরা দুটি মানুষই আগে একবার ভেঙ্গেছি।তবে দু’জনই মনে মনে নিজেদের আগে শক্ত করে গড়ে তুলে প্রেম না করে সরাসরি সংসার বাধার ইচ্ছে করেছিলাম।দীর্ঘ সময় নিজেদের আবেগ অনুভূতিকে কন্ট্রোল করে আমরা নিজেদের স্বপ্নগুলো পূরণ করেছি।
আজ আমি একটা কোম্পানিতে ভালো পজিশনের জব করি অন্যদিকে নিহান একজন আইনজীবী। আমাদের যেদিন বহু দিন পর প্রথম সাক্ষাত হয়েছিলো, নিহান আমায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো।আমি সেদিন কোনো জবাব দিতে পারিনি কিছু।শুধু বলেছিলাম, ” বাসায় জানিও আগে।তাদের উপর আমার সিদ্ধান্ত।” বিয়ের পরের দিনগুলো অসাধারণ যাচ্ছিলো।আমরা স্বামী-স্ত্রী হওয়ার আগে দু’জনে বেশ ভালো বন্ধু।প্রফেশনাল লাইফ ও সংসার দুটোই দু’জনের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভালোই যাচ্ছে।দিনশেষে শত ব্যস্ততার পর দু’জন ই নীড়ে ফিরে সংসার করি।সে ডিম ভাজলে আমি ভাত রান্না করি।এভাবেই মিলেমিশে যাচ্ছে আমাদের দিনগুলি।
আজ অফিস শেষে বিকেলে নিহানের সাথে নদীর পাড়ে যাওয়ার কথা ছিল।অনেকদিন কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও শান্তিতে বসি না।তাই নিহানের অপেক্ষা না করেই চললাম তার অফিসে। নিহানের সামনে দুটো চেয়ারে এক দম্পতি বসা।ডিভোর্স পেপারে সাক্ষর পর্ব সেড়ে যেই সে দম্পতির মুখোমুখি হলাম ওরা আমায় দেখে খানিক চমকে উঠলো। নিবিড় ও তার সেই তথাকথিত বান্ধবী।যাদের কোনো একসময় বিয়ে পর্যন্ত হয়েছিলো।অথচ আজ তাদের ডিভোর্স?
– ওহ, অধরা তুমি আসছো? সরি তোমাকে আমার পিক-আপ করার কথা ছিল।একটু ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম গো।
– ইট’স ওকে নিহান।
প্রাক্তন নিবিড় এবার আমার দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।যেন তার দু চোখ আজ আমায় বলছে, ক্ষমা করো আমায় অধরা ” সূর্যাস্তের আভা যেন নদীর জলে মিশে সোনালী রংয়ের মতন চারিদিক ছড়িয়ে পড়ছে।নিহানের বুকে মাথা রেখে বসে আছি।এ যেন অন্যরকম তৃপ্তি।
– নিহান?
– হু
– আচ্ছা একটু আগে যাদের বিচ্ছেদ হলো ওদের আলাদা হবার কারণ কি ছিল?
– আর বলো না।পরকিয়া আজকাল একটা ব্যাধিতে রূপান্তর হয়েছে আমাদের সমাজে।তাদের দু’জনই সংসার জীবনে বেশ অসুখী।স্ত্রীর একাধিক সম্পর্ক।স্বামী বারবার সুযোগ দিয়েও তাকে ঠিক পথে ফেরাতে পারেনি।
আমি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলাম, ঈশ্বরের চাওয়া বোঝা মুশকিল।তা নাহলে একজন ছেড়ে গেলে অন্যজনকে পাঠিয়ে কিভাবে ভাঙা মনের জোড়া লাগায়? আসলে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মাঝে অনেক ভুলক্রটি থাকে।সেসব জেনেই মাঝে মধ্যে ঈশ্বর অনেক চাওয়াই অপূর্ণ করে রাখেন।জোর করে পাওয়া কোনোকিছুই বেশি টিকে না।তাই তো অন্যের কিছু কেড়ে নিয়ে কেউ কখনো সন্তুষ্ট ও সুখী হতে পারেনা।”
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত