অহংকারের পতন

অহংকারের পতন
“ছিঃ ছিঃ ছিহ শেষ মেশ আরাফের লগে এক ঘরে ধরা পড়লি? কলঙ্কীনি!” কথা বলেই লুনার গালে স্বজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল লুনার চাচি।লুনা কাদঁছে, লজ্জায় আর কষ্টে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে।হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে একটি বদ্ধ ঘরে।আরাফকেও ওর সাথে বেধে রাখা হয়েছে।আরাফ লজ্জায় নত হয়ে আছে।
লুনার চাচি জবেদা বেগম হুংকার দিয়ে উঠে বলল, “গোলামের পুত তোরে আমি আপন ছেলের মত দেখতাম আর তুই আমার মাইয়ার লগে এই কাম করলি?” আরাফ কিছু বলতে পারছে না।আরাফের খুব কষ্ট হচ্ছে নিজের চোখের সামনে প্রিয়তমার অপমান দেখে। আরাফ এবং লুনা একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকে।আরাফ লুনার চেয়ে ৪ বছরের বড়।আরাফ লুনা কে পড়া দেখিয়ে দিতো।সেই সুবাধে যাওয়া আসা ভাব বিনিময় অবশেষে মন বিনিময় হয় ওদের।তারপর কঠিন প্রনয়।এই প্রনয় দীর্ঘ ৬ বছরের। আজ বাদে কাল আরাফ দুবাই চলে যাবে।তাই আজ লুনার সাথে দেখার করার জন্য একটা নির্জন জায়গায় ডেকেছে।যেখানে মানুষ একটু কম আসে।কারণ ওদের এক সাথে দেখলে কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটে যাবে।সেরকম নির্জন কোন জায়গা নেই আশে পাশে।
শুধু বিলের পাশে একটা ধান ক্ষেতে সেচ দেওয়ার মেশিনের ঘর আছে।ওরা দুজন মনস্থির করল ওখানে দেখা করবে।সেই কথা অনুযায়ী লুনা আগেই চলে যায় মেশিন ঘরে তারপর আরাফ আসে।লুনা একটা কাঠের উপর বসে আছে।পড়নে থ্রি পিস আর লম্বা চুলে বেনী করা।চোখে কাজল মেখেছে ঠোট রক্ত জবায় রাঙ্গা।আরাফ আসার পর লুনা আরাফের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।নয়ন ভরা জল।আরাফ চোখের পানি মুছে কপালে চুমু খেলো।লুনা বলল, “তুমি আমারে রাইখা কই যাইবা আরাফ ভাই?” আরাফ মুচকী হেসে বলল, “আমি তোরে রাইখা কোথাও যাবো না লক্ষি।এইতো কিছুদিন পরেই চলে আসব।তারপর বাড়িতে জানিয়ে তোরে ধুমধাম করে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবো।” লুনা আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “তাহলে দুবাই যাওনের কি দরকার? তুমি আজকেই জানাও তোমার বাড়িতে।”
আরাফ বলল, “তোরে যে ঘরে তুলব সেই ঘর দেওন লাগব না? ঘর দেওয়ার টাকা পামু কই? কইছিলাম আমন ধান ঘরে তুলার পর তোরে ঘরে নিমু কিন্তু আমন ধান খাইলো চোরে।তাই এইবার ঠিক করছি দুবাই যাইয়া কিছু টাকা জমাইয়া দেশে ফিরা তোরে বিয়া করমু।” লুনা বলল, “সত্য কইতাছো?” আরাফ বলল, “সত্যি রে পাগলী।” দুজনেই হেসে দিলো।বিলের পাশের পুকুর থেকে গোসল করে ঘরে ফিরছিলো সুলেমান মিয়া।মেশিন ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসিফিসানী শব্দ শোনে ঘরের বেড়ায় কান রাখলো।ভালো করে শোনল।টিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে লুনা আর আরাফ কে দেখে ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলো।আরাফ এবং লুনা ভয়ে আতকে উঠলো।সুলেমান মিয়া চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো, “কে কোথায় আছো? দেইখা যাও খোরশেদ মন্ডলের মাইয়া আর আমজাদ শেখের পোলার কারবার।” লুনা ভয়ের চোটে কান্নাই করে দিলো।পালানোর কোন রাস্তা নেই।
কিছু সময়ের মাঝেই লোক জড়ো হতে লাগল।গ্রামের পাতি নেতা হাসমত আলী ঘরে ঢুকে দুজনের হাত পা বেধে বন্ধি করে রাখল।চেয়ারম্যান কে খবর দিয়েছে উনি আসার পর বিচার করবে।সারা গ্রামে হাক ডাক পড়ে গেছে।অনেকেই মজা নিচ্ছে আবার অনেকে ছিঃ ছিঃ করছে।একটু ঘটনা কে আরো একটু লম্বা করে রং চং মাখিয়ে প্রচার করছে। লুনা বাহিরে গ্যাঞ্জামের শব্দ স্পষ্ট শোনতে পাচ্ছে।মানুষ গুলো জানালা দিয়ে উঁকি ঝুকি মেরে ওদের এমন ভাবে দেখছে যেনো ওরা চিড়িয়া খানার জীব জন্তু। “দেখছো কি বেশ্যা মাইয়া।এই মাইয়ারে পেটে ধরছিলো নসিমন বুবু।ছিঃ ছিইই ছ্যাহ।আমার ঘরে এমন মাইয়া হইলে কাইট্টা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিতাম।” কথাটি বলেই পানের পিক ফেলল মতির মা।এরকম আরো নানা ধরনের কথা বলা বলি করছে মানুষ।লুনার মা নসিমন বেগম বার বার জ্ঞান হাড়াচ্ছে।লজ্জায় ঘৃনায় মরে যাচ্ছে যেনো।এক প্রকার বাধ্য হয়ে লুনার চাচি জবেদা বেগম এখানে এসেছে।
জবেদা বেগম বলল, “এতোই যদি তোর আরাফ রে পছন্দ ছিলো আমারে কইতি।আমি তোর বাবা রে রাজী করাইয়া বিয়া করাইয়া দিতাম।তুই এই কাম করলি ক্যা? এখন লোকের মুখ বন্ধ করবি কি দিয়া?” লুনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বিশ্বাস করো চাচী। আমি আরাফ ভাইয়ার লগে শুধু কয়ডা কথা কইতেই আসছিলাম।কিন্তু ঐ সুলেমান চাচা কিছু না দেইখাই বাহির থাইকা দরজা বন্ধ করে দিলো।” জবেদা বেগম বলল, “ওরে মুখ পুড়ি কপাল পোড়া তুই এই কথা কারে বিশ্বাস করাবি? কেউ বিশ্বাস করবো তোর কথা? তুই জানোস না ঐ সুলেমান তোর বাপের উপরে বদলা নিওনের লাইগা উৎ পাইতা রইছে। এখন তোর বাপে সমাজের কাছে মুখ দেখাবো কেমনে?” লুনা কাঁদতে লাগল।চোখের পানিতে যেনো সাগড় বয়ে যায়।এত এত মানুষ এর সামনে লজ্জা আর অপমানে মাটির নীচে মিশে যেতে মন চাইছে ওর।
মেম্বার এলো…যথারীতি শালিস বসল কাচারী ঘরের বারান্ধায়।চারপাশে মানুষ এর উপচে পড়া ভীড়।লুনার বাবা খোরশেদ মন্ডল মাথা নীচু করে বসে আছে।তার পাশেই বসে আছে আমজাদ শেখ।আমজাদ শেখের মাঝে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা যাচ্ছে না।গ্রামের মেম্বার নয়ন শিকদার আয়েশ করে বসে পানের বোটা থেকে চুন জিহবায় লাগিয়ে গলা খাকারী দিয়ে বলল, “সুলেমান মিয়া তুমি তোমার বক্তব্য পেশ করো।” সুলেমান মিয়া যেনো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো।খুশি হয়ে বলা শুরু করলো, “মেম্বার সাব আমি যখন গোসল কইরা এইখান দিয়া যাইতেছিলাম তখন ফুসুরফাসুর আলাপ শোনতে পাই।আমি ভাবছি চোর টোর নাকি মেশিন চুরি করতে আইছে।পরে বেড়ার ছোট্ট ছিদ্র দিয়া চাইয়া দেহি খোরশেদ মন্ডলের মাইয়া আর আমজাদের শেখের পোলা দুইজন মিলা ছিঃ ছিঃ শরমের কথা আর না কই।”
খোরশেদ মন্ডল রেগে গিয়ে উঠে দাড়ালো।হুংকার দিয়ে আঙ্গুল উঁচু করে বলল, “সুলেমাইন্না মুখ সামলাইয়া কথা কইবি। আমার মাইয়ার নামে আর একটা মিছা কথা কইলে এই ভরা মজলিসে তোর লাশ পইড়া যাইবো।” সুলেমান মিয়া একটু ভয় পেলেও পাশে মেম্বার আছে সেই জোরে বলল, “গলা বাইরাইও না।আমি যা দেখছি তাই কইতাছি।তোমার মাইয়ার নামে মিছা কথা কইয়া আমার কি লাভ?” খোরশেদ মিয়া বলল, “লাভ আছে তোমার দুঃশ্চরিত্র পোলারে আমি মদ আর মাইয়া লোক সহ হাতে নাতে ধরছিলাম।সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওনের লাইগাই এই নাটক সাজাইছো বুঝি না আমি?” সুলেমান মিয়া আর কোন কথা বলতে পারল না তখন মেম্বার নয়ন শিকদার বলল, “থামো তোমরা।তোমার মাইয়া এতো ভালোও না।আমি আরো কয়েকদিন দেখছি এই দুইডারে এক লগে।” আমজাদ শেখ বলল, “মেম্বার সাব ভালো কইরা বিচার কইরো।এইখানে কোন ব্যাক্তিগত আক্রোশ খাটাইওনা।”
নয়ন শিকদার বলল, “ন্যায় বিচারই করবো।কিন্তু কথা হইলো পোলা মাইয়া এক ঘরের ভিতরে আছিলো আর সাক্ষি হইলো সুলেমান মিয়া।এমন জলজ্যান্ত সাক্ষি চোখের সামনে রাইখা তোমার মুখের কথা তো বিশ্বাস করন যাইবো না।” খোরশেদ মন্ডলের আর কিছু বলার মুখ রইলো না।নয়ন শিকদার গলা উঁচু করে অহংকার করে বলল, “মাইয়া বানাও আমার মাইয়ার মত।আমার মাইয়া কোন দিন কোন পোলার লগে কথা কয় না।ঘর থাইকা একদম ই বাইরে বের হয় না।আমার মাইয়ার মত মাইয়া জন্ম দিয়া দেখাও মিয়া।পরে আইসো মাইয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে।পারবা মিয়া আমার মাইয়ার মত পোলা মাইয়া বানাইতে?”
খোরশেদ মন্ডলের নাক কাটা গেলো ভরা মজলিসে।কেউ হাসাহাসি করছে আবার কেউ কানাকানি করছে।যেনো একটা সার্কাশ জুরে বসেছে ওরা।বখাটেরা দাতঁ বের করে হেসে একে অপরের কাছে বলা বলি করছে, “আমাগো খোরশেদ চাচা এমন একটা জিনিস ঘরে রাখছিলো আমরা জানলাম ই না।” বিশ্রি ভাবে হেসে উঠলো অপরজন বলল, “আরে ঐডা তো শুধু আরাফরে সার্ভিস দিওনের লাইগা।” আবার হাসলো ওরা। আমজাদ শেখ নয়ন শিকদার কে বলল, “মাইয়া লইয়া এত অহংকারি ভালা না মেম্বার।মনে রাইখো এই অহংকারের আবার পতন না হয়।” নয়ন শিকদার সেসবে পাত্তা না দিয়ে বিচার শুরু করলো।আরাফ প্রস্তাব দিলো লুনা কে বিয়ে করবে এবং এখনি।সুলেমান মিয়া একটু অসন্তুষ্ট হলো।ভেবেছিল আরাফ বিয়ে করবে না।তাতে করে মেয়েটির আর কোথাও বিয়ে হবে না আর সারাজীবন এই কলঙ্ক এর বোঝা বইতে হবে ওদের কে।কিন্তু আরাফ নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিলো।এই বিয়ে না মেনেও উপায় নেই।দিতেই হবে কারণ যেহেতু ছেলে মেয়ে রাজী। অবশেষে ওদের বিয়ে হয়ে গেলো।
আজ বিয়ের তিন বছর পড়ল।লুনার কোলে ১৮ মাসের একটি বাচ্চা।সবাই মেনে নিয়েছে এতোদিনে।লুনা এবং আরাফ খুবই সুখি।এত দিনে লুনার উপর আরোপ করা সব কলঙ্ক মুছে গেছে।কাল আরাফ দুবাই চলে যাবে সাথে বউ বাচ্চা দুজন কে নিয়ে যাবে।লুনা আরাফের বুকের মাঝে মাথা রেখে বলল, “তুমি আমার সাত জন্মের শত সাধনার উপহার।তুমি না থাকলে এই লুনা অপমান ঘৃনায় আত্মহত্যা করতো।” আরাফ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “যে আমার জন্য তোমার কলঙ্ক লেগেছিলো আল্লাহ সেই আমাকে দিয়েই তোমার কলঙ্ক মুছে দিয়েছেন।আল্লাহ সত্যি মহান।” এই সময় আরাফের বন্ধু সৈকত এসে দরজায় টোকা দিল।আরাফ দরজা খোলে দিলে সৈকত জানালো, “বন্ধু খবর শোনছস?
আরাফ বলল, “কি খবর?” সৈকত বলল, “মেম্বার নয়ন শিকদারের মাইয়া এক পোলার লগে পাশের আম বাগানে কু-কাজ করতে যাইয়া ধরা খাইছে।সেইডা নিয়া শালিস বইছে।জলদি চল।। তিন বছর আগে যেই কাচারী ঘরে লুনা আর আরাফের বিচার হয়েছিলো সেখানে বিচার হচ্ছে মেম্বারের মেয়ে টুশি আর সুলেমান মিয়ার ছেলে জয়নালের।আম বাগান থেকে ওদের কে হাতে নাতে ধরেছে এলাকার কয়েকজন খোরশেদ মন্ডল আর আমজাদ শেখ বিচারে বসেছে।সুলেমান মিয়া আর মেম্বারের মুখ নীচু হয়ে আছে।বিচারের এক পর্যায়ে আমজাদ শেখ টুশির সাথে জয়নালের বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ে করবে না জানায় জয়নাল।এমতাবস্থায় গ্রামের গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ জয়নালের উপর জরিমানা দাবী করে।জয়নাল জরিমানা দিতে প্রস্তুত।
খোরশেদ মন্ডল মেয়ের বাবা তাই এই অপমান কেমন তা বোঝতে পারছে খুব ভালো করেই। তাই এক প্রকার জোর করে জয়নাল কে মেরে রাজি করায়।ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। খোরশেদ মন্ডল নয়ন শিকদারের অশ্রুশিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে কাধে হাত দিয়ে বলল, “মেম্বার সাব অন্যের বিপদ দেইখা হাসতে নাই।আল্লাহ নারাজ হয়।আর অহংকার করতে নাই।অহংকারের পতন হয়।” পরদিন সকাল বেলা লুনা এবং আরাফ দুবাই চলে গেলো।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত