উঠানের ধানগুলা আরেকবার পা দিয়া আয় তো শায়লা।
-আইচ্ছা আম্মা যাইতাছি আমি এহনি। গ্রামের সবচেয়ে বিত্তশালী মালেক মন্ডলের বাড়িতে কাজ করে শায়লা।শায়লার স্বামী মারা যায় গত পাঁচ বছর আগে টায়ফয়েড জ্বরে।মন্ডল বাড়িতেই তার স্বামী ১২মাসের কাজ করতো।শায়লার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে মন্ডল বাড়িতে এখন শায়লাই সব কাজ করে। কিছুক্ষণ আগে ধানে পা দিতে বলে শায়লাকে মালেক মন্ডলের বউ।কথাটা শেষ না হতেই শায়লা মাছ কাটা রেখে দৌঁড়ে গেলো ধান পা দিতে।
মালেক মন্ডলের তিন মেয়ে এক ছেলে।তিন মেয়েকেই শহরে বিয়ে দিয়েছেন।ছেলে সবার ছোট।গ্রামের বিত্তবান হওয়ায় বাবার দাপটে ঘুড়ে বেড়ানো তার নিত্যদিনের কাজ।তার সাথে উশৃংখলপনা নিয়ে স্কুলের মেয়েদের পিছনে লাগাটাও তার চরিত্রের বড় স্বভাব। শায়লার বারো বছরের একটা মেয়েসহ একার সংসারটা টেনেটুনেই কেটে যায়।মালেক মন্ডলের বউ অবশ্য বলেছিলো শায়লা কে আবার বিয়ের কথা কিন্তু শায়লা বলেছিলো,গরীব মানুষের জীবনতো সারাজীবন এমন পরের ঘরে কাম কইরাই খাওন লাগবো। তারচেয়ে মাইয়াডারে নিয়াই না হয় বাকি জীবনডা কাটামু। শায়লা ধান পা দিয়ে এসে আবার বাকি মাছগুলো কাটতে বসে।আজকে মন্ডলের তিন মেয়ে আসবে।নতুন ধান কাটার পর তা ঘরে তুলে মালেক মন্ডল মেয়ে মেয়ের-জামাইসহ দাওয়াত করে পিঠা চিরার অনুষ্ঠান করে। সকাল থেকে শায়লা সেইসব কাজ নিয়েই আজ ব্যস্ত ছিলো।এখন মাছ কাটতে কাটতে দূর থেকে তার মেয়ে শানুর ডাক শুনতে পেলো।
-মা ওমা কইগো তুমি?
–ইসকুল ছুটি হইছে মা তোর?তা বাড়িত না গিয়া এহানে আইলি ক্যা চাবি লইতে?
-ইসকুল থেইকা ফিরা তোমারে না দেখলে যে আমার ভাল্লাগেনা মা তাইতো এইহানে ছুইটা আহি। ওমা মা পাড়ার পোলাপাইনরা কইলো যে আইজকা নাকি মন্ডলগোরে মাইয়ারা আইবো?তাইলেতো অনেক ভালো ভালো খাওন রান্ধিবা তাইনা মা?
–আস্তে ক,কেউ হুনলে কি কইবো?তুই এহন বাড়িত যা মা, এই ল গিট্রু থাইকা চাবিডা খুইলা নিয়া যা আমার হাতে মাছের ছাই।
-ও মা কও ভালো খাওন নিয়া যাবা না?
–হ, আম্মায় দিলে আমি নিয়া যামুনি।
-আমার সোনা মা।
শায়লা মাছ কাটা শেষ করে রান্নাঘরে বসে মসলা বাটতে লাগলো।এদিকে মন্ডলের বউ আবার হাক ডাক শুরু করলেন, শায়লা এই শায়লা কইরে তুই?এতক্ষণ লাগে মসলা বাটতে?ধানগুলা উঠা রোদতো চইলা গেছে আবার মাইয়ারা আসা শুরু করলে ব্যাগগুলা আনতে কে যাইবো হ্যা? শায়লা কোনোমতে মসলা বাটাগুলো শেষ করে আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছতে মুছতে ছুটে গেলো উঠোনের ধানগুলো ঘরে তুলতে। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে গেলো।মন্ডল বাড়ির মেয়েগুলো একে একে আসা শুরু করলো।শায়লা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ভাড়ী ভাড়ী ব্যাগগুলো বাড়ির ভেতর আনছিলো।
দুপুরের খাবার শেষে শায়লা একটুর জন্য ছুটি পেলো বাড়িতে ফেরার।বাড়ি ফিরেই দেখলো শানু ঘরে বসে পড়তেছে।খুব ভালো ছাত্রী নয় কি সে।ঘরে ঢুকেই আঁচলের নিচ থেকে খাবারের প্লেট বের করে শানুর মুখের সামনে ধরলো।শানু মূহুর্তেই বইটা বন্ধ করে বললো,মা পোলা আর গোস্ত ভাত? শায়লা মেয়ের খুশি মুখটা দেখে যেন সারাদিনের কষ্ট ভূলে বললো,হ মা পোলা গোস্তভাত।তুই না কবের থেইকা খাইবার চাইছিলি? শানু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, হ মা আমার খুব ইচ্ছা করছিলো খাইবার।ওমা তুমি খাইছো? শায়লার চোখজোড়া মূহুর্তেই ভিজে উঠলো।নিজেকে সামলে মিথ্যে উত্তর দিলো, হ মা খাইছি আমি এগুলা মন্ডলের বউ তোর জন্য দিছে।
ছোট্ট মেয়েটি কি যেন বুঝে মুখটা ভার করে বললো,তুমি আজকেও মিথ্যা কইতাছো মা?আমি জানি তুমি খাওনাই।মন্ডলের বউ কবে আমার খাওন দিলো তোমায় কও?একজন মাইনষের খাওন থেইকা আমরা দুইজন খায় ওরা যদি ভালো মানুষ হইতো তাইলেতো আমগোর পেটের জ্বালা বুঝতো।ওগোর অনেক ট্যাহা আছে কিন্তু মনতো নাইগো মা।
শায়লা দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে শানু কে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিলো।চোখ মুছতে মুছতে মেয়ের জোড়াজুড়িতে কয়েক লোকমা ভাত নিজেও মুখে দিলো।
বিকালে পিঠা বানানোর পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই অনেক রাত হয়ে গেলো।শায়লা রাস্তা দিয়ে জোড়ে জোড়ে পা চালাতে থাকলো আর শানুর কথা চিন্তা করতে লাগলো।সে অবশ্য বার বার বলেছিলো মন্ডলের বউ কে, আম্মা মাইয়াডা একলা ঘরে আমি একটু যায়গা? কিন্তু মন্ডলের বউ ধমক দিয়ে শায়লা কে এতো রাত অবদি আটকিয়ে রাখে।শায়লার এখন মনে শুধু একটাই চিন্তা ভালোই ভালোই বাড়ি ফিরতে পারলে তার শান্তি। শানুর জন্য কিছু পিঠা নিয়ে শায়লা পিঠাগুলো আঁচলের নিচ থেকে দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলো,আমার মাইয়াডাতো একটু সন্ধ্যা হলেই আমারে নিবার আসে তাইলে আইজকা এতো রাইত হইলো তাও আইলোনা ক্যা?আমার মাইয়াডার কোনো বিপদ আপদ হইলোনাতো?
এসব ভাবতে ভাবতেই শায়লার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।সে যত দ্রুত সম্ভব পা চালাতে থাকে।চল্লিশ মিনিটের রাস্তা সে পঁচিশ মিনিটে শেষ করে।কিন্তু বাড়ির পিছনে যেতেই শায়লার কানে আসে শানুর বুকফাটা আর্তনাদ। শায়লা দরজাটা খোলা দেখেই ভিতরে ঢুকে দেখে শানুর রক্তাক্ত শরীর মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে,আর শানু চিৎকার করছে মা মা বলে।এই করুন দৃশ্য দেখে শায়লা হাত থেকে পিঠার প্লেট টা ফেলে চিৎকার করে ছুটে যায় মেয়ের কাছে।শায়লার চেচামেচিতে ছুটে আসে পাড়া-প্রতিবেশীরা।সবাই ধরাধরি করে শানু কে নিয়ে যায় গ্রামের স্থানীয় হাসপাতালে। সকালের দিকে শানু কিছুটা সুস্থ হলে তার মুখ থেকে শায়লা সবটা শুনে নেয়।সে তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় মন্ডল বাড়িতে।মন্ডলের অমানুষ ছেলে কেন তার মেয়ের এতোবড় ক্ষতি করলো তার বিচার চাইতে।
মন্ডল বাড়ির ভিতর ঢুকেই শায়লা গলাভেঙ্গে ডাকতে থাকে সবাইকে।মালেক মন্ডল,মন্ডলের বউ,তার মেয়েরাসহ সবাই বেরিয়ে আসে উঠোনে।শায়লা রাতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার কথা তাদের জানায়।সবটা শুনে মালেক মন্ডল শায়লা কে বের করে দিতে বলে বাড়ির ভিতর থেকে।মন্ডলের বউ মুখ বেঁকিয়ে বলে, তোর অপয়া মাইয়ারে গলায় দড়ি দিয়া মরতে ক।কার না কার সাথে কেলেঙ্কারি বাধাইয়া এহন আইছোস আমার ব্যাটারে ফাসানোর জন্য?তোগোর মা মেয়ের চাইল কি বুঝি না আমরা ভাবছোস?যা শিগগির বাইর হ বাড়ির ভিতরে থেইকা। শায়লা কে গলা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয় মন্ডলের বউ। শায়লা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় গ্রামের বাকি মুরুব্বিদের কাছে।তারা সবাই জানায় আজ বিকেলেই শালিস বসবে। মুরুব্বিদের কথা শুনে কিছুটা ভরসা পায় শায়লা।সে সকলের কাছে ধর্ষকের শাস্তি দাবী করে চলে আসে।
বিকেলে গ্রামের সকল মুরুব্বিদের নিয়ে প্রাইমারী স্কুল মাঠে শালিস বসে।সেখানে মালেক মন্ডলের ছেলেসহ মন্ডল বাড়ির সকলেই উপস্থিত হয়।ভরা শালিসে দাঁড় করানো হয় শায়লার বারো বছরের অবুঝ মেয়েটাকে।তাকে প্রশ্ন করা হয় তার মা যা বলছে তা সত্যি কি না?শানু কান্না চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।শায়লা মেয়ের অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আপনেরা এই বিচার করতে আইছেন?আমার এতটুকু মাইয়া সত্য মিথ্যার কি বোঝে? শায়লার কথায় বিচারে কিছুটা নিস্তব্ধতা তৈরি হয়।কিছুক্ষণ পরেই কিছু মুরুব্বি মালেক মন্ডলের সাথে আড়ালে কথা বলতে চলে যায়। সবশেষে তারা বিচারে এটাই ঘোষণা দেয় যে,শায়লা কে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হবে এবং সেইসাথে তার মেয়েকে নিয়ে এই গ্রাম ছাড়তে হবে।
শায়লা দুচোখের পানি ছেড়ে এতক্ষণ ধরে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়েছিলো ন্যায্য বিচারের আশায়।কিন্তু এই কথার পর সে ঘৃণা ভরা মুখ নিয়ে ভর শালিসে বললো, থু আপনেগোর ট্যাহার উপর,আমরা কালই চইলা যামু এই গেরাম ছাইড়া।এই আপনেগোর বিচার?আইজ যদি আপনেগোর মাইয়ার সাথে এমন হইতো পারতেন আপনেরা এই বিচার করতে?যদি এই বিচার কইরবেন তাইলে ক্যান সকালে কইছিলেন আপনেরা ন্যায় বিচার দিবেন আমারে?ক্যান এহন মন্ডলের ট্যাহার কাছে আপনেরা বেইচা গেলেন? শায়লার শেষ কথাটা শুনে সকল মুরুব্বি মুখ কাচুমাচু করে লজ্জার সাথে শালিস ছেড়ে উঠলো।যে যার মতো চলে যেতে লাগলো।সবার শেষে মালেক মন্ডলের ধর্ষক ছেলে,শায়লার দিকে তাকিয়ে নরপিশাচ যুদ্ধে জয়লাভ করার মতো ঘৃণিত এক হাসি দিয়ে চলে গেলো। শায়লা শানু কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো সেখানে বসে।
রাতে মন্ডল বাড়ি থেকে প্রচন্ড জোরে চিৎকার চেচামেচি শুরু হলো।আশে পাশের মানুষজন গিয়ে ভীর জমালো মন্ডল বাড়িতে।সবাই গিয়ে দেখলো মন্ডলের ছেলের কোমর থেকে পা পর্যন্ত এসিডে ঝলসে গেছে।মালেক মন্ডল গ্রামের ছেলে পেলেসহ লাঠি লন্ঠন হাতে ছুটে চলেছে শায়লাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শায়লা ততোক্ষণে শানুকে নিয়ে গ্রামের সড়ক পেড়িয়ে শহরের গাড়িতে উঠেছে। ঘুটঘুটে রাতের আধারে মুখে চাদর পেছিয়ে শায়লা তার মেয়েকে নিয়ে মন্ডল বাড়ির পিছনে রাস্তা দিয়ে মন্ডলের ছেলের জানালার কাছে যায়।সেখানে যেতেই দেখে মন্ডলের ছেলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জানালার কাছে বিছানা হওয়াতে শায়লা মন্ডলের বউকে কত বলতো সাপ পোকামাকড়ের ভয় আছে অথচ আজ তার ভেবেই ভালো লাগছে যে কাজটা কত সহজে করা যাবে।
শানু কে জানালা থেকে একটু দূরে দাড় করিয়ে শায়লা চাদরের নিচ থেকে এসিডের বোতলটা বের করে একবার তাকিয়ে দেখে নিলো।মুখভরতি ঘৃন্না নিয়ে বোতলের মুখটা খুলে ছুরে মারলো শানুর ধর্ষকের কোমরের দিকে।
মেয়ের ধর্ষকের চিৎকারে শায়লার কলিজাটা শীতল হয়ে গেলো।নিজের মেয়ের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি সে নিজের হাতেই দিলো।শায়লা আর এক মূহুর্তও না থেকে এক দৌঁড়ে শানুর হাতটা ধরে হারিয়ে গেলো অন্ধকার রাস্তার মাঝে। গাড়িতে যেতে যেতে মেয়েকে চাদরের নিচে জড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি হেসে শায়লা মনে মনে ভাবছে,হয়তো এতক্ষণে গ্রাম ভেঙে পড়েছে ধর্ষকের শাস্তি দেখতে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক