প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে বিছানায় উঠে বসলো শরিফ। সারা শরীর তার ঘামে ভেজা, খানিকটা ধাতস্থ হয়ে তাকালো ঘড়িটার দিকে।
ঘড়িটা যেন বিজ্ঞের মত পেন্ডুলাম দুলিয়ে বলছে “ কি ব্যাপার শরিফ?
রাত বাজে কেবল ৩ টা, এখনি উঠে বসলে যে? “ এ প্রশ্নের জবাব শরিফের জানা নেই।
খালি এটুকুই জানে কি যেন একটা স্বপ্ন দেখলো সে, প্রচণ্ড আতঙ্কের স্বপ্ন, কারো লাশ সাদা কাফনে মোড়া !!! তার আর কিছু মনে নেই।
ছোট মফস্বল শহর জমশেদপুর। পাহাড়ে বেষ্টিত এই শহরের পোস্ট অফিসের সাধারন কর্মচারী শরিফ সাহেব।
সারাটা দিন তার যায় চিঠি বাছতে বাছতে। কত জনের সুখ দুঃখের খবর বয়ে বেরান তিনি কিন্তু তার কোনও খবর আসে না।
বিয়ে করেননি , থাকেন স্থানীয় এক দোকানদারের গুদামের দোতালার ঘরে।
সহকর্মীদের ধারনা শরিফ সাহেবের বিয়ে ব্যাঙের সর্দি টাইপের কিছু একটা কিন্তু রবিউল জানে যে তার বিয়ে হবে এবং তা হবে মৃওিকার সাথে।
মৃওিকা হচ্ছে শরিফের তৃতীয় ও শেষ ভালবাসার নাম। তৃতীয় এই কারনেই যে শরিফ মহামানব টাইপের কিছুনা।
জীবনে চলার পথে যাকে তার ভালো লেগেছে তাকেই সে মনে ধরেছিলো কিন্তু মৃওিকার মতো কেউ এত দীর্ঘ সময় টিকে নি।
সুতরাং এটাই তার প্রকৃত ভালোবাসা।
৩ টায় ঘুম থেকে জাগার পর আবার কখন ঘুমিয়ে পরেছে তা মনেই নেই শরিফের।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ব্যাস্ত হয়ে পরলো নতুন দিনের মোড়ক উন্মোচনে।
তার প্রিয় ফনিক সাইকেলের পিঠে সওয়ার হয়ে সে ছুটে গেল পোস্ট অফিসে।
সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার মাঝে যখন দুপুরে সে একটু দম নিতে ব্যাস্ত,..
তখনি আচমকা চোখ পরলো আটকে গেলো সবার উপরে চিঠির রাকের সবার উপরের চিঠিতে।
চিঠিতে প্রেরকের নামে লেখাঃ
নাসরিন আহমেদ মৃওিকা
১০৮/৬ ব্লক-ডি, বনানী
কতক্ষণ এই চিঠির দিকে তাকিয়ে ছিলো মনে নেই, সহকর্মীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
খানিকটা ভয়, খানিকটা আনন্দ আর খানিকটা ভালোবাসায় তুলে ধরলো চিঠিটা।
চাকরী জীবনে এতগুলো বছরে যা করেনি তাই করে বসলো, চিঠিটা লুকিয়ে ফেললো টেবিলের ড্রয়ারে।
আজকে বাসায় ফিরলো অন্যরকম এক শিহরণ নিয়ে, কলেজে যে শিহরণ তিনি পেত মৃওিকার দিকে তাকিয়ে ,
কত দিন যে স্যারের মূল্যবান লেকচার মিস করেছেন তার হিসাব নেই।
অনেক জল্পনা কল্পনা শেষ করে শরিফ চিঠিটা খুলে ধীরে ধীরে পরতে শুরু করলো।
ফুপু,
আমার সালাম নিবেন। আশা করি ভালো আছো। জানি খুব অবাক হচ্ছো এতদিন পরে তোমাকে চিঠি লিখছি।
বলতে গেলে নিত্তান্তই বাধ্য হয়ে চিঠিটি লিখলাম। আপনি আমার স্বামীকে জানেন।
বিয়ের পরে কেন যে এভাবে বিগড়ে গেলো, কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে।
শ্বশুর বাড়িটা এখন আমার কাছে নরকের চেয়েও খারাপ জায়গা বলে মনে হয়।এতদিন শুধু বোবা কান্না কেঁদেছি কিন্তু আর পারছি না।
তুমি আমাকে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। আমার তো বাবা মা নেই, তুমিই আমার সব। আমি ডিভোর্সের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত।
ইতি,
মৃওিকা
চিঠি পরে শরিফের শুধু মনে হতে লাগলো কলেজ জীবনে করা শপথ যা তিনি মৃওিকার জন্য করেছিলো –
“বাস্তবে না হলেও কল্পনায় তুমি আমার, তোমার ক্ষতি কেউ কক্ষনো করতে পারবে না।“
চিঠিটি পরে শরিফ কান্না আটকাতে পারলো না। সে রাতে তার আর খাওয়া হলো না। বার বার চিঠিটা পরতে লাগলেন।
পরদিন আগের মত চিঠিটা খামে আটকিয়ে সকালে রওনা হলেন, পোস্টঅফিসে না আজ তিনি যাবেন মৃওিকার ফুপুর বাড়ি, রায়খালি।
অনেক পথ ঘাট পেরিয়ে তিনি যখন মৃওিকার ফুপুর বাড়ির উঠোনে তখন সূর্য মদ্ধ গগনে ।
বাড়িতে ঢুকে তিনি সাইকেলটা হোল্ড করে এগোলেন দোচালা টিনের ঘরের দিকে।
দরজায় কড়া নাড়তে যাবেন ঠিক এই সময় দেখলেন দরজায় মস্ত বড় এক তালা ঝুলছে।
হতভম্বর মত কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলেন তিনি তারপর পাশের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলেন ,
বাড়িটিতে এক বুড়ি একা থাকতো, গত সপ্তাহে মারা গেছে, বুড়ির কোন আত্মীয় স্বজন ছিলো না, তাই গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে তাঁকে দাফন করে।
শরিফকে বুড়ির আত্মীয় মনে করে গ্রামের এক মাতব্বর গোছের লোক এসে ৫,০০০/= টাকা তুলে দিয়ে বললও
“ভাইসাব যে যাইবার সে গেছে গা, আমরাও জামু একদিন, মনে কোন কষ্ট রাইখেন না।
বুড়ির কোন আত্মীয় স্বজন নাই জানতাম শুধু এক ভাস্তি আছে ঢাকাতে, হে থাইকাও নাই। এই টাকা কয়টা রাখেন।
বুড়ির জমিজমা আমিই দেখাবনে ,আপনার আহন লাগবো না।“
খেকিয়ে উঠলো শরিফ। লোকটিকে আচ্ছা মতন আপমান করে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। সাইকেল ছুটালেন শহর পানে।
শরিফ এখন দাড়িয়ে আছে ১০৮/৬ ব্লক- ডি লেখা নেম প্লেটের সামনে।
এই পর্যন্ত আসতে যে তার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তা তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায়। বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক বিস্ময়ে।
এখানেই থাকে তার মৃওিকা অনেক ভালবাসার মৃওিকা। অজানা শঙ্কায় তার মন কেঁপে উঠছে বার বার।
মৃওিকা তোমাকে কি পাব, তুমি কি আমাকে চিনতে পারবে? সেবারের মত আবার আমায় অপমান করবে না তো?
দারোয়ান এর প্রশ্নে তার কল্পনার সুতা ছিঁড়ে গেলো।বিশাল আকৃতির গেটটার কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে নিজেকে।
দারোয়ান কে বলল- “ তোমার সাহেব আছেন? তাঁকে একটু বলবে মৃওিকার গ্রামের বাড়ির লোক এসেছে।“
দারোয়ান ভেতরের দিকে চলে গেলো। শরিফের সময় যেন আর কাটতে চায় না। অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর কাটলো।
দারোয়ান এগিয়ে এসে একটা কাগজ তুলে দিলো আর বললো …
“ভাইজান চিঠিতে সব লেখা আসে, তাড়াতাড়ি এখান থেকে যান , শুধু এইটুকুই জাইনেন ভাবীসাব খুব কষ্টে আছে।
কিছু দূর এগিয়ে একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লো শরিফ, বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পরতে শুরু করলেনঃ
সত্যিই ফুপা আপনি এসেছেন?
আসলে প্রথমে ভাব্লাম ফুপি এসেছে কিন্তু যখন সুনলাম পুরুষ লোক তখন আমি নিশ্চিত হলাম ফুপা আপনি এসেছেন।
ফুপা আপনি আজ রাতটা কি ঢাকায় থাকতে পারবেন? যদি পারেন তবে আমি কাল সকাল ১১ টায় বাড়ির পাশের কেজি স্কুলটার গেটে থাকবো।
আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি প্রস্তুত থাকবো।
হায়রে মৃওিকা তুমি জানোই না তোমার ফুপা ফুপি কত আগে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন আর তুমি কিনা তাঁদের আশায় বসে আছো?
শরিফ দাঁড়িয়ে আছে একটা কেজি স্কুল এর পাশে, দৃষ্টি স্কুলের গেটের দিকে। হটাত চমকে উঠলেন তিনি আরে এ যে আমার মৃওিকা !!!
কতদিন পর দেখলাম। মৃওিকা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না বোধ হয়।
মৃওিকা ও শরিফ এখন মুখোমুখি। কতোই না চেনা ছিলো কিন্তু আজ? মৃওিকাই প্রথম নিজেকে সামলালো। আদান প্রদান হল সকল তথ্যের।
শরিফের প্রস্তাবে আগের বারের মত মুখ ঝামটালো না, মেনে নিলো সব। কাল আবার আসবে মৃওিকা, সব প্রস্তুত করেই আসবে,
চলে যাবে জামসেদপুরে শরিফের ঘরে আলো জ্বালাতে, শুধু মাত্র শরিফকে নিতে হবে মৃওিকার চার বছরের মেয়ের দায়িত্ব।
সেই চায়ের দোকানে শরিফ দাঁড়িয়ে তার মৃওিকা আসবে, যত বাধাই থাকুক আজ সে আসবে, আসতে যে তাঁকে হবেই।
কিন্তু ঘড়ির কাটা তো জানান দিচ্ছে যে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এত দেরি করছে কেন মেয়েটা? তবে কি আসবেনা?
কথাটা মনে হতেই বুকটা কেমন যেন করে উঠলো শরিফের। হাটতে থাকলো মৃওিকার বাসার দিকে।
গেটে সেই একই দারোয়ান। তাঁকে শরিফ জিজ্ঞেস করল “ ভাই ভালো আছেন?”
দারোয়ান অবাক- “কি কন আমারে?”
-“ হ্যাঁ ভাই, চিনতে পারলেন না? অই যে কাল আসছিলাম , আপনার ভাবীসাব কই?
-দারোয়ান খেঁকিয়ে বললো – “ পাগল নাকি? এমনিতেই ঝামেলায় আছি।
শরিফ ভাবলো দারয়ান তাঁকে না চেনার ভান করছে, তাই তিনি কথা চালিয়ে যাবার জন্য জানতে চাইলেন “কি ঝামেলা ভাই”?
-“ আর কইয়েন না, গত কাল রাতে বড় সাব মদ খাইয়া বাসায় ফিরলে ভাবীসাহেবের সাথে মেলা কথা কাটাকাটি হয়।
একসময় বড় সাব ভাবীসাবের গলা টিপা ধরে, তারপর সব শেষ।
-কি?? আঁতকে উঠে শরিফ। তোমার ভাবীর নাম কি ছিলো?
– মৃওিকা ভাবিসাব।
প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে ঘুম ভাঙ্গলও শরিফের। সারা শরীর ঘামে ভেজা। কি স্বপ্ন দেখে এভাবে ঘুম ভাঙ্গে তার তা নিজেকেই প্রশ্ন করে শরিফ।
তার শুধু মনে পরে কারো মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন তিনি। এর চেয়ে বেশী কিছু মনে করতে পারেন না।
কে মারা গেলো আবারো নিজেকে প্রশ্ন করেন কিন্তু কোন উত্তর আসে না। আসবে কি করে তিনি যে ভালবাসেন শুধুই মৃওিকাকে।
তার মন এই চিরন্তন সত্য তাঁকে কি করে জানাবে??