কর্মফল

কর্মফল
জীবনের এমন একটি খুশির দিনে আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে ঘরে আসবে তা আমি ভাবতে পারি নি কখনো । বিয়ের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পর আমি মা হতে চলেছি , আজই জানতে পারলাম এই খবর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট এখনো আমার হাতে আর আমার সামনে দাড়িয়ে আছে আমার স্বামী রিসাদ আর তার নব বিবাহিতা স্ত্রী রিসা । তাদের নামের ও অনেক মিল , কি অদ্ভুত তাই না ! ” দেখো অবন্তী তোমার আমার বিয়ে হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর হলো এখনো তুমি আমাকে মুখ দেখাতে পারনি । জানি ডাক্তার বলেছে তোমার কিছু কমপ্লিকেশন আছে যা চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যাবে, এই জন্য গত একবছর ধরে তোমার চিকিৎসা করাচ্ছি এবং আমরা ও চেষ্টা করে যাচ্ছি কই এখনো তুমি মা হতে পারলে না । আমি আমার বংশ বৃদ্ধি করতে চাই সারা জীবন ধরে আমি নিঃসন্তান থাকতে পারবো না তাই আমি আরেকটি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি ।
এতোক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে অবন্তী প্রতিটি কথা শুনছিল রিসাদের । এই কি তার সেই রিসাদ যাকে ভালোবেসে সকলের বিরুদ্ধে যেয়ে তার হাত ধরে এক কাপড়ে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সব ত্যাগ করে চলে এসেছিল । জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে , সুখ-দুঃখ সবকিছুতে তার সাথী হবে বলে কথা দিয়েছিল আজ কি সে তার দেয়া সকল কথা ভুল প্রমাণিত হলো । এইতো কয়েক মাস আগেই তো যখন অবন্তী ভেঙে পড়েছিল তখন রিসাদই তাকে ভরসা দিয়েছে যে কিছু হবে না আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন । আজ রিসাদ কেনো এমন একটি কাজ করলো ।  শুনো অবন্তী আমি ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছি তুমি চাইলে এতে সিগনেচার করে চলে যেতে পারো অথবা আমাদের সাথে এখানে থাকতেও পারো আমরা কিছু মনে করবো না । তোমার প্রতি আমি আমার কোনো দায়িত্বের অবহেলা করবো না ” ।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অবন্তী বললো, ” যেখানে ভালোবাসাটাই রইলো না সেখানে তোমার এই লোক দেখানো দায়িত্ব পালন করে কি করবে । আমি তোমার জন্য আমার পরিবার ছেড়ে তোমার জীবনে আসলাম আজ তুমিই আমাকে তোমার এই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে । যাই হোক আমি কোনো প্রকার দয়া চাই না তোমার থেকে তুমি তোমার নতুন বিবাহ জীবনে খুশি থাকো তা কামনা করি । দাও ডিভোর্স পেপার টা এখোনো সই করে দেই ” ।
এতোক্ষণে মুখ খুললো রিসাদের নতুন স্ত্রী রিসা , ” আপু যখন চাইছে তাহলে তুমি ওনাকে ওনার মতোই থাকতে দেও আর আমরা ও আমাদের নিজের মতো করে থাকি ” । রিসার কথা শুনে অবন্তী বললো , ” আমি আজই এখান থেকে চলে যাবো আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না শুধু যাওয়ার আগে একটি কথা বলে দিতে চাই , প্রকৃতি কখনো প্রতিশোধ নিতে ভুলে না রিসাদ । আমি কিছু না করলেও প্রকৃতি তোমাকে ছাড়বে না ” । এই বলে অবন্তী তার সমস্ত জিনিস নিয়ে রিসাদের বাড়ি ত্যাগ করলো সাথে নিয়ে গেল ছোট্ট একটি প্রান যার অস্তিত্বের কথা হয়তো রিসাদ কখনো জানতেই পারবে না । ৬ বছর পর  ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রিসাদ রিসাকে বাড়িতে পাঠিয়ে একটি পার্কে যেয়ে বসলো । তখনি হঠাৎ দূরে একটি মেয়ে বাচ্চাকে তার বাবার সাথে খেলতে দেখলো , মেয়েটিকে দেখে হঠাৎ সে অস্থির হয়ে ওঠলো । মেয়েটি দেখতে অনেকটা তার প্রাক্তন স্ত্রী অবন্তীর মতো দেখতে ।
একনাগাড়ে সে কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে রইলো । মেয়েটি একটি বেঞ্চের কাছে দাড়িয়ে কার কাছ থেকে যেনো পানি নিয়ে খেলো আগ্রহবসত রিসাদ উকি দিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেল , এতো তার অবন্তী! সে এখানে এই বাচ্চাটির সাথে কি করছে , আরো অবাক হলো যখন দেখতে পেলো অবন্তী অন্তঃসত্বা । মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ অবন্তীর নজরে পড়ল একজোড়া চোখ যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একনাগাড়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে । সে আর কেউ না তার প্রাক্তন স্বামী রিসাদ । ধক করে উঠলো তার মন । মেয়ে কে রেখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলো রিসাদের দিকে , রিসাদ ও তাকে আসতে দেখে নেড়ে ছেড়ে উঠলো । সর্বপ্রথম রিসাদই কথা বললো ,
” কেমন আছো তুমি অবন্তী ” ?
” যেমনটা তোমার কাছে ছিলাম তার থেকেও অনেক গুণ ভালো ” । অবন্তীর জবাবে মাথা নিচু করে ফেললো রিসাদ,
” ঐ লোকটি কি তোমার স্বামী আর ঐ ছোট্ট বাচ্চাটি ও কি তোমার মেয়ে ” !
” হ্যা, লোকটি আমার স্বামী আর বাচ্চাটি ও আমার মেয়ে ” ।
” বয়স কতো তার ” ।
” পাচঁ বছর দুই মাস “।
” তার মানে তুমি…..
” তুমি যেমনটা ভাবছো ঠিক তাই ,যখন আমি তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম তখনি আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম”।
” তুমি এতো বড় কথা আমায় বললে না কেনো , আমার একটি বাচ্চা আছে আর আমি তা জানতামই না ” ?
” আমি তোমাকে ঐদিনই বলতাম কিন্তু তার আগেই তুমি তোমার নতুন বউ আর ডিভোর্স পেপার নিয়ে আসলে তাই আর তোমায় কিছু বলেনি । আসল কথা কি জানো তুমি তা জানার যোগ্যতাই রাখো না ” ।
অবন্তীর কথায় চোখ ছলছল করে উঠলো সত্যিই সে কোনো যোগ্যতাই রাখে না তার অনাগত সন্তানের খবর জানার ।
” আমায় ক্ষমা করে দেও অবন্তী আমি সত্যিই তোমার অপরাধী “। তুমি ঠিকিই বলেছিলে প্রতিশোধ নিতে ভুলে না কখনো, শোধ সমেত সব ফিরিয়ে দেয় । আল্লাহ আজ আমায় তোমার প্রতি করা অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছে ” ।
” ঠিক বুঝলাম না আমি কি বলতে চাও তুমি ” ?
” রিসা কখনো মা হতে পারবে না অবন্তী এই পাঁচটি বছর কতোই না ডাক্তার দেখালাম সবার একই জবাব সে কখনো মা হতে পারবে না , তোমার তো তাও কিছু চান্স ছিল রিসার সেটাও নেই । তাকানো যায় না রিসা মেয়েটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে । তার দিকে তাকালে শুধু তোমার কথাই মনে পরে , তোমার প্রতি করা অন্যায়ের কথা মনে পরে ” ।
কি বলবে অবন্তী তা ভাবতে পারলো সে জানে একটি সন্তানের জন্য আহাজারি কতো কষ্টের , কিন্তু প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকি নিয়েছে ।  দেখো রিসাদ যা হয় সব ভালোর জন্যই হয় তোমার থেকে পাওয়া কষ্টের বিনিময়ে আমি দিহান কে পেয়েছি , সে আমায় প্রচন্ড ভালোবাসে এমনকি আমার মেয়েটিকেও । তুমি পুরনো সব ভুলে যাও আর রিসার খেয়াল রেখো তার যত্ন নিও , এই সময়ে একটি মেয়ের সবচেয়ে প্রয়োজন তার স্বামীর কিন্তু আফসোস ঐ সময়ে তুমি আমার সাথে ছিলে না যাকগে সেই কথা ভালো থেকো আসি ” । অবন্তী রিসাদের ডাকে পিছু ফিরলো সে ,
” মেয়ের নাম কি ” ? আমি কি একবার তার সাথে দেখা করতে পারি ” ?
” দেখা করতে পারো কিন্তু এক শর্তে তুমি ওকে তুমিই যে ওর আসল বাবা এটা বলতে পারবে না জন্মের পর থেকে ও দিহানকেই বাবা বলে চিনে আর নামটা না হয় ওর থেকেই জেনে নেয়া যাবে” ।
অবন্তী রিসাদকে সাথে করে তার মেয়ের দিকে নিয়ে গেল ,
” বাবু কি নাম তোমার “?
” আমার নাম মিফতাহুল নুর “!
মেয়ের নাম শুনে বেশ অবাক হলো রিসাদ এইতো সেই নাম যা বিয়ের প্রথম প্রথম অবন্তী আর রিসাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের মেয়ের নাম রাখবে অবন্তী তার কথা রেখেছে ।
” মা আঙ্কেল কে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করো ” ?
” কেমন আছেন আঙ্কেল ” ?
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাই না , নিজ সন্তানের মুখ থেকে আজ আঙ্কেল শুনতে হচ্ছে । এটাই হয়তো তার “কর্মফল” । ” আলহামদুলিল্লাহ মামনি ভালো আছি তুমি কেমন আছো “। ” আমি ও ভালো ” এতোক্ষণ পাশে দাড়িয়ে তাদের সকল কথা শুনছে দিহান , সে রিসাদকে চিনে । তাই সে আর এখানে কিছু বলছে না , কয়েক মূহুর্ত তার মেয়েটি তার জন্মদাতা পিতার সাথে কাটাক । ” নুর মামনি আঙ্কেল কে আল্লাহ হাফেজ বলো আমরা বাসায় যাবো এখন ” । রিসাদকে বিদায় দিয়ে তারা পা বাড়ালো পার্কের বাহিরে আর তাদের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে একজোড়া অশ্রুসিক্ত নয়ন । কর্মের ফল ভোগ করা এক অসহায় পিতা ।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত