অপয়া

অপয়া
জেঠিমা মা আমাকে একটু জায়গা দাও? এতো রাতে আমি কোথায় যাব বলো? তুমি তো জানোই মা মিথ্যা কথা বলে,একটা কথাও সত্য নয় বিশ্বাস করো আমায় ,ও জেঠিমা? ওই মেয়ে তোর মরণ নেই? সমাজটাকে নষ্ট করে নিজে কলঙ্কিত হয়ে এখানে জায়গা নিতে এসেছিস? তোর মতো নষ্টার জায়গা নেই এখানে।যা বেরিয়ে যা এখান থেকে, দূর হ চোখের সামনে থেকে,তোর মুখ দেখলেও পাপ।
এমন কেন করছো আজ রাতটা শুধু মাত্র জায়গা দাও। সকাল হতেই চলে যাব, দয়া কর একটু , আমার যে দুনিয়াতে কেউ নেই। শুধু মাত্র রাতটা থাকার জায়গা দাও, ঘরের ভিতর দিতে হবে না আমি না হয় রান্না ঘরে থাকবো। আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেখলে একবারে জবাই করে ফেলবো।যা এখান থেকে হারামজাদি। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তিস্তাকে, কোনো নষ্টা মেয়েকে জায়গা দিবেন না তিনি।আজ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে তিস্তাকে ,যুব সমাজকে নাকি সে ই শেষ করে দিবে। তিস্তার প্রতি অভিযোগ হলো সে শরীরে দিয়ে আকৃষ্ট করে তার খালাতো ভাইকে রাতের অন্ধকারে কাছে টেনে নিয়ে যায় এবং তার সংসার ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করছে।সেই অভিযোগে অভিযুক্ত করে আজ তাকে গ্ৰাম ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে।
কিছুতেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি তিস্তা,সৎ মায়ের কূটনৈতিক বুদ্ধির কাছে আজও সে পরাজিত। বাবা মারা যাওয়ার পর তার অত্যাচার নির্যাতন বাড়তে থাকে কিন্তু এতোটা হবে ভাবতে পারেনি ।কি করবে সে? দুই কূলে যে কেউ নেই তার, যদি কাল তাকে গ্ৰামের মানুষ দেখে তখন মেরে ফেলবে সকাল হওয়ার আগেই চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কিন্তু রাতটা? ভেবেছিলো জেঠিমার কাছে কাটিয়ে দিবে অথচ ভদ্রমহিলা জায়গাই দিলো না বরং দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিলো।চোখে পানিতে বন্যা হচ্ছে যেন তার , কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চলে গেল আবার সৎ মায়ের কাছে কোনোমতে যদি রাতটা কাটানো যায়।নিম্নস্বরে তিস্তা তার সৎ মা কে ডাকে মা একটু আশ্রয় দাও আজকের রাতটা‌।কাল সকালের আগে চলে যাব। সতীনের মাইয়া আবার কিয়ের ল্যাই আইসোস,তোর কি সরম নাই ? এত্তো ঝামা ঘসার পরেও কাম হয় নাই। ব্যাডা লাগবো নাকি?
নিশ্চুপ তিস্তা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে একটু আশ্রয়ের জন্য।জানে সে পারবে না এই মহিলার সাথে, কয়েকদিন আগে তার মায়ের নামে আজেবাজে কথা ও গালাগালি করছিলো প্রতিবাদ করাতে সহ্য করতে হয়েছে ব্যবহৃত ঝাটার আঘাত‌। শরীরের যে জায়গায় লেগেছে ঝাড়ুর শলা বিদ্ধ হয়েছে। অত্যাচার নির্যাতন লাঞ্ছনা গঞ্জনা কম সহ্য করেনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে এখন আর সাহস হয়না তিস্তার।ভয় নিয়ে আবার ও বললো শুধু আজ রাতটা বেশ্যা পাড়ায় যা, অনেক জায়গা পাবি থাহনের,এই বাড়িতে জায়গা নাই তোর ‌। রফিক কোনোমতে যেন সদর দরজা না খোলে ,চ্যাইয়া রাখবি তুই।
শত্রু একবার খেদাইছি বার বার সুযোগ পামু না ।কিরে বুঝলি? জে আম্মাজান,আন্নে কোনো চিন্তা কইরেন না ওই নষ্টা মাইয়া বাড়িতে ঢুকবার পারবো না। ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর তিস্তার, সবাই তাকে কিভাবে নষ্টা বলছে।গেইট থেকে দৌড়ে চলে যায়, অনবরত দৌড়াচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কিছু জানে না।রাত যতই বাড়ছে ততই অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্ৰাস করছে। চাঁদটাও নেই আজ আকাশে,হয়তো কষ্টে মুখ লুকিয়েছে। একসময় তিস্তার দৌড় থামে,সে আসেপাশে তাকিয়ে দেখে রেললাইনের রাস্তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অজানা ভয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আসেপাশে কেউ তাকিয়ে আছে মনে হয়, কিন্তু যেদিকে তাকায় অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বাইরের ভয় মনের ভয় জেঁকে বসেছে মনে, চারপাশ থেকে কিসের যেনো আওয়াজ আসছে কান চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে তিস্তা। একসময় আকাশে চাঁদ উঁকি মারে, ক্ষীণ আলোয় কিছু স্পষ্ট না দেখা গেলেও আঁচ করা যাচ্ছে ‌। নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায় তিস্তা, রেললাইনের রাস্তা ধরে হাঁটে চলছে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে। সামনে কিসের যেনো আলো দেখা যাচ্ছে আর হাঁটতে পারছে না চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তিস্তা,সামনে গিয়ে দেখে দুই জন লোক জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।আলো জ্বলছে তাদের পাশে, তিস্তা বুঝলো ওরা নেশার ব্যস্ত তাই নিঃশব্দে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু একজন দেখে ফেলে। উস্তাদ দ্যাখেন কেডায় যায়। হুমমমম কেডায়?
তিস্তা দ্রুত পা চালায় ,আর রক্ষা হলোনা বুঝি । দৌড় দিবার জন্য পা বাড়াতেই অপরজন আবার বলে উঠলো
অই মাইয়া দৌড় দিবি না।দৌড়াইয়া ধরমু কইলাম।তরে আইজ শেষ করুম খাড়া তুই। তিস্তার পা যেন চলছে না।ক্লান্তিতে এখানেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে তবুও দ্রুত হেঁটে চলছে সামনে দোকানপাট আছে কোনোভাবে পৌঁছাতে পারলেই হলো কিন্তু পেরে উঠলো না লোকগুলো ধরে ফেললো তাকে। সুন্দরী অহন কই যাবি? ছাড়েন আমাকে,ছাড়েন বলছি। পুলিশে দিব আপনাদের আমি। এতো রাত্রে রাস্তায় কি কাস্টমার খুঁজতে আইসোস? আয় আমাগো কাছে ডাবল দিমু তোরে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই এখন তিস্তার , চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করছে। নিজেকে ছাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।তিস্তা কে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে । দ্বিতীয় লোকটি ঠাস করে চড় মেরে দিলো তিস্তার গালে, ওই মা* অহন এ্যাই খানে কেউ আইবো না।কম চিল্লাচিল্লি কর, নাইলে কাম খালাস কইরা দিমু। ঠিক তখনই একজন লোক দৌড়ে আসলো ।
কেডায় চিৎকার দিলো ? কেডায় এইখানে? মাতাল লোকগুলো থমকে যায়। দৌড়ে আসলো একটি যুবক , তাদের সামনে দাঁড়াতেই বললো তুই আবার কেডায় ? ভাগ বসাইতে আইছোস? তিস্তা তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হাজার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। দৌড়ে আসা যুবক টাকে বললো আমাকে বাঁচান ওদের হাত থেকে।আমাকে মেরে ফেলবে,দয়া করেন একটু। মাইয়াডারে ছাইড়া দেন নাইলে কিন্তু খারাপ হইয়া যাইবো। কি করবি রে হালা? দ্যাখ এই দ্যাখ দাও ।এইডা দিয়া কোপামু তোরা দুইজনেরে। লোকগুলো একটু ভয় পেয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর আবার বললো কামডা ভালা করতাছস না কিন্তু। কথা বলার সাথে সাথেই যুবক ছেলেটি একজনের দিকে তেড়ে আসলো দা নিয়ে ভয় পেয়ে দুজনেই পালায়। তিস্তা ভয়ে ভয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। আপনি কই যাইবেন? পৌঁছাই দিয়া আই আফনেরে। তিস্তা চুপ করে আছে, কিছু বলছে না দেখে আবার জিজ্ঞেস করলো কন না ক্যান? কই যাবেন ?
আমার যাওয়ার জায়গা নেই ‌। পৃথিবীতে আমি একা। ক্যান বাপ মা নাই? না। মরছে? হুম। থাকনের জায়গা নাই? না। এই অবস্থা ক্যামনে? বাড়িঘর ও নাই নাকি? কোন গ্ৰাম ,দ্যাখতে তো শিক্ষিত মনে অয়। তিস্তা কান্না করতে থাকে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব খুলে বলে।সব শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটি । আরও বললো আমি তো মেলা গরিব। আমার লগে গেলে বিয়া কইরা যাইতে হইবো।বউ ছাড়া অন্য কাউরে ঘরে তুলবো না মা।মারে বুঝাইয়া কমু চলেন আমার লগে। আমাকে বিয়ে করবেন? ছেলেটি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে বললো আফনে শিক্ষিত আর আমি এইট পাশ।পানের দোকান আছে একটা ঐ খানে,আমারে বিয়া করলে সুখ পাইবেন না।
আপনি বিয়ে করবেন না তাহলে? আমি এখন কোথায় যাব? আমার যে কেউ নেই, আমার যে একটা বিশ্বস্ত হাত প্রয়োজন।যে হাত আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে পারবো গাছ তলায় ও। ছেলেটির নাম ছিলো তিতাস মিয়া, রাজি হয়ে যায় বিয়ে করতে। শুরু হয় নতুন জীবন, নতুন পথচলা। তিস্তা পেয়ে যায় বিশ্বস্ত একটি হাত এবং একটি বিশ্বস্ত মানুষ। তিস্তা মনে করে তিতাস তার জীবনে ফেরেস্তা হয়ে এসেছে । তাদের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে সংসার চলছে খুব আনন্দে,কষ্ট আর ছুঁতে পারেনি তিস্তাকে। তিতাস দেয়নি ছুঁতে, আগলে রেখেছে ভালোবেসে সবসময়। আজ দুই বছর হল তাদের বিবাহিত জীবনের। তিস্তার বাচ্চা আসছে শুনে কতো যে খুশি হয়েছে তা বলে প্রকাশ করতে পারবে না তিতাস।টক ঝাল মিষ্টি সব কিছু এনেছে সাধ্যমত । তিস্তার শুধু খেতে মন চায়।আজ সে তিতাসের কাছে লজ্জা সহকারে বললো
এ্যাই শুনো না, আমার না খুব কবুতরের মাংস খেতে মন চাইছে। সত্যি কইতাছ বউ? হুম। আমার এতো কবুতর পালা আইজ বুঝি সার্থক হইলো। ক্যান? তুমি খাইবার চাইলা।এখন ই দেখমু চল কবুতরের বাসায় বাচ্চা আছে কি না।ঐ দিন ডিম দিছিলো না। হুম। দুজনে উঠানে গেল।একটা ভাঙ্গা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে তিতাস কবুতরের খোপে হাত দিলো , সাথে সাথে আমার উফফ বলে চিল্লিয়ে হাত বেড় করে নিলো।এমন আওয়াজে অস্থির হয়ে তিস্তা জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? মনে হয় ইন্দুরে কামড়াইছে বউরে। কবুতরের খোপে ইন্দুরে বাসা বাঁনাইছে। নাআআআআআ।সাপ সাপ সাপ, এদিকে আসো তুমি।
ইঁদুরে কামড় দেয়নি তিতাসকে দিয়েছিলো সাপে। কবুতরের বাসা থেকে বেশ বড়সড় একটি সাপ বেড়িয়ে আসে তাদের সামনেই। বিষাক্ত সাপের কামড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে তিতাস।শরীর নীল বর্ণ ধারণ করছে। তিস্তা হাজার বার বলছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কিন্তু তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দিচ্ছে না। সাপুড়ে আনাতে তারা ব্যস্ত। তাদের ধারণা ডাক্তারের ইনজেকশনের সাথে সাথে মারা যাবে তাদের একমাত্র ছেলে। আগের বার ও এমন হয়েছে গ্ৰামে। সকাল পেরিয়ে দুপুর সাপুড়ে আসে কতোক্ষণ বিরবির করে বলে মানুষটি মৃত।চলে গেছে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। তিস্তা ঢলে পড়ে উঠানে কথাটি শুনে,তার শ্বাশুড়ি সন্তান হারানোর কথাটি সহ্য করতে পারে না। পাগলের মত আচরণ করতে থাকে।সবার সামনেই তিস্তাকে মারতে থাকে চুলের মুঠি ধরে। অপয়া, অলক্ষ্মী, হারামজাদি তোর লাইগা এমন হইছে। প্রথমে তোর বাপ মারে খাইছোস অহন আমার পোলাডারে। অ আল্লাহ গো আমারে নিলা না ক্যান? ক্যান বাঁচায় রাখলা আমারে?
অই অই মা*, বে** তুই মরলি না ক্যান? ক্যান খাইলি আমার পোলারে। আল্লাহগোওওও,,মাটিতে হাত চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে তিস্তার শ্বাশুড়ি।আর তিস্তা? সে তো এক ধ্যানে পা দুটো ছড়িয়ে বসে নীল বর্ণ ধারণ করা শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে।তার জন্য মানুষটার এই অবস্থা ,যদি কবুতরের খোপে হাত না দিতো তাহলে কি এমন হতো?ঠিকই সে একটা অপয়া , বুঝে গেছে তার সুখের দিন শেষ, আবার লড়াই করতে হবে জীবনের সাথে এবার আর একা নয় সাথে অনাগত সন্তানও আছে। তিস্তার চোখে ভাসছে আগামী দিনের আহাজারি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা,আর একরাশ হতাশা আর প্রিয়জনক হারানোর শোক বেদনা।
সাপুড়ে তার স্বামীকে না বাঁচাতে পারলেও সাপটা ধরেছে, তিস্তা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সাপের ঝাপিটার কাছে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে একটা লাঠি আনে একপর্যায়ে ঝাপি থেকে সাপটাকে টেনে বের করে, শুরু হয় সাপ আর তিস্তার যুদ্ধ।সবাই অবাক , বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ভয়ে কেউ তিস্তাকে ধরছে কেননা সে সাপটাকে মারতে ব্যস্ত,কাছে গেলেই সাপটা দংশন করতে পারে। হাত,পা,লাঠি যা দিয়ে পারছে সাপটাকে মারছে তিস্তা।১৫ মিনিট পর তৃপ্তির হাসি হাসে তিস্তা তার সামনেই রক্তাক্ত সাপটা পরে আছে। তিস্তার শ্বাশুড়ি দৌড়ে এসে তিস্তা কে ধরে, অনেক জায়গায় কামড়েছে সাপটা , বিষের অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে হেলে পড়ে তার শ্বাশুড়ির গায়ে। আস্তে আস্তে তিস্তার শরীরটাও নীল হতে থাকে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত