একটি ডায়েরীর আত্নকথন

একটি ডায়েরীর আত্নকথন
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমার এক আত্মীয়ের পুরো ফ্যামিলি মারা যায়। সেখানে আমার এক কাজিন ছিলো খুব ক্লোজ। মৃত্যুর আগে তার ডায়েরীর কিছু লেখা আপনাদের মাঝে শেয়ার করছি। ১ই মে-২০২০ বাবা দীর্ঘদিন শ্বাস কষ্টে ভুগছেন। সন্দেহ জনক ভাবে দুইদিন আগে করোনা টেষ্ট করতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমার সন্দেহটা সঠিক হলো। বাবার করোনা পজিটিভ। মূহুর্তেই চারিদিকে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। পাড়া প্রতিবেশীরা কেউ ভয়ে আমাদের বাসায় আসে না। আত্মীয় স্বজনরা মোবাইল এ খোঁজ খবর নেয়। সরকার কতৃক কিছু ত্রাণ পাই। আমার বাবা ছিলেন সামান্য খেটে খাওয়া মানুষ। ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় সব বাঁধা ডিঙিয়ে তিনি প্রতিদিনই ছুটে যেতেন কাজের সন্ধানে। কেননা বাবা একদিন কাজ না করলে আমাদের পেটে আহার জুটে না।
এতো দুঃখ, কষ্টের মাঝেও বাবা আমাদের কোনো অভাব অপূর্ণ রাখেন নি। বাবার স্বপ্ন ছিলো আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো। আর ছোট বোনকে ডাক্তার বানাবে। তাই বাবার পরিশ্রমের মূল্য দিতে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছি মাত্র। একটু সুখের মুখ দেখার আগেই বাবা আমাদের চোখের জলে বাসিয়ে চলে গেলেন পরপারে। বাবা আজ ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চোখের সামনে বাবার করুণ মৃত্যুর যন্ত্রণা এমন যেন কেউ আমার কলিজায় এসিড ঢেলে দিয়েছে। এক নিমিষে জ্বলে পুড়ে গেছে ভিতর ঘরটা। বাবার মৃত্যুতে আত্মীয় স্বজন তেমন কেউই আসেন নি। কারণ ততদিনে আমাদের বাড়িটা লকডাউন হয়ে গেছে। ভাইরাসের ভয়ে কেউ আসতে চাইনি। নিজেই বাবার সব ব্যবস্থা করলাম। সরকারী লোকদের সহয়তায় বাবার দাপন সম্পন্ন করলাম। আমাদের মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে গেলো। বাবার মৃত্যুতে পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।
১২ই মে ২০২০, আমাদের বাসায় আলাদা কোনো রুম নেই। যেহেতু ভাইরাসটা চৌদ্দ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে, সে হিসেবে আমরা সবাই বাবার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই মিশছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর করোনা ভাইরাসের লক্ষণ গুলো আমাদের মাঝেও দেখা দেয়। আমি বুঝে গেছি যে আমরা সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত। সর্বপ্রথম আক্রান্ত হয় মা। কারণ মা, বাবা সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি ছিলো। একদিকে বাবার মৃত্যু অন্যদিকে ভাইরাসের প্রভাবে মা দূর্বল হয়ে পড়ে। সেদিন রাতেই মা স্ট্রোক করেন, তখন প্রায় মধ্যরাত। মাকে নিয়ে কতো হাসপাতাল ঘুরেছি। সব হাসপাতাল গুলোই বন্ধ। ২-১ টা খোলা ছিলো তাতে কোনো ডাক্তার নেই। এমনিতে ডাক্তাররা ভাইরাসের ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না। যদিও বের হয় দিনের বেলা ক্ষনিকের জন্য। রাতের বেলা তো একেবারেই নয়। সেদিন ভোর হওয়ার আগেই মা বিনা চিকিৎসায় আমার সামনে ধড়ফড় করতে করতে মারা যায়। অস্পষ্ট স্বরে কেবল একটি কথায় বলেন, তোর বোন গুলোকে দেখে রাখিস। সেদিনের মতো কান্না আমি আর কোনদিন করিনি। সেদিন আমার আর্তচিৎকারের প্রতিধ্বনি কেউ শুনে নি, কেউ না।
নিজের হাতে মাকে কবরে রেখে আসলাম আমি। দাপন শেষ করে মায়ের রুমে গেলেই মনে হতো, মা এখনো মরে নি। আমার নাম ধরে বারবার তার কাছে ডাকে। আমি ছুটে যায় মায়ের কবরে। কবর জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। কখনো কখনো মায়ের কবরেই ঘুমিয়ে পড়ি। মায়ের বড্ড আদরের ছেলে ছিলাম আমি। একমাত্র ছেলে বলে সবাই আমাকে আদর করতো। বাবা মায়ের মৃত্যু পর আত্মীয় স্বজনদের সাথে আমাদের যোগাযোগ কমে যায়। ২৩ ই মে ২০২০, বড় আপুর বিয়ে হয়েছে দুবছর হলো। স্বামী প্রবাসী। বাবার সংসারে অভাব কষ্টে বড় হয়েছে। স্বামীর সংসারে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। বাবা বেশ আদর করে আপুকে উপমা বলে ডাকতেন। আপু ছিলো যথেষ্ট সুন্দরী। তাই তার রূপের উপমা হয় না। এজন্য বাবা তাকে উপমা বলে ডাকেন।
আপু গর্ভবতী। আমাদের বাড়িতে এসেছেন আজ তিন মাস হয়েছে। গর্ভবস্থায় মেয়েরা সচরাচর বাবার বাড়ি চলে আসে। কারণ মেয়েরা তাদের সকল দুঃখ কষ্ট মায়ের কাছে খুব সহজে শেয়ার করতে পারে। তাছাড়া গর্ভবস্থায় নিজের এক্সটা সেবা, যত্ন ও সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। কে জানতো সাহায্যের জন্য বাবার বাড়ি আসা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আপু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আপুর কোনো খবর নেয়নি। হ্যাজবেন্ডের সাথে মাঝে মাঝে আপুর ঝগড়া হতো। আমি আড়ালে লুকিয়ে শুনতাম। মাঝরাতে আপু চোখের জলে বালিশ ভিজাতো। আপুর সাথে ভাইয়ার কি কথা হয় আমি জানতাম না। তবে এটা বুঝতাম, অবশ্যই ভালো কিছু না।
আপুর চোখের নিচে কালি জমেছে। না জানি কতো রাত ঘুমায় নি। সারাদিন মন মরা হয়ে থাকে। আমার বড্ড খারাপ লাগে। একদিন আপু আমাকে ডেকে বলে, আচ্ছা বাবু, আমার সাজানো জীবনটা এভাবে এলোমেলো হলো কিভাবে? বলতে পারিস। আপুর কথার প্রত্যুত্তরে আমি কিছুই বলতে পারি না। মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে আসলাম। আজকে দুপুরে হঠাৎ আপুর প্রসব ব্যাথা উঠে। হাসপাতালে ভর্তি করায়। অপারেশন করে বাচ্চা নেওয়া হয়। কিন্তু দূভার্গ্য বাচ্চাটি ছিল মৃত।। ডাক্তার বললেন, অনিয়ম আর পরিচর্যার অভাবে বাচ্চাটি মারা যায়। আপুর শরীরে রক্তসল্পতা দেখা দেয়। ৪ ব্যাগ রক্ত ডোনেট করতে হবে। একদিনে সব রক্ত ম্যানেজ করতে পারিনি। সেদিন রাতেই আপুর শ্বাসকষ্ট উঠে তিনি মারা যান। আপু মৃত্যুতে আমার চোখে একটুও পানি আসে নি। অধিক শোকে আমি পাথর হয়ে গেছি।
৩রা জুন ২০২০, আদ্রিতার সাথে কথা হয় না অনেকদিন হলো। আসলে বাবা, মা, বোনকে হারিয়ে আমি একেবারে দিশেহারা ছিলাম। এতো দ্রুত স্বজন হারানোর ব্যাথা কাটিয়ে উঠতে পারি নি। কখন দিন যায়, কখন রাত আসে টেরই পাই না। আদ্রিতার সাথে পরিচয় হয় আমার ফেসবুকে। সেখান থেকে বন্ধুত্ব, তারপর সম্পর্ক। বাবা, মা ও আপুর মৃত্যুর কথা তাকে জানানো হয় নি। আমি যে অসুস্থ সেটাও জানাই নি। কারণ সে এসব শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে। মেয়েটা খুব নরম মনের। অল্পতেই বেশী খুশি। আমি জানি, সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার মৃত্যুর কথা শুনলে সে হয়তো সহ্য করতে পারবে না। মেয়েদের একটা জিনিস আমার খুব ভালো লাগে, যাকে মন দিয়ে ভালোবাসবে, তাকে সে কখনোই ভুলতে পারে না। আমি তাকে ভুলার চেষ্টা করি, ভুলতে পারি না। তার কথা মনে হলে, বুকের ভিতর ছটফট করতে থাকে। কতো কল করে, কতো টেক্সট করে।
আমি তাকে এড়িয়ে চলি। অযথা মায়া বাড়িয়ে কি লাভ। যখন থাকবো না, তখন এসব ভেবে তার কষ্ট হবে।
১০ই জুন ২০২০, শ্বাসকষ্টটা অনেক বেড়ে গেছে। খাওয়ার রুচি নেই বললেই চলে। ছোট বোনটাকে আইসোলেশনে পাঠাতে চেষ্টা করি। কারণ সে এতো বেশি অসুস্থ না। কিন্তু সে যেতে চাই না। বলে, সে যতদিন বাঁচে প্রিয়জনদের সাথে মুক্ত পাখির মতো বাঁচবে। সেখানে বন্দী দশায় দুকে দুকে মরতে চাই না সে। নিলা আমার ছোটবোন। এবার মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আমার টিউশনের প্রায় সব টাকা তার পিছে খরচ করি আমি। নিলার স্বপ্ন ছিলো সে ডাক্তার হবে। সেটা বোধহয় আর পূর্ণতা পাবে না। কারণ ততদিনে মরণব্যাধি ভাইরাস তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।
১৪ ই জুন ২০২০,, সন্ধ্যা থেকে দেখি নিলা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সারারাত আমার সাথে অনেক গল্প করলো সে। হঠাৎ সে বললো, ভাইয়া আমি যদি মারা যায়, তাহলে তুমি কান্না করো না। কারণ তুমি যখন মারা যাবে তাহলে তো কান্না করার কেউ থাকবে না। আমি মনে হয়, তার কথা শেষ হওয়ার আগে আমি নিলার মুখ চেপে ধরলাম। অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। পরেরদিন থেকে নিলা আমার সাথে আর কোনদিন কথা বলে নি। তার কথা বলা যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। তার মৃত্যুতে আসলেই আমার চোখে কোনো পানি আসে নি। আমার মনটা পাথর হয়ে গেছে। তাই মনটা এখন কারো জন্য কাঁদে না। ১৬ ই জুন ২০২০, সকাল থেকেই আমার অনেক রক্তবমি হচ্ছে। শরীরের শক্তি একেবারেই শূন্যের কোটায়। আজ অনেকদিন পর ভাংচুয়ালে আসলাম।
অনেক ম্যাসেজ জমা হয়েছে ইনবক্সে। সবার উপরের ম্যাসেজটা আদ্রিতার। একটা সময় তার ম্যাসেজ পেলে মনটা খুশিতে নেচে উঠতো। আর আজ তার ম্যাসেজ গুলো দেখে আমার চোখে জল আসে। পুরনো ম্যাসেজ গুলো পড়ে অনেক কাঁদলাম। এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ কান্না। ভাংচুয়ালে কতো মানুষের সাথে পরিচয়, কতো বন্ধুবান্ধব। আছে ভাই বোনের সম্পর্ক। কতো মজা আর দুষ্টুমিতে মেতে ছিলাম আমি। আজকের পর কেউ হয়তো এই আইডিতে আসবে না। কতো ম্যাসেজ জমা হবে। কতো কথা, কতো স্মৃতি মুছে দিয়ে হারিয়ে যাবো সবার অন্তরালে। ভাবতেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা মন খারাপের কোনো ঔষধ কি পৃথিবীতে আবিষ্কার হয় নি। হলে ভালো হতো, তাহলে মানুষ গুলো মন খারাপ করে বিষন্নতায় ভুগতো না।
মন খারাপের সময় গুলো বড্ড বাজে কাটে আমার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এটাই হয়তো আমার শেষ লেখা। আর লিখতে পারবো কিনা জানি না। আজকেও লিখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভাবছিলাম আমাদের যা কিছু আছে সব বিক্রি করে, কোনো এতিম খানায় দান করে দিবো। কিন্তু এটা করার মতো শক্তি আমার নেই। মাঝে মাঝে বলি, আল্লাহ আমাকে কটা দিন সময় দিন, আমার যে কিছু স্বপ্ন পূরণের বাকি আছে। এই ডায়েরীতে আদ্রিতাকে নিয়ে কতো লেখা, কতো স্মৃতি জমা আছে। ধূলো পড়ে নোংরা হবে কেউ হয়তো কোনোদিন খুলেও দেখবে না। শেষ ইচ্ছে ছিলো; আমার এই ডায়েরী টা যদি আদ্রিতাকে দিয়ে যেতে পারতাম। সেটা মনে হয় আর কোনদিন সম্ভব হবে না। এর পর থেকে এই ডায়েরীতে আর কোনো লেখা পাওয়া যায় নি।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত