এতিম সন্তানের জননী

এতিম সন্তানের জননী
আম্মা মারা গেলেন আমার তিন মাসের ছোট বোন নোহাকে রেখে। সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় আব্বা একেবারেই ভেঙে পড়েছেন। আম্মা যেদিন মারা গেলেন সেদিন ছিল ঘোর বর্ষণ। আষাঢ়ে বর্ষণ হয় খুব প্রখর।আবহাওয়াও থাকে শীতল। এইসব রাত্বিরে ঘুমে চোখ টেনে নেয়। আব্বা -আম্মাও সেদিন সকাল সকাল ঘুমিয়ে গেলেন। তারপর আব্বা যখন তাহাজ্জুদ পড়তে উঠলেন তখন আম্মাকেও তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য ডাকলেন।এটা আব্বার নিয়মিত অভ্যাস। তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য আগে ভাগে আব্বাই ঘুম থেকে উঠেন। তারপর ডাকেন আম্মাকে। বরাবরের মতো সেদিনও যখন আম্মাকে ডাকলেন আব্বা আম্মা সাড়া দিলেন না।শরীরে ঝাঁকুনি দিলেন কিন্তু কোন সাড়া মিললো না। অবশেষে প্রচন্ড ভয় নিয়ে যখন আব্বা কান পেতে আম্মার শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করলেন তখন বুঝতে পারলেন এই ইহ জগত ছেড়ে আম্মা চলে গেছেন অন্য একটি জগতে।
বুঝতে পেরে আব্বা সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠেননি কিংবা আর্তনাদ করেননি। অতি নিকটে বাজ পড়ার কারণে আতঙ্কিত মানুষেরা যেভাবে স্হবির হয়ে থাকে খানিক সময়ের জন্য ঠিক তেমন ভাবেই স্হবির হয়ে রইলেন আব্বা। তারপর কেঁদে উঠলেন মেয়ে মানুষদের মতো চিৎকার করে।তার কান্নার শব্দে চমকে উঠে আমি জেগে উঠি। আমার তিন মাসের বোনটি তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে চিৎকার করে হাত পা নাড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ আগের নিরব নিস্তব্ধ বাড়িটি মুহুর্তে কান্না বাড়ি হয়ে উঠে। আম্মার মৃত্যুর পরদিন থেকেই আব্বা তার বিপদ টের পান। মা ছাড়া কী করে একটি তিন মাসের বাচ্চা লালন -পালন করা সম্ভব! সম্ভব হতো যদি বাড়িতে আন্য একজন মেয়ে মানুষ থাকতো। আমাদের নোহা গলা ছেড়ে কাঁদে।
কাঁদতে কাঁদতে তার গলা শুকিয়ে আসে।দুধ খেতে চায়। আব্বা তার মুখে ফিডার দেন। কিন্তু কাজ হয় না। এই জন্য নোহার রাগ আরো বাড়ে।সে তখন বিছানায় গড়াগড়ি খায়।হাত পা টান টান করে।ভাঙা গলায় যতটুকু বল পায় ততটুকু বল নিয়ে চিৎকার করে কাঁদে। আব্বা তখন জড়জড় করে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি ঘরের বেড়ায় হেলান দিয়ে মাটির উপর বসে পড়েন। আমি তাকিয়ে দেখি তার বিষন্ন মুখ খানা।তার দু চোখের নদী হওয়া।অথচ দুদিন আগেও কী হাসিখুশি মানুষটি ছিলেন আব্বা। আম্মার সাথে এতো কৌতুক করতেন দেখে আমার কী যে হাসি পেতো! আম্মার প্রতি এতো ভালোবাসা ছিল তার যার কারণে আম্মা বিরক্তি বোধ করতেন পর্যন্ত।অথচ এই মানুষটা আজ এভাবে ভেঙে পড়েছে! পাড়া পড়শী এবং আত্মীয় স্বজনেরা এসে তখন আব্বাকে ধরলো নতুন একটা বিয়ে করতে। বিয়ে করা ছাড়া তো আর উপায় নেই! আমাদের নোহাকে বাঁচাতে হলে তো আব্বার বিয়েই করতে হবে।
নোহা যে খুব ছোট শিশু। মাত্র তিন মাসের একটি শিশুর জন্য তো একজন মমতাময়ী মায়ের খুব প্রয়োজন। কিন্তু জন্মদাত্রী মা ছাড়া কী অন্য কোন মা আপন হয়!আপন মা ছাড়া তো আর কেউ সন্তানের জন্য মমতার চাদর বিছিয়ে দেয় না। এই জন্যই আব্বা বললেন,’বিয়ে আমি করতে পারবো না। আমার মেয়ের যদি হায়াত থাকে তবে সে এভাবেই বাঁচবে আর নাইলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ওকে আমি মা নামক কোন আজরাঈলের হাতে তুলে দিতে পারবো না।’ আব্বার এই কথা শুনে আমার এক দূর সম্পর্কের পরহেজগার দাদা বলে উঠলেন,’মতিন,এইটা তোমার ভুল ভাবনা বাপজান। তুমি এমন এক খোদার হুকুমের দাস যার হাতে তোমার আমার আর সব সৃষ্টির ভাগ্য খাতা। এই খাতায় তোমার ছোট্ট নোহার নামটিও আছে। ওইখানে যেভাবে লিখা এর থেকে এক চুল পরিমাণও তুমি আমি নিজের ইচ্ছেই হেরফের করতে পারবো না। মনে রেখো আল্লার ইচ্ছা সবচেয়ে বড় বিষয়। আরেকটা কথা হলো সব সৎ মায়েরাই অসৎ নয়।
তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা সত্যি সত্যি মমতাময়ী।আর যে মা মমতাময়ী সে শুধু তার একার সন্তানের জন্য মমতাময়ী নয়,সে সকল সন্তানের জন্যই মমতাময়ী।তার চোখের সামনে কোন শিশু সন্তান যখন কাঁদতে থাকে তখন তার মনে একটা প্রচন্ড রকম নাড়া দিয়ে যায়। মুহুর্তে মনে পড়ে যায় তখন তার নিজের সন্তানটির কথাও।’ আব্বা দাদাজানের এমন সুন্দর কথাগুলো শুনে রাজি হয়ে গেলেন নতুন একটি বিয়ে করার জন্য। তিনি বললেন,’চাচা,আমি কিছুই জানি না। আপনার উপর আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। আপনি আমার নোহার জন্য একটা মমতাময়ী মা এনে দিবেন।’ দাদাজান তখন মৃদু হেসে বললেন,’মতিন,বলো আল্লাহর উপর আমি ভরসা করেছি। আল্লাহ আমার নোহার জন্য একজন মমতাময়ী মায়ের ব্যবস্হা করে দিবেন।বাবা, ভুলে গেলে চলবে না মহান আল্লাহই সবকিছু করে দেন। তোমার আমার যত জরুরত আছে সব তিনিই পূরণ করে দেন।
বাবা, তোমার তো জানার কথা শিশু মূসা নবীর জন্য কীভাবে তিনি মমতাময়ী মায়ের ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন।আর শাদ্দাদের মায়ের মৃত্যুর পর বনের এক হিংস্র বাঘুনি কী করে তাকে মায়ের আদর দিয়েছিল!’ দাদাজানের কথা শেষ হলে আব্বা বললেন,’আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি। তিনি যা করেন তা অবশ্যই মঙ্গলময়।’ দাদাজান তখন আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’বাবা,সব ব্যবস্হা আল্লাহ করে দিবেন। তুমি আর অস্হির হয়ো না।সবর করো। মহান মালিক তো সবর করীদেরই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’আব্বা তখন আস্তে করে বললেন,’আল্লাহ আমার ধৈর্য্য বাড়িয়ে দিন।’ আমি  আব্বার প্রার্থনা শেষে মনে মনে পড়লাম,’আমিন। আমিন।আমিন।’ এর ঠিক তিনদিন পর আমাদের বাড়িতে সেই বুড়ো দাদাজান এসে উপস্থিত। এবার তিনি একা নন, সাথে একজন কালো বোরকা পরিহিতা মেয়ে।তারা দুজন এসে দাঁড়িয়েছেন উঠোনের মাঝামাঝি উঁচু জায়গাটায়। তারপর দাদাজান ওখান থেকেই আব্বাকে ডাকলেন।
আব্বা তখন বড় পেরেশান হয়ে আছেন নোহার কান্না ঠিক করতে না পারার জন্য। তবুও কোনমতে তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে আসলেন। এসে অবাক হয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এই সময় দাদাজান বললেন,’মতিন, তুমি বড় কাহিল হয়ে গেছো এই কদিনে! তোমার চেহারা ভেঙে গেছে। চোখের আলো কেমন নিভে গেছে। মহান পরওয়ার দেগার তোমাকে এই কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দিতে চান।’ আব্বা কোন কথা বললেন না। শুধু চোখ দুটো বড় করে তাকালেন দাদাজানের দিকে।দাদাজান তখন তার ডান পাশে দাড়িয়ে থাকা বোরকা পরিহিতা মেয়েটির দিকে ইশারা করে বললেন,’এই কুমারী মেয়েটি তার জীবনকে কুরবান করে দিতে চায়। সে চায় দুজন এতিমের মা হতে। তুমি কী তার চেহারা দেখবে?’ আব্বা বললেন,’এ আমার সৌভাগ্য। চেহারা দেখার প্রয়োজন নাই। আমি রাজি।’
দাদাজান তখন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,’মতিন, তুমি অন্ধ নয়, এবং আমাদের শরীয়াতও অন্ধকার নয়। বিয়ের আগে অবশ্যই পাত্র পাত্রীকে দেখে পছন্দ করবে এবং পাত্রীও পাত্রকে দেখে পছন্দ করবে। ইসলাম জোর জবরদস্তির কোন ধর্ম নয়।’ আব্বা তখন অস্হির হয়ে বললেন,’আমি তাকে দেখতে চাই চাচাজান।’ দাদাজান তখন বললেন,’মা , তোমার মুখ খুলো।’ দাদাজানের কথার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি তার মুখ খুললো। আব্বা সেদিকে চাতকের মতো তাকিয়ে রইলেন।আর আমিও অবাক হয়ে ভাবছি, পৃথিবীতেও কী অত সুন্দর মানুষ থাকে! চাচাজান আব্বাকে বললেন,’পছন্দ হয়েছে তোমার?’ আব্বা তড়িৎ উত্তর দিলেন,’মাশাআল্লাহ। আমার পছন্দ হয়েছে। এখন ইনার যদি পছন্দ হয়।’
দাদাজান তখন মোলায়েম হেসে বললেন,’তার পছন্দ আগে থেকেই। আমি তো বলেছিই,সে কুরবান হতে এসেছে।’ তারপর দাদাজান বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন দুজন সাক্ষী জোগাড় করতে। দাদাজান তখন প্রায় বাড়ির দেউঠি পর্যন্ত এগিয়েছে এই সময় আমাদের হবু মা বললেন,’আপনি তো আপনার চাচাজানের কাছে জানতে চাইলেন না তিনি যে একজন কুমারী মেয়েকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে নিয়ে এসেছেন তার পিতার পরিচয় কী? পিতার পরিচয় জানা কী আপনার কর্তব্য নয়?’ আব্বা তার কথায় খানিক লজ্জাবনত হয়েই উঁচু গলায় ডাকলেন,’চাচাজান,ইনার পরিচয় কী, তার বাবার সম্পর্কে কিছু জানালেন না তো আমায়?’
দাদাজান ওখান থেকেই উঁচু গলায় বললেন,’এই মহিয়সি নারী আমার মতো পাপিষ্ঠের ঔরসজাত সন্তান।’ দাদাজানের কথা শুনে আব্বা কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমিও মুহূর্তে কেমন বোকা বনে গেলাম। আমি আব্বার মুখের দিকে আর আব্বা আমার মুখের দিকে একে অপরের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। আমাদের দুজনের চোখে জল চিকচিক করছে। এই সময় আমাদের হবু মা বললেন,’আপনাদের চেয়ে আমি বেশি খুশি হয়েছি। আমার কী সৌভাগ্য দেখেন,দু দুটো এতিম সন্তানের জননী আমি!’
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত