রাত একটায় মেয়েটি ফোন করলো। মধ্যপ্রাচ্যে একটা মানে বাংলাদেশে রাত চারটা। এত রাতে হুট করে কারো ফোন আসাটা কিছুটা অস্বাভাবিক। তারপর যদি হয় একটি মেয়ে। যদি রুমে থাকতাম তাহলে ফোন রিসিভ করা সম্ভব হতো না। আমি বাইরে বসে কানে হেডফোন গুজে দিয়ে গান শুনছি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চাঁদ একবার মেঘের আড়ালে লুকায় আবার ক্ষানিক বাদে উঁকি দেয়। মোটামোটি দুঃখ বিলাস বেশ জমে উঠেছে। এরই মধ্যে মেয়েটির ফোন পেয়ে ভাবে থাকা জগত থেকে ফিরে এসে রিসিভ করতেই মেয়েটি বলল, “আমি জানি আপনি রাত জাগেন। সেজন্যই ফোন করেছি। বিনা অনুমতিতে ফোন করার অপরাধটুকু ক্ষমা করতে পারবেন আমি জানি। আর যদি বেশি বিরক্ত করে থাকি একটু বকা দিয়ে রেখে দিতে পারেন।” আমার কী বলা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। মেয়েটি নিশ্চয় পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই ফোন করেছে। কথা বলায় কোনো জড়তা নেই। আমি মেয়েটিকে বললাম, ফোন করার কারণটি বলুন।
-কারণ বলার আগে আপনাকে ভাইয়া ডেকে নেই। ভাইয়া, মধ্য রাতে ফোন দেয়াতে ভাববেন না আমি আপনাকে পটাতে চাচ্ছি। সেজন্য ভাইয়া ডেকে বিষয়টি পরিষ্কার করে নিলাম। খেয়াল করলে দেখবেন আমার লিস্টে সতেরো জন ফ্রেন্ড আছে শুধু। তার মধ্যে আপনি একজন। আমার মনে হচ্ছিল আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে আমার ঘুম আসবে। এত রাত অবধি আমি ঘুমাইনি।
-আমি ঘুমের ঔষধ হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম কবে থেকে?
-ভাইয়া, এখন একটু সিরিয়াস হই।
একটা সময় রাত জেগে কথা বলার অভ্যেস ছিল। যার সাথে কথা বলতাম সে হারিয়ে গেছে। কিন্তু অভ্যেসটা পরিবর্তন হয়নি বলেই রাত জাগতে হয়। আমার লিস্টের সতেরো জন থেকে আপনিই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি এখনো জেগে আছেন। তাই মনে হলো আপনার সাথে একটু কথা বলি। তারপর ঘুম চলে আসবে। কত রাত কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি হিসেব নেই। মেয়েটির মতলব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কথা বলার ধরণ কবি সাহিত্যিকদের মতো। একটু রহস্য করে কথা বলছে মনে হচ্ছে। আমি বললাম, যার সাথে রাত জেগে কথা বলার অভ্যেস ছিল সে ছিল প্রিয়জন। আমি অপরিচিত, আমার সাথে কথা বলে ঘুম আসবে?
-ঘুম না আসলেও হয়তো কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবো।
-কেমন প্রশ্ন?
-আপনারা যারা লেখালেখি করেন তাদের কল্পনার জগত অনেক বড়।
আমার জগতটা ছোট। আমার ছোট জগতে প্রশ্ন আছে। উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আপনার বড় জগতে উত্তরগুলো থাকতে পারে। আমার খুব জানবার ইচ্ছে। আমার কাছেও কিছু উত্তর আছে। তবে নিজের উত্তরের ভরসা পাচ্ছি না। আপনার উত্তরের সাথে মিলিয়ে দেখব। টুক টাক দুই চার লাইন লিখি। কিন্তু যে জগত, প্রশ্ন, এসব বলছে। মনে হচ্ছে আমার প্রশ্নের জবাবই তার জগতে খুঁজতে হবে। আমি বললাম, এখনো আপনার নাম জানি না। নামটি বলে প্রশ্ন করুন। দেখি আমার জগতে সেই প্রশ্নের উত্তরের কতটুকু বিচরণ।
-আমার নাম অণু। মানুষ প্রেমে পড়লে বোকা হয় কেন?
-মূলত প্রেমটাই বোকামি। প্রেমের কারণ খুঁজতে যাওয়াটাও বোকামি। যার প্রেম যত গভীর সে ততো বড় বোকা। তার বোকামির পরিমাণও বেশি।
-আপনার উত্তরের সাথে আমার উত্তরের মিল নেই।
-আপনার উত্তরটা কী?
-আমরা সবাই বোকা।
আমাদের সবার ভিতরে একটা ছোট মানুষ থাকে। আমরা প্রায়ই ছেলেমানুষী করতে গিয়েও চক্ষুলজ্জায় করা হয় না। কিন্তু যার প্রেমে পড়া যায় তাকে খুব, খুব আপন মনে হয়। কেন যেন মনে হয় সে আমার জীবনের একটা অংশ। আমার ছেলেমানুষী তার কাছে পশ্রয় পাবে। তার কাছে আমার বোকামিগুলো আমার লজ্জা নয় আমার সরলতা। আর বিশ্বাস জন্মাবে যার প্রেমে পড়েছি যাকে ভালোবেসেছি সে আমার এই সরলতাকেও ভালোবাসবে। আগেই মনে মনে ভাবছিলাম যে, আমার উত্তরই মেয়েটির কাছে খুঁজতে হবে। এরই মধ্যে মেয়েটি আবার বলল, আচ্ছা দ্বিতীয় প্রশ্নঃ ভালোবাসার মানুষটি রাত জেগে কাঁদছে, অথচ তার চোখে এত ঘুম আসে কীভাবে? এই প্রশ্নটি যে মেয়েটির জীবন থেকে নেয়া সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু কী উত্তর দেয়া যায় সেটা ভেবে কূল পাচ্ছি না। আমার উত্তর যে তার মন মতো হবে না সেটা বুঝে ফেলেছি। তবুও বললাম, সে হয়তো সবকিছু ভুলে গেছে। এজন্য সে ঘুমাতে পারে।
-এবারের উত্তরটা কাছাকাছি। প্রেম ভালোবাসা একটা সময় অভ্যাসে পরিণত হয়। প্রতিনিয়ত মনে হয় ভালোবাসা কম হচ্ছে, আরো বেশি ভালোবাসা প্রয়োজন। সেই ভালোবাসার অভ্যাসে হঠাৎ কেউ ব্যাঘাত ঘটালে বা বিচ্ছেদ হলে প্রথম কয়েকটা দিন দু’জনের কেউ ঘুমাতে পারে না। তবে যে মানুষটা যত দ্রুত অভ্যেস পরিবর্তন করতে পারে সেই মানুষটাই ঘুমাতে পারে। আমার অভ্যেসটা ইচ্ছে করেই পরিবর্তন করি না। আমার কেন যেন মনে হয় আমার ভালোবাসা ফুরায়নি। আমি তাকে আরো ভালোবাসব। দু’জনেই ক্ষানিক্ষণ চুপ করে রইলাম। মেয়েটি হয়তো তার বিরহে চুপ আমি পরবর্তী প্রশ্নের ভয়ে চুপ। মেয়েটি বলল, ভাইয়া আমি যদি কয়েকদিন পরপর আপনাকে কয়েক মিনিটের জন্য ফোন করি আপনি রাগ করবেন?
-না, তবে ফোন দেয়ার আগে একটি মেসেজ করলে ভালো হয়। কারণ আমি রুমে থাকলে ফোন রিসিভ করতে সমস্যা হবে। আমি একা থাকি না।
-ঠিক আছে, তবে প্রতিবারই তিনটি প্রশ্ন নিয়ে ফোন করব। আমার আজকের শেষ প্রশ্ন এখনো বাকি।
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম শেষে সেটাই হলো। এখনো এক প্রশ্ন বাকি, আর প্রতিবারই অণু তিনটি করে প্রশ্ন নিয়ে আসার কথা বলছে। অণু মেয়েটির প্রশ্ন উত্তরের কোনো সাধারণ জ্ঞান বই থাকলে ভালো হতো। আমি বই পড়ে উত্তর দিতে পারতাম। বাংলাদেশে ফজরের আজান হচ্ছে। অণুর মোবাইল দিয়ে আমার এখানে শোনা যাচ্ছে। দু’জনেই চুপ করে আছি। মনে মনে ভাবছি এবারের প্রশ্নটা কী করতে পারে?
-নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলতে কী বুঝেন?
-যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ থাকবে না। সেটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
-না, আপনি ভালোবাসলে আপনি চাইবেন সেও আপনাকে ভালোবাসুক।
আপনারা একে অপরকে আপন করে যেন পেতে চাইবেন। কারণ প্রেম ভালোবাসার মিলন না হলে ভালোবাসবেন? কিন্তু তবুও বাসা যায়। তাকে পাবেন না জেনেও যদি তাকে ভালোবাসেন। সে চিরদিনের জন্য অন্যের হয়ে গেছে, সারা জীবনের জন্য হারিয়ে গেছে জেনেও যদি ভালোবাসা যায় সেটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সে আমার হবে না জেনেও হাতের উপর এক কাত হয়ে মাথা রেখে চোখ বুজে কল্পনা করি। তার চেহারা অবলোকন করি। স্বপ্ন সাজাই, ভালোবাসি সেই আগের মতো করে।
-এই যে স্বপ্ন দেখা, এটা স্বার্থ না?
-আরে মশাই আগেই বলেছি হারিয়ে ফেলেছেন জেনেও ভালোবাসেন যদি। তাহলে সে স্বপ্নটাও যে সত্যি হবে না সেটা জেনেই স্বপ্ন দেখি। আর সেটাই আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমি হঠাৎ করে একদিন আসব তিনটি করে প্রশ্ন নিয়ে। আর আমার ভালোবাসার কথাও বলব একটু করে।
-আজ তো একটুও বললেন না আপনার ভালোবাসার কথা।
-এই যে বললাম। তাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়েছি। চিরদিনের জন্য সে অন্যের হয়ে গেছে। তবুও আজও তাকেই ভালোবাসি। সে বিয়ে করেছে দুই মাস আগে। নিজে ইচ্ছে করে নয়, অনেকটা বাধ্য হয়েই করেছে। কিন্তু কয়েকটা বাড়ি পরেই তার বাড়ি তো। ঘরের কোণে সারাক্ষণ তো বসে থাকা যায় না। দেখা হয়ে যায়। আর ভালো থাকি না আমি, তবুও ভালোবাসি।
-সে বাসে না আর?
-আরেকদিন বলব ভাইয়া।
আজ আসি, মা ঘুম থেকে উঠবে। মা উঠার আগেই আমাকে গভীর ঘুমের ভান করতে হবে। ভালো থাকবেন ভাইয়া। ফোন কেটে যাওয়ায় হেডফোনে আবারো গান বেজে চলেছে। চাঁদটাও মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে আগের মতোই। এখন শুধু হাতে একটা সিগারেট হলেই দুঃখ বিলাস বেশ জমে উঠবে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক