ষোলো বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম তারা দুজন আলাদা থাকছে। আলাদা বিছানা, আলাদা কামরা। একজন আরেকজনের চেহারাও দেখছে না সপ্তাহখানেক ধরে। মাঝ রাতে ঘুমের মাঝে হাতটা বিছানার বাম পাশে পড়তেই খালি খালি লাগলো। অবচেতন মন মস্তিষ্কে একটা তীব্র ব্যথার অনুভূতি পাঠিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলো শিহাবকে। চোখ খুলেই তার মনে হলো হঠাৎ করে কতটা নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে সে। অনেক চেষ্টায় ঘুমটা এসেছিলো।আকস্মিক ভেঙে গেলো। এভাবে ঘুম ভাঙলে রেনুকে জড়িয়ে ধরতো শিহাব। নিকষ কালো আঁধারের রাতে শূণ্য বুকটা নিমিষেই পূর্ণ হয়ে উঠতো। আর আজ পাশের কামরায় রেনু, তাও মনে হচ্ছে কত দূরে। রেনুকে জাপটে ধরার জন্য মনটা ছটফট করছে কিন্তু মাঝে অদ্ভুত, অজানা এক বাধা।
তার মনে পড়ে বিয়ের পরপরই রেনু বাবার বাড়ি চলে যায় ওর বাবার অসুস্থতার জন্য। শিহাবের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো নতুন বউয়ের কাছে ছুটে যেতে, কিন্তু চক্ষুলজ্জার জন্য পারছিলো না। নতুন বউয়ের চাঁদপানা মুখ দেখতে একদিন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রেনুর ঘরের জানালায় আঘাত করেছিলো সন্তর্পণে। আস্তে করে ডেকেছিলো “বউ” বলে। ওপাশ থেকে জানালা খোলার আওয়াজ আসতেই এপাশ থেকে কে যেন তাকে জড়িয়ে ধরে “চোর…চোর…” বলে চেঁচাতে লাগলো। ঘরের সবাই উঠে চলে আসলো। লাইট জালিয়ে দেখলো, “এ যে তাদের নতুন জামাই…!” সে কি কেলেংকারী! লজ্জায় রেনু মাথা নিচু করে ছিলো। নতুন বউকে দেখে শিহাব ভুলে গেলো লজ্জা-শরম! আলো ছায়ায় নতুন বউয়ের মুখটা কি অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিলো। তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এখনো সে কথা মনে করিয়ে তাকে লজ্জা দেয়। সেই থেকেই সবাই জানে শিহাব বউ পাগলা।
অথচ গত একটা সপ্তাহ সে আছে রেনুকে ছাড়া। রেনুর স্পর্শ ছাড়া। এক সপ্তাহ? কত সময়? সাত দিন। ১৬৮ ঘন্টা। দশ হাজার আশি মিনিট। সেকেন্ডের হিসেবে নাহয় নাই গেলো সে। গত এক সপ্তাহ সে খেয়েছে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্য। বিয়ের পর এতগুলো দিন রেনুর হাতের রান্না ছাড়া খেতো না শিহাব৷ বিয়ের পর রেনু যখন প্রথম এ ঘরে আসে রান্নাবান্না কিছুই জানতো না সে। আস্তে আস্তে হাত পুড়িয়ে, তারকারি পুড়িয়ে রান্না শিখলো সে৷ সেই পুড়ে যাওয়া তরকারি থেকে শুরু করে রেনুর হাতের অদ্ভুত মজার রান্না…সবই চেটেপুটে খেয়েছে সে।
গত সাতটা দিন সে রেনুর হাতের খাবার খাচ্ছে না। যেটা শুধু খাবারই ছিলো না, ছিলো রেনুর ভালোবাসা, ওর হাতের স্পর্শ। ষোলো বছর সংসার করতে করতে রেনু শিহাবের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। আলাদা করে বহুদিন তারা বলেনি ভালোবাসি। কিন্তু তাদের ভালোবাসা জড়িয়ে ছিলো তাদের প্রতিদিনকার প্রতিটি কাজে। অথচ আজ শিহাবের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে “খুব ভালোবাসি রেনু” যা এই বয়সে বড্ড বেমানান।
নিজের মনের সাথে হাজারবার যুদ্ধ করে আস্তে আস্তে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে রেনুর রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো শিহাব। খুবই সন্তর্পণে দরজায় আঘাত করে মৃদুস্বরে ডাকলো “বউ…” ঠিক ষোলো বছর আগেকার মত। কিন্তু ওপাশ থেকে দরজা খোলার কোনো আওয়াজ পাওয়া গেলো না। শুধু শোনা গেলো বুক হাহাকার করা এক নিঃসঙ্গ রমণীর কান্না।
মধ্য রাতে কান্নার শব্দে ঘুম ভেংগে গেলো শিলার। রুমের দরজা খুলে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলো। তার বাবা তার মায়ের রুমের দরজা আঁকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদছে আর বউ বউ বলে ডাকছে। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে তার করোনা আক্রান্ত মায়ের হৃদয় ভাঙা কান্নার আওয়াজ। নিঃশব্দে দু চোখ ভরে জল উপচে পড়লো তার। দরজাটা আবার লাগিয়ে দিলো সে। কাঁদুক দুজন। হালকা করে নিক দুজনকে। গুমোট এই রাতে তাদের কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে উঠলো নগরী।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক