১) “এই যে,নাও!” বলেই সুজানা আবীরের হাতে একটুকরা কাগজ ধরিয়ে দিল। আবীর বরাবরই মাঝারী স্বভাবের ছেলে। খুব বেশী সাহসী যেমন নয়,তেমনি ভীতু ও নয়। তবু সুজানা নামক এই অদ্ভুত সুন্দরী,ঝাড়িবাজ মেয়েটার সামনে আসলে ওর হাঁটুদ্বয় জোর পায়না। নিয়ণ্ত্রনহীন ঐচ্ছিক পেশী বনে যায়। আর বারবার পেছন ফিরে দৌড় প্রতিযোগীতায় নামার ইচ্ছে পোষণ করে!
“এটা… কী?” প্রশ্নটা শুনে, সুজানা ভ্রু একটা তুলে তাকায়। আর আবীর আরও বেশী কুঁকড়ে যায়। “খুলে পড়ে দেখো, কী! জোরে জোরে পড়বা কিন্তু! নইলে….” “নইলে….?” আবীর প্রায় শোনা যায়না,এভাবে জানতে চাইল। “হাঁটুর মালাই চাকতি দুটোই খুলে গলায় ঝুলিয়ে দিব। কই পড়ো!” আবীর ধমক খেয়ে কাগজটা মেলে ধরল। সুপারস্টোরগুলোতে কেনাকাটা করতে গেলে,বিলটা যেমন লম্বাটে কাগজে দেয়া হয়,এই কাগজটা ঠিক তেমনই। পার্থক্য এটুকুই,এটা ওগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ লম্বা।
“আমার হবু স্বামীর প্রতি, বিবাহ পরবর্তী দায়িত্বসমূহঃ ….” আবীর সুজানার কথামত শব্দ করে পড়তে লাগল। “দায়িত্ব নং ১ – সকালে নয়টার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার অভ্যেস নেই আমার। আর ওঠা মাত্রই বেড টীর গন্ধ নেয়ার অভ্যেস। তার ব্যবস্থা যেন থাকে।
দায়িত্ব নং ২- আমি অতিঅবশ্যই কাজ করব,কিন্তু আমি একটা কাজ করলে স্বামী মহোদয়ের করতে হবে তিনটা কাজ…”
আবীর আরও পড়তে যাচ্ছিল। সুজানা ই তাকে থামালো। “হয়েছে,থামেন। বুঝছি,আপনি যে পড়তেপারেন। বাকিটুকু বাসায় গিয়ে পড়লেই চলবে। পরশুর আগে যাতে এগুলো ঠোঁটস্থ হয়। নইলে দ্য প্রবলেম হ্যাজ। আর এই লিস্টটা পরশু রাতে এইভাবেই আমাকে ফেরত দিতে হবে। নইলে…” “নইলে….?” আবীরের গলারস্বর আগের চেয়েও মৃদু। জবাবে সুজানা আঙ্গুল দিয়ে গলার নীচে পোঁচ দেয়ার ইশারা করল।
(২) সুজানার একগাদা রাগ হচ্ছে।সেই কখন থেকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে সং সেজে বসে আছে ও! আবীরের দেখা নেই। মনে মনে নিজেকে একশ একটা লাথি কষায় সে। এরকম একটা বুদ্ধুকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল বলে। সবিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে একটা আপেল আর ফ্রুট কাটার ছুরিটা তুলে নেয় সুজানা। সময় কাটাতে আপেলের গায়ে নকশা আঁকতে থাকে।
(৩) আবীর অনেক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। সুজানা যে ঘরে বসে আছে,তার দরজায়।হাতে স্বামীর দায়িত্বসমূহ সম্বলিত কাগজ। এটা সুজানার দেয়া লিস্টটার নকল। আবীর কোন ঝুঁকিতে যেতে চায়নি। সেদিনই বাসায় ফিরে লিস্টটায় নকল বের করে নিয়েছিল। মূলকপি আছে ঘরের ভেতর,সযত্নে ভাঁজ করে রাখা। আবীর কিছুক্ষণ সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর কাগজটা পকেটে রেখে,লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিল। দরজা আলতো করে ঠেলে ভেতরে পা বাড়াল। মাথার ভেতর তখন জানা-অজানা সূরা,দোআ-দরুদ আর দায়িত্বসমূহ আওড়ানো চলছে।
(৪) আবীরকে দেখে সুজানা হাতের ছুরি নাচিয়ে বসতে ইশারা করল। আবীরের পা-জোড়া আবার অনৈচ্ছিক পেশীর রুপ নিতে লাগল,নববধূর ভঙ্গীমায়। “দায়িত্ব প্রথমটা বল।” “দায়িত্ব নং ১- সকালে নয়টার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার অভ্যেস নেই….” সুজানাকে ভ্রু তুলে তাকাতে দেখে,আবীর ভড়কে থেমে যায়।
“মিথ্যা বলতেছো কেন? আমি এত ফালতু কথা লিখতে পারি? লিস্ট আমার দেয়াটা খুলে দেখো!” আবীর সাইড টেবিল থেকে ভাঁজ করা কাগজটা তুলে নিল। মাথার ভেতর সূরা,দোআ-দরুদ আর কর্তব্য সব ততক্ষণে জট পাকিয়ে একাকার। আবীর কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে লাগল।
“আমার স্বামীর প্তি, বিবাহ পরবর্তী দায়িত্বসমূহঃ দায়িত্ব নং ১- আমার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস। সূর্যের প্রথম আলো ছুঁয়ে দিয়ে বিড়বিড় করি, “বিয়ের পর বুদ্ধু বালকটার কাঁধে মাথা রেখে প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখব আমি। ” তার ব্যবস্থা যেন থাকে!”
আবীর অবাক চোখে সুজানার দিকে তাকাল। মেয়েটাকে কেমন যেন আদুরে লাগছে। কিছুক্ষণ আগের সেই খুনে ভঙ্গীমা নেই এখন। সুজানা ছোটখাটো একটা হাই তুলে বলল, “পনেরো নংটা আওড়াওতো একবার!”
“দায়িত্ব নং ১৫- আমার জ্যোছনা অসম্ভব ভাল লাগে। কিন্তু কখনও জ্যোছনা পোহানো হয়নি। ঠিক করে রেখেছি,বুদ্ধু বালকের সাথে প্রথম জ্যোছনা পোহাব। বুদ্ধুটা আমাকে “চন্দ্রমানবী” ডাকবে। অবশ্য মনে মনে। আর তা টের পেয়ে আমি বলব, “এ্যাই ভীতুর ডিম,এত্ত ভয় পাও কেন? আবেগ কখনও লুকিয়ে রাখতে নেই। কী হয়,ভালবাসি- বলে ফেললে?”” আবীর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সুজানা তখন উদাস ভঙ্গীতে জানালার বাইরে তাকিয়ে।
(৫) আজ বোধহয় পূর্ণীমা। চারপাশ চাঁদের আলোয় যেন ভেসে যাচ্ছে। সুজানা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে,আর দু’হাত দিয়ে জ্যোছনা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। পেছন থেকে আবীর তাকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “ভীষণ ভালবাসি,চন্দ্রমানবী!”
সুজানার চোখে জল জমছে। বুদ্ধু বালক এত্ত সাহসী হলো কীকরে হঠাৎ???