‘শোনো রায়হান আমি তোমাকে এর আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমার একটা নিজের আলাদা সংসার চাই। আমি এরকম আর থাকতে পারবো না।’ ‘মোহনা আস্তে বলো। ও ঘরে মা আছে, শুনতে পাবে তো। আর কেন তোমার বারবার মনে হয় এই সংসারটা তোমার নিজের নয়?’ ‘মা শুনলে শুনুক। আমার কিছু আসে যায় না। আর তোমাকে আমি বহুবার বলেছি যে সংসারে শ্বাশুড়ি থাকে সে সংসার কোনোদিন বউমার হয় না।’
‘মা তো কখনও তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দেন না। বরং তুমি যেভাবে বলো মা তাই করেন। তাহলে কি সমস্যা?’
মোহনা এবার নরম স্বরে বললো, ‘মা কিছু বলেন না, তাই বলে কখনও যে বলবেন না তা নয় কিন্তু! আর সব সম্পর্কে একটু দূরত্ব বজায় রাখলে সেটা ভালো থাকে। চলোনা আমরা আলাদা বাসা নিই। এই বাসায় মা থাকবে, কাজের খালাকেও রেখে যাবো। দরকার হলে আরও একটা মেয়েকে রেখে দিব। মায়ের সমস্যা হবে না। মা ভালো থাকবেন।’
নত স্বরে রায়হান জবাব দেয়, ‘এত বছর পরে এসে আলাদা হবো এভাবে মা’কে একা রেখে, আত্মীয় স্বজন কি বলবেন! তারপর পাড়াপ্রতিবেশিও বা কি ভাববে! আর তাছাড়া মা অনেক কষ্ট পাবেন।’ ‘এত বছর তো আমরা মায়ের সঙ্গেই ছিলাম, এখন আলাদা হচ্ছি। এমন তো নয় যে বিয়ের পরই আলাদা হয়ে গেছি, তাহলে নাহয় আত্মীয় স্বজনরা নানান কথা তুলতো। তাছাড়া লোকজন এমনিতেও সবকিছুতে কথা বলবে এটা স্বাভাবিক। আর তুমি মাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। তিনি মোটেও অমত করবেন না। বরং খুশিই হবেন, তিনিও এখন থেকে এ বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন নিজের মত করে।’
রায়হান আর বউমার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো আমার রুম থেকে। ওরা বেশ জোরেই কথা বলছিলো। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চুপচাপ বেলকনিতে দাঁড়ালাম। রায়হানের বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে আজ। সবসময়ই মনে পড়ে, আজ একটু বেশিই মনে পড়ছে। মন খারাপ হলে প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে বেশি, এটাই যেন নিয়ম। চশমাটা খুলে চোখের কোণে জমে ওঠা পানিগুলো মুছে নিয়ে চশমাটা শাড়ির আঁচল দিয়ে একবার মুছে নিলাম। চশমাটা চোখে চেপে দিতেই অয়ন এসে পিছন থেকে জাপটে ধরলো। আমি হেসে উঠে পিছন ঘুরে অয়নকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে দাদুভাই?’ অয়নের মুখটা শুঁকনো লাগছে। গোমড়া মুখ করে বললো, ‘জানো দিদা মা বলেছে কাল থেকে এই স্কুলে না যেতে। আমরা নাকি এ বাসায় আর থাকবো না। নতুন বাসায় যাবো, সেজ খালামনির বাসার ওখানে। সেজ খালামনির ছেলে সাইফের স্কুলে নাকি আগামীকাল আমাকে ভর্তি করিয়ে দিবে।’
তাহলে আগে থেকেই বউমা সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। আসলেই এবার তাহলে আর ওরা এখানে থাকছে না। ভাবতেই বুকের ভেতরটাতে কেমন যেটা একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। অয়ন আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘দাদুভাই ওই স্কুলটা অনেক ভালো। তোমার নতুন অনেক বন্ধু হবে, নতুন বাসায় তুমি সারাদিন খেলাধুলা করবে, সাইফদের বাসায় বেড়াতে যাবে, দেখবে তোমার অনেক ভালো লাগবে।’ হাসি দিয়ে বললো, ‘তুমি যখন বলেছো তাহলে আর মন খারাপ করবো না।’ অয়ন আমার কথা খুব বিশ্বাস করে। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। অয়ন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দিদা তুমি যাবে না আমাদের সাথে?’
অয়নের প্রশ্নটা আমার ভেতরে দীর্ঘশ্বাসের জোয়ার বইয়ে দিলো, আমি তাদের থামিয়ে দিলাম। আমি অয়নের কথার জবাব দিবো এমন সময় রায়হান চলে এলো। রায়হান এসেই অয়নকে ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলো। তারপর চুপচাপ বসলো আমার পাশে। ছোটবেলা থেকেই রায়হানটা এমন। ওর যখনই কিছু বলার থাকে, ও চুপচাপ এসে আমার পাশে বসে। আমি জিজ্ঞেস করলে তারপর বলা শুরু করে। আজ এত বড় হয়েছে, কিন্তু এখনও সেই স্বভাবটা পরিবর্তন হয় নি। আমি রায়হানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলবি?’ রায়হান মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ’ আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘বলে ফেল। মায়ের কাছে বলতে এত সংশয় থাকলে হয়! বড় হয়েছিস তো, এখনও ছোট বেলার মত করলে বড় আর কবে হবি!’ রায়হান নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘মা, মোহনা নতুন বাসা দেখেছে নারায়ণগঞ্জে। ওর সেজ বোনের বাসার পাশেই। ও জেদ ধরেছে ওর বোনের কাছাকাছি থাকবে বলে। অয়নকেও ওখানের একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হবে।’
রায়হান এগুলো আমায় বলবে আমি জানতাম। আমি আবার মুচকি হাসলাম। রায়হানের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মাথা এখনও নিচু। রায়হানের এই স্বভাবটাও ছোট বেলার। যে কাজগুলো বা কথাগুলো ওর কাছে সঠিক মনে হয় না কিংবা ওর সংশয় থাকে, সে কথাগুলো ও মাথা নিচু করেই বলে। আমার চোখে চোখ রেখে সে কথা বলতে পারেনা।
‘শোন এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। বউমা আলাদা থাকতে চাচ্ছে এটা দোষের নয়, সব মেয়েরাই চায় তাদের নিজেদের একটা আলাদা সংসার হোক। যেটা সে একদম নিজের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি থাকলে তারা ওভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারে না। তাই একসময় আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে এত চিন্তার কিছু নেই।’
রায়হান আমার মুখের দিকে তাকায়। হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কষ্ট হবে না তো মা?’ আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘কষ্ট হবে কেন পাগল ছেলে! তোরা কি আর কোনোদিনও আসবি না এখানে! তোরা তো মাঝেমধ্যে আসবি, আমিও যাবো মাঝেমধ্যে ঘুরে আসবো। আর তাছাড়া তোর রেবেকা খালা তো আছে। কাজবাজ তো ও’ই সামলাবে। আমার সমস্যা হবে না।’ রায়হান চুপ করে বসে থাকে। কথা বলে না একটাও। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে বিছানায় বসতেই অয়ন এসে হাজির। ‘কি রে দাদুভাই কিছু বলবি?’ অয়ন আমার পাশে চেপে বসে। তারপর আস্তে করে বললো, ‘দিদা শোনো, মা বলেছে তুমি নাকি যাবেনা আমাদের সাথে। তুমি কি সত্যিই যাবে না?’
আমি ওকে টেনে সামনে বসালাম। তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দাদুভাই আমার এ বাড়ি ছেড়ে কোথায়ও থাকতে ভালো লাগেনা। তাই ভেবেছি আমি এ বাড়িতেই থাকবো। তবে আমার যখনই ইচ্ছে হবে আমি তোমাকে দেখতে তোমাদের বাসায় যাবো, আবার তোমার যখন আমাকে খুব মনে পড়বে তুমিও তোমার বাবা-মায়ের সাথে এখানে চলে আসবে। আমরা সবাই মিলে একে অন্যের বাসায় বেড়াবেড়ি করবো। কেমন? ‘ আমার কথায় অয়ন খুশি হয় না। নিরাশ মুখখানা চুপসানোই রয়ে যায়। কোলের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে বলে, ‘তোমায় ছাড়া আমার ওখানে থাকতে ভালো লাগবেনা দিদা’ আমি ওর মাথায় হাত বুলাই। সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ‘সাইফ আছে তো। ভালো লাগবে আস্তে আস্তে দাদুভাই। মন খারাপ করে না।’ রাতে খাওয়া শেষে বউমা আমার রুমে আসে। এসে দাঁড়িয়ে রইলো, আমি বসতে বললাম। তারপর বসে পড়লো। আজ সবকিছুতে সবাই যেন অনুমতিটা বেশি করে চাইছে। তাই নিজের থেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘কিছু বলবে বউমা?’
‘জ্বী মা।’
‘নারায়নগঞ্জে যাবে তাই বলবে তো? আমাকে যদিও বলেছে রায়হান। অয়নও বলেছে। তা কবে যাচ্ছো তোমরা?’
বউমা শান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়, ‘দুই একদিনেই মা। আপনার যে কোনো সমস্যা হলে আমায় সাথে সাথে ফোন দিবেন মা। আমি তো আপনার মেয়েই। আর আপনার যখন মন চাইবে চলে যাবেন আমাদের বাসায়। বলবেন আমাকে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। রেবেকা খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো আর অন্য একটা মেয়েকে রেখে যাবো। রেবেকা খালা চলে যাওয়ার পর ও’ই রাতে আপনার সব খেয়াল রাখবে। দারোয়ান চাচাকে আপনার ছেলে বলে দিয়েছে আপনার কোনোকিছু দরকার হলে সে যেন করে দেয়, আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আপনি তাকে বলবেন। আর আপনি আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না৷ সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে করবেন, নিজের খেয়ালও রাখবেন। আমরা আসবো সময় পেলেই এখানে।’
আমি হাসিমুখে জবাব দিলাম, ‘তোমরাও ভালো থেকো বউ মা। অয়নের দিকে একটু বেশি খেয়াল রেখো।’ ‘মা আপনি কষ্ট পান নি তো আমরা এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায়?’ ‘বোকা মেয়ে কষ্ট পাবো কেন। তোমরা দু’জনই তো আমার সন্তান। তোমাকে আমি কখনও পুত্রবধূর চোখে দেখিই নি। সেই যেদিন রায়হান তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তখন থেকেই নিজের মেয়ে না থাকার কষ্টটা যেন কমতে শুরু করলো। তারপর তোমাকে এ বাড়ির বউ না, আমার মেয়ে বানিয়েই নিয়ে এলাম। আর তোমরা তো এত বছর ছিলে আমার সঙ্গেই এ বাড়িতে। তোমরা সবসময় ভালো থাকো এটাই তো আমার চাওয়া। তা তোমরা সব গুছিয়ে নিয়েছো তো?’
হাসিমুখে উত্তর দেয় বউমা, ‘হ্যাঁ মা আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিচ্ছি।’ সে রাতে আর ঘুম হয় না। বুকের মধ্যে খা খা করে ওঠে এক শূণ্যতা। নিজেকে খুব একা লাগতে শুরু করে। ডুকরে কেঁদে উঠতে গিয়েও থেমে যাই, এতে না অকল্যাণ বয়ে আনি আমি ওদের জীবনে। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন সবসময় ওদের ভালো রাখে। দুই দিন পরেই ওরা চলে যায়। হাসিমুখে বিদায় দিয়ে বেলকনিতে দাঁড়াই। যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। অয়ন খুব কেঁদেছে যাওয়ার বেলায়। অনেক করে বুঝিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছি।
এই বাড়িটা এখন একদম খালি খালি লাগে। মাঝে মধ্যে ভুল করে অয়নকে ডেকে ফেলি, কখনও বা বউমাকে, রায়হান বলেও কখনও ডাক পাড়ি। পরক্ষণেই মনে পড়ে এরা তো কেউ নেই এখানে। খাবার টেবিলে অয়নের খামখেয়ালিপণা নেই, নেই অয়নকে খাওয়ানোর জন্য বউমার বকাঝকা করা শব্দ, রায়হানের বেছে খাওয়ার স্বভাবটাও খুব মনে পড়ে এখন। জোর করে কয়েক লোকমা মুখে তুলতেই পেট ভরে আসে, আর খেতে পারিনা। প্রার্থনা একটাই ওরা ভালো থাকুক। ওদের সাথে ফোনেই কথা হয় এখন। নতুন কাজের মেয়েটার নাম লিমা। সহজ সরল চেহারা কিন্তু ভেতরে খুব চালাক। বিয়ে হয়েছিলো একবার স্বামী নেশাখোর মারধর করে তাই ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন মানুষের বাসায় কাজ করে নিজের খরচ চালায়। মেয়েটা খুব আত্মবিশ্বাসী, সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। ওর এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে।
সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ততা বেড়ে চলে সবার। আমার সময় তবুও ভুল করেও ব্যস্ত হয়ে ওঠেনা। ওদের সাথে এখন অনেক কম কথা হয়। অয়নের সামনে পরিক্ষা, রায়হানের অফিসে কাজের প্রেশার খুব, বউমা অয়নকে নিয়ে সারাদিন স্কুল-কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। মাস দেড়েক আগে এসে একদিন থেকে গিয়েছিলো এখানে ওরা। দিন দিন বাড়িটাও যেন অসহায় হয়ে পড়ছে৷ রায়হানকে একবার বলেছিলাম অয়নকে নিয়ে ঘন্টা খানিকের জন্য ঘুরে যেতে। বললো সময় নেই। বউমা বললো সামনে পরিক্ষা এই মুহুর্তে বাসা থেকে বের হয়ে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব না। আমি আর কিছু বললাম না। চলমান সময় যেতে থাকে। রায়হান, বউমা আর অয়নের শূণ্যতা আমিও মেনে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। আগের মত অত বেশি মন খারাপ করার সুযোগ দেই না। রায়হানের বাবার ছবিটার সাথে রাতে কথা বলি একা একা৷ সেদিন ওরকম কথা বলছি ছবিটার দিকে চেয়ে এমন সময় লিমা এসে উপস্থিত।
‘খালা আফনে খালুজানরে খুব ভালোবাসেন তাই না?’ আমি হেসে ফেলে বলি, ‘হ্যাঁ। স্বামীকে ভালোবাসবো না তো আর কাকে বাসবো!’ ‘খালুজানও নিশ্চয়ই ভালো মানুষ, না হলে কি আফনে ছবির লগে কতা কইবেন!’ আমি হাসি জবাব দেই না। ও আবার বলে ওঠে, ‘আফনেও ম্যালা ভালো মানুষ। ভাইজান আর ভাবিজান ক্যান যে আফনেরে রাইখা গেলো আমি বুঝিনা! এই যুগে এমন শ্বাশুড়ি কয়জন পায়? আমার শ্বাশুড়ির কথা মনে হইলেই আমার রাগে ঘেন্নায় গা জ্বলে ওঠে। আর আফনে আফনার বউমারে কত আদর যত্ন করেন। আফনের বউমার কফালডা ম্যালা ভালো।’
আমি ওকে খানিকটা ধমকের সুরে বলি, ‘ওরাও আমাকে ভালেবাসে। ওদের প্রয়োজনেই ওরা ওখানটায় গিয়েছে। তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই তোর কাজ কর।’ এই মেয়েটার মত আমিও এখন একাকিত্বে ভুগি। তবে ওর আর আমার মাঝে ব্যবধান হলো ওর কেউ নেই বলে ও একা আর আমার কেউ থেকেও আমি একা। সেদিন রেবেকা রান্না ঘরে রান্না করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলো, ‘আপা বুঝছেন, দিন শেষে আমরা সবাই যে যার মত একা।’ কথাটা মনে ধরলো। আসলেই আমরা দিনশেষে সবাই যার যার মত একা। রায়হানের বাবা বলতেন, ‘জানো জামিলা, একদিন সবাই’ই একা হয়ে যায়। একদিন সবাই’ই একাকীত্বে ভোগে।’
এই একাকীত্বেই কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। হঠাৎ একদিন খবর এলো রায়হান সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমি পাগলের মত ছুটতে থাকি হাসপাতালে। কিন্তু গিয়ে শুনি রায়হান ততক্ষণে তার বাবার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ভেতরটা ভাঙচুর হলো, ক্ষত বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হলো। ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। সুস্থ হতে মাস দুয়েক লেগেছিলো। মা’কে ছেড়ে পরিবারের সাথে দূরে থাকা পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু সবাইকে ছেড়ে এতদূরে থাকাটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। রায়হানের পরিবারের সাথে দূরে চলে যাওয়ায় আমি কখনও দীর্ঘশ্বাস ছাড়িনি, ভুল করে কখনও ছেড়ে ফেললেও পরক্ষণেই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোআ করেছি। তিনি যেন আমার দীর্ঘশ্বাসে ওদের জীবনে কষ্ট না দিয়ে বসে, কামনা করেছি ওরা যেন ভালো থাকে। বউমার মুখের দিকে তাকানো যায় না এখন, রায়হান মারা যাওয়ার পরে মেয়েটার সব ধাকল সহ্য করতে গিয়ে বয়স যেন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। আমি বলেছিলাম এখানে এসে থাকতে, রাজি হয় নি। অয়নটাও বড় হয়ে গিয়েছে অনেক। আসে মাঝেমধ্যে আমায় দেখতে। ওর মধ্যে ভালোবাসা আছে ছোটবেলার মত, তবে অনুভূতিটা নেই আর তখনের মত।
শুনেছি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবে। গত কাল এসেছিলো ওর মায়ের সাথে এখানে। তখন নিশ্চিত হলাম সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে যাওয়ার। বউমার মুখটা মলিন হয়ে এলো, ছেলের এই খুশিতে খুশি হতে পারছেন না ভেতর থেকে। তারপরও মুখখানা হাসি হাসি করে রাখতে হয়। অয়ন চলে যাওয়ার পরে বউমা প্রায়ই এ বাড়িতে আসে। তারপর একসময় সিদ্ধান্ত নেয় এ বাড়িতেই থাকার। একদিন চলেও আসে। বাড়িতে এখন লোকসংখ্যা বাড়লেও একাকীত্ব কাটেনি।
একদিন বেলকনিতে বসে আছি তখন বউমা এসে পাশে বসে। কিছু না বলেই হাতটা চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
আমি তাকাতেই বললো, ‘মা আমি সেদিন বুঝিনি একাকীত্বের যন্ত্রণা কত ভয়ংকর হতে পারে।’ আমি বউমাকে সান্ত্বনা দেই। তারপর বলি, ‘দিন শেষে আমরা সবাই যে যার মত একা। জানো বউমা, একদিন সবাই’ই একা হয়ে যায়। একদিন সবাই’ই একাকীত্বে ভোগে।’ বউমা আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলাই। তারপর বললাম, ‘তবুও আমাদের ভালো থাকার প্রচেষ্টা চালাতে হয়, ভালো থাকতে হয়।’
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক