জন্ম নেওয়ার সময় সবাই নাকি মুখে সোনার চামুচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আমিও তেমনি কিন্তু আমি জন্মের সাথেই আমার নাম নির্ধারণ করা হয়েছে অপয়া কিন্তু বাবা আমাকে ভালোবেসে অন্তরা বলেই ডাকতো। আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে আমার মা পরলোক গমন করেন। মায়ের মমতা কেমন তা আমি জানিনা। বাবা আর দাদিমা মিলেই আমাকে আগলে রেখেছে।
বাবাকে সবাই বলে আরেকটা বিয়ে করতে তখনও বিয়ের মানে বুঝতে শিখিনী। আমার যখন ৬বছর বয়স তখন দাদিমা বাবাকে বলছে আরেকটা বিয়ে করতে। সবার মুখে শুনি বাবা বিয়ে করলে আমি একটা মা পাবো, তখন বায়না করতাম বাবার কাছে আমায় একটা মা এনে দিতে। কিন্তু তখনও বুঝতাম না সৎ মা সৎ মায়ে হয়। বাবার যেদিন ২য় বিয়ে সেদিন আমি নতুন মায়ের কাছে শুইতে গিয়েছিলাম বললাম মা আমি তোমার কাছে থাকবো। সেদিন গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলেছিলেন একদম নেকামি করবি না আমার সামনে দূর হ এখান থেকে। দাদিমা আমাকে আনতে এসে সবটা শুনে ফেলেন তাই কিছু না বলে আমাকে নিয়ে গিয়ে তার রুমে ঘুম পারিয়ে দিলেন।
সারাদিন নতুন মায়ের পিছে পিছে ঘুরতাম একটু মায়ের মমতা আদর ভালোবাসা পেতে কিন্তু কোনোদিনও একটু আদর ও করেনি মা। তবুও মা’কে খুব ভালোবাসতাম মা বলে তো ডাকতে পারছি এটাই বা কম কিসের। আস্তে আস্তে আমিও বড় হচ্ছি দশম শ্রেণিতে উঠলাম। আমার একটা ভাইও হয়েছে ৪বছর বয়স ওর। ওকে খুব আদর করে মা কিন্তু আমার বেলায় বরাবরই ছিল অনিহা। আমাকে কখনও মেয়ে হিসেবে মেনেই নিতে পারেননি। কয়েকদিন পর আমাদের গ্রামে একটা বড় গানের প্রতিযোগিতা হবে। আমার গানের উপর একটু নেশা আছে বরাবরই তাই আমিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করারা জন্য নাম দিলাম। আজ সেই দিন, নাম তো দিয়েছি কিন্তু কোনো প্রস্তুতি আমি নেইনি বললেই চলে।
অনেক ভেবে একটা গান বের করলাম এটাই গাইবো। কিছুক্ষণ পর আমার নাম এনাউন্সমেন্ট করলো, স্টেজে গিয়ে দারাতেই সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জজেরা বললো শুরু করো কি গাইবে আমি শুরু করলাম মা… মা… ওগো মা… তোমায় ছাড়া থাকতে পারিনা। মা… মা…ওগো মা… কোথায় আছো ফিরে আসো না। তোমার খুকি যে ডাকছে দু’হাত তুলে। তুমি কেমনে আছো আমায় ভুলে। তুমি আসবে কবে আমার কাছে,,, তোমায় দুচোখ খুজে আসেপাশে। কবে তুমি আসবে বলো মা..মা…মা… ওগো মা…তোমায় ছাড়া থাকতে পাড়িনা। গানটা গাইছি চোখ বয়ে পানি ঝড়ে পরছে। গান শেষ হতেই সবাই করতালি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রেজাল্টের পালা আমি হবো না তাই আর মঞ্চের সামনে গেলাম না দূরে দারিয়ে দেখছি। এনাউন্সমেন্ট করলো করবে মিতু আপু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলা শুরু করলো……
– তৃতীয় প্রতিযোগি মোঃ আবির ইসলাম।
দ্বিতীয় প্রতিযোগি নিশি পারভীন। আর আমাদের প্রথম প্রতিযোগি যে আমাদের সবাইকে একটু হলেও ইমোশনাল করে দিয়েছে সে আয়েশা সিদ্দিকা অন্তরা। অন্তরা মঞ্চে চলে এসো। আমি যেন বিশ্বাসে করতে পারছি না আমি সিলেক্ট হয়েছি তাও প্রথম। মঞ্চে উঠলাম সবাই আমার জন্য করতালি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন। আমার যেন বিশ্বাসে হচ্ছে না। জজেরা আমার হাতে এওয়ার্ড তুলে দিল তাদের মধ্যে একজন বললেন……
– তোমার মধ্যে গানের প্রতিভা আছে। তুমি চাইলে আমরা তোমাকে গানের ছন্দ একটি সো শুরু হবে তুমি যদি চাও আমরা তোমার এডমিশন নিয়ে দেব তার পাশাপাশি গান শেখার সুযোগ করে দেব।
– অনেক ধন্যবাদ স্যার, আমি বাড়িতে কথা বলে আপনাকে জানাবো।
– এই নাও আমার কার্ড ফোন দিয়ে জানাইয়ো আগামী কালকের মধ্যে।
– ওকে স্যার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বাসায় আসতেই মা লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করে দিয়েছে……
– এত বড় মেয়ে হয়েও কোনো কাজের নস তুই সারাদিন খালি টুঁই টুই করে নেচে বেড়াস। নবাবের বেটি আইছোস না খালি খাবি আর ঘুরে বেড়াবি।
– মা ছাড়ো খুব লাগছে আমায়।
তবুও পিটিয়েই যাচ্ছে এক পর্যায়ে বাবা এসে মায়ের হাত থেকে বাচাও ঘরে নিয়ে আসলো। বলতে চেয়েও বলতে পাড়লাম না, খুব বেশি কি চেয়েছিলাম মা একটু আদর ভালোবাসাই তো চেয়েছিলাম এটুকুই তুমি দিতে পারলে না মা। আমাকে সৎ ভেবেই এসেছো মা। বাবা বললো……
– মারে খুব লেগেছে তোর তাই না রে মা।
– না বাবা লাগেনি আমায়।
– ( বাবা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো ) ক্ষমা করে দিস রে মা আমায় তোকে ভালো মা এনে দিতে পারিনি।
– এভাবে বলো না বাবা মা বলে তো ডাকতে পারছি এটাই বা কম কিসে।
– আচ্ছা তুই নাকি গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিস?
– হুম বাবা।আর ওরা আমায় এটাও বলেছেন আমার জন্য একটি গানের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে দিতে। আগামীকাল ওরা যোগাযোগ করতে বলেছে। কি করবো তুমি বলো ?
– যে তোর মা কোনোদিন দিবে না আর সেখানে গেলেও অনেক টাকা-পয়সা লাগবে তার থেকে ভালো বাড়িতে থেকে পড়াশোনাটা চালিয়ে যা।
– হুম।
এই স্বপ্নটাকেও মাটি চাপা দিলাম। SSC পরিক্ষা সামনে তাই জোর লাগিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। কিন্তু মায়ের জন্য দিনের বেলা পড়তে পারি না। সারাদিন এটা কর ওটা কর লেগেই আছে সব কথা মানতাম যদি একটু হলেও মায়ের মন জয় করতে পারি। কিন্তু এই অভাগিনীর কপালে তা লেখা নেই। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন আমি বই পড়তাম। SSC পরিক্ষা দিলাম অনেক কষ্টে। আড়াই মাস পর SSC রেজাল্ট দিলো গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। খুব খুশি হয়েছিলাম আমি তার থেকে বেশি খুশি হয়েছিল বাবা। এডমিশন নিলাম নীলফামারী সরকারি কলেজে।চান্সও পেয়ে গেলাম। আমি কলেজে ভর্তি হই এটা মায়ের পছন্দ না। বাবার জন্যই কলেজে ভর্তি হলাম।
একদিন কলেজ থেকে আসার পথে পথ আটকে ধরে একটি ছেলে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিলাম। তারপর থেকে প্রাই দেখতাম ছেলেটাকে। হয়তো পছন্দ করে আমায়। একদিন পথ আটকে বলেছিলও আপনাকে আমার খুব ভালোলাগে। আমি পাত্তা দিতাম না। হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে বাড়িতে এসে জানতে পারি আজ আমায় আংটি পড়াতে আসবে। বিকেলে ছেলে পক্ষ চলে আসলো মা আজ জোর করে সাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। ছেলে পক্ষের সামনে গিয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম ছেলে তো ছেলে নয় আমার বয়সের দ্বিগুণ বড় মনে হয় বাবার বয়সি। একবার বাবার দিকে তাকালাম বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। না পারছি এসব মেনে নিতে না পারছি উঠে পালাতে। সবাইকে বিদায় দেওয়ার পর আমি মায়ের কাছে যেয়ে বললাম……
– ( মাথা নিচু করে )আমি এই বিয়ে করতে পারবো না মা।
– কি বললি তুই আমার মুখের ওপর কথা। ওরা অনেক বড়লোক তোকে বিয়ে করতে চাইছে এটাই অনেক। বিয়ের সব খরচ তারাই দেবে।
– আমি বিয়ে করবো না এটাই আমার শেষ কথা।
এই বলে চলে আসলাম। আজ প্রথম আমি মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছি। আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না। বাবার কাছে এসে বললাম……
– বাবা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আমাকে কিছু না বলেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তোমরা ?
– আমার যে কিছু করার নেই রে মা। বিয়েটা করে নে ভালো থাকবি।
– ছি বাবা শেষমেশ তুমিও।
কিছু বলে লাভ নেই বাবাকে। আমার মত অভাগিনী মনে হয় আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। বধু বেশে সাজিয়ে দিচ্ছে আমায় বড়লোক বাড়ির বউ বলে কথা কোনো কমতি নেই কোনোকিছুতেই সবাই বলছে আমাকে নাকি খুব সুন্দর লাগছে। এমন সময় বাবা এসে বললো.……
– তোমরা সবাই একটু বাহিরে যাও আমার অন্তরার সাথে কিছু কথা আছে। ( সবাই বাহিরে চলে গেল )
– মা রে তুই পালা অনেক চেষ্টা করেও বিয়েটা আটকাতে পাড়িনি।
– কিন্তু মা ?
– তুই এসব ভাবিস না এসব আমি সামলে নেব তুই পালা। পকেট থেকে ৭০০০ টাকা বের করে বললো……
– এটা রাখ কোথাও পালিয়ে যা। ফোন করিস মা যেখানেই থাকিস।
– আচ্ছা বাবা আমি আসি তোমরা ভালো থেক নিজের খেয়াল রেখ।
-সাবধানে থাকিস মা।
দোউরাতে দোউড়াতে চলে আসলাম নীলফামারীর বাসস্ট্যান্ডে একটা টিকিট কেটে উঠে পরলাম বাসে গন্তব্য ঢাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওখানে কি করবো কোথায় বা থাকবো সবেই অজানা। এদিকে বিয়ের কনে পালিয়েছে বলে অনেক হইচই হচ্ছে। শেষমেশ বর পক্ষরা যা তা বলে অপমান করে চলে গেল। ঢাকায় পৌঁছে আগে বাবাকে ফোন দিলাম……
– হ্যালো বাবা আমি ঢাকায় পৌঁছে গেছি।ওদিকের কি খবর ?
– সব ঠিক আছে। একটু ঝামেলা হয়েছে একটু কটু কথা শুনতে হয়েছে এই আর কি।
– সরি বাবা আমার জন্য.…
– ধুর পাগলি মেয়ে। আচ্ছা তোর মা আসছে পরে কথা বলবো সাবধানে থাকিস মা।
– আচ্ছা বাবা।
ফোন রেখে একটা হোটেলে ঢুকলাম। পেটে কিছু না পরলে কোনো আইডিয়া কাজ করবে না। খাওয়া শেষে একটা ব্রেন্চে বসে ভাবছি কোথায় যাবো কি করবো হঠাৎ মনে পরলো নাইমা ঢাকাতেই থাকে আর ওর বাসার ঠিকানাটাও আমার জানা ওরা ঢাকা উত্তরায় থাকে ফ্ল্যাট নং ১৯। ওর ফোন নম্বরটা থাকলে ভালো হতো। নাইমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধা হয়ে এলো। বেল বাজাতেই একটা মহিলা দরজা খুললেন কিন্তু ইনি তো নাইমার মা নন। আমি বললাম……
– আন্টি এখানে নাইমা আছে ?
– কে নাইমা এখানে কোনো নাইমা থাকে না।
– এটাই তো নাইমার বাসার ঠিকানা।
– আমরা ৩মাস আগে এখানে এসেছি আগে কে ছিল তা জানিনা মা।
– আচ্ছা।
চলে আসলাম হতাশ হয়ে। রাতও হয়ে এসেছে এখন আমি কই যাবো আর থাকবোই বা কোথায় একা একটা মেয়ে। এই সময় তো কোনো থাকার জায়গাও পাবো না। হতাশ হয়ে বসে পরলাম রাস্তার পাশে। কিছুক্ষণ পর ঘরিতে তাকিয়ে দেখলাম ১০টা বাজে। না এভাবে বসে থাকলে হবে না কিছুদুর এগিয়ে খোজ নিলাম অন্তত আজকের রাতটা কোথাও থাকতে পারি কি না। কিন্তু কেউ সাহায্য করলো না আজকের রাতটা আমায় রাস্তায় কাটাতে হবে। কতক্ষণ বসে থাকলাম মনে নেই বিয়ের সাজে এখনও আছি। রাস্তার পাশে একটা ব্রেন্চে বসে পরলাম গুটিশুটি মেরে।
মায়ের ঔষধ নিতে এসেছিলো সজিব। রাস্তায় একটা মেয়ে বসে আছে পড়নে একটা নীল কাতান শাড়ী। আবছা আলো তার মুখে এসে পরছে। মনে হয় মেয়েটা কাদছে আর এতো রাতে এখানেই বা কেন বসে আছেন। ( আমি সজিব নির্বাচন অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কর্মরত আছি। মা ছারা আমার আর কেউ নেই ) ধীর গতিতে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার কাছে। আমাকে দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেল মেয়েটি। আমি বললাম……
– এতো রাতে একা একটা মেয়ে এখানে বসে আছেন কেন ? এই রাস্তা রাতের জন্য মোটেও ভালো না ?
– চুপ করে আছে।
– কথা বলছেন না যে আর আপনি বিয়ের সাজেই বা কেন বসে আছেন ? বিয়ের কনে পালিয়ে এসেছেন মনে হয় তাহলে আপনার বি এফ কই ?
– আমি কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়ে আসিনি আমি একা এসেছি। আমার এক বান্ধবীর বাসায় এসেছিলাম কিন্তু তারা এখন ওই বাসায় থাকে না। ওর ফোন নম্বরও আমার কাছে নেই আর না আছে থাকার আশ্রয়।
– আপনি চাইলে আমার সাথে আসতে পারেন। আমার বাসায় আমি আর মা ছাড়া কেউ নেই।
– না আমি এখানেই ঠিক আছি।
– বিশ্বাস করতে পারেন আমায় চলুন আমার সাথে কাল সকালে নাহয় চলে যাবেন।
এমন সময় কয়েকটা বখাটে ছেলে আসলো। নেশা করেছে মনে হয় আমাদেরকে দেখে পাশেই ঘুরঘুর করছে।
হয়তো ছেলেটি চলে গেলে জানোয়ারগুলো ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর। আমার অবস্থা দেখে ছেলেটি আবার বললো……
– আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন। এখানে থাকাটা আপনার জন্য ঠিক না।
– জি চলুন।
দু’জনেই হাটছি মিনিট ১৫ হাটার পর একটা দু’তলা ভবনের সামনে এসে সেই বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়িটি অনেক সুন্দর দেখতে। একটা রুমে আমাকে বসিয়ে বললেন……
– আপনি এখানে বসুন আমি মাকে খুজে আনছি।
– আচ্ছা। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউ আসছে না। কিছুটা ভয় পেয়ে গেল অন্তরা। এখানে এসে ভুল করলাম না তো। দরজা খুলে বাহিরে আসতেই দেখলাম ছেলেটি আর তার মা সিড়ি বয়ে নিচে নামছে। আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বলতে শুরু করলেন……
– আমাকে না জানিয়ে একটা মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে আসলি সজিব এই জন্যে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে আসলি। কে এই মেয়ে ?
– আন্টি উনি আমাকে চেনেন না। অসহায় মেয়েটিকে সাহায্য করেছেন উনি। শুধু শুধু আমার জন্য ওনাকে গালি দিয়েন না।
– কিন্তু তুমি কে মা বিয়ের সাজে আছো ?
– আমি আমার বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছি ঢাকায় আমার বাড়ি নীলফামারিতে। তারপর একে একে সব খুলে বললাম। তিনি অনেকটা দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর বললেন……
– তুমি যতদিন না থাকার জায়গা পাচ্ছো এখানেই থাকতে পারো।
– আপনারা আমার অপরিচিত হয়েও আমার জন্য অনেক করছেন মা। ( এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম ) উনি বুকে জরিয়ে নিলেন আমায় পরম আদরে মনে হচ্ছে মাকে জরিয়ে আছি। কিন্তু আমার মা আমাকে কোনোদিনও ভালো করে কথায় বলেনি আদর তো দুরের কথা।
– তুমি তো মনে হয় সারাদিন কিছু খাওনি কাপর পালটে হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার গরম করি। ( মা )
– আচ্ছা। পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে চলে যেতে চাইলাম কিন্তু উনি আমাকে কোথাও যেতে দেবে না এই অবস্থায়।
আমি বললাম……
– এমনি এমনি তো আপনাদের বাসায় থাকতে পারবো না তার থেকে ভালো আপনাদের বাসায় আমি কাজ করবো থাকার আশ্রয় আর দুমুঠো খেতে দিলেই হবে।
– তা তো হবে না তুমি আমার মেয়ে হয়ে থাকবে কাজের মেয়ে হয়ে না। কয়েকদিন পর পাশের বাসার একটা মহিলা আসছেন উনি আমাকে দেখে মাকে বললেন……
– কে এই মেয়ে আগে তো দেখিনি ?
– আমার এক ভাইয়ের মেয়ে কিছুদিন আগেই আসছে এখন থেকে এখানেই থাকবে।
– ওহ। ছেলের বউ করে আনলেই পারতে।
– মন্দ বলোনি অন্তরা ভালো মেয়ে। ভেবে দেখি।
– আচ্ছা আমি আসি।
– আচ্ছা। উনি মন্দ বলেন নি এ’কদিনে মেয়েটা আমার মন জয় করে নিয়েছে। সজিবের সাথে কথা বলতে হবে। সজিবের রুমে গেলাম বললাম……
– ওই অন্তরাকে তোর কেমন লাগে ?
– কেন হঠাৎ এমন প্রশ্ন ? ও ভালো মেয়ে এইকয়দিনে যা বুঝেছি।
– অন্তরার সাথে তোর বিয়ে দিতে চাচ্ছি তোর মত থাকলে আমি ওর সাথে কথা বলে দেখবো।
– মা পাগল হয়ে গেছো, ওহ ভালো মেয়ে তাই বলে বিয়ে করবো!
– ভেবে দেখিস তাড়া নেই। এই বলে চলে গেল মা। কয়েকদিন পর মা অন্তরার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে আর আমি মুখ গোমরা করে বসে আছি। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো……
– মুখ ভার করে বসে আছিস কেন ?
– তো কি করবো এই মেয়ে যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে আমার ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। সব ওকে দেও আমার কথা মনেই পরেনা তোমার।
– জেলাস হচ্ছে? ( অন্তরা )
– হুম হওয়ারি কথা।
অন্তরা আর মা দুজনেই হেসে উঠলো। অন্তরার হাসি দেখে মুগ্ধ হলাম এতো সুন্দর করেও কেউ হাসতে পারে।
একদিন বিকালে বৃষ্টি হচ্ছে তাই ছাদে চলে আসলাম বৃষ্টি দেখতে। বৃষ্টির দিন বৃষ্টি দেখতে সবারই ভালো লাগে। ছাদে এসে দেখলাম অন্তরা বৃষ্টিতে ভিজছে আর তার সাথে গান গাইছে আর নাচছে রিমঝিম ধারাতে চায় মন হারাতে,,, সেই ভালো বাসাতে আমাকে ভাসাতে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি ওকে অন্য রকম এক ভালোলাগায় মন ছুয়ে গেলো। আর ওর গানের মধ্যেও এক নেশা আছে। সে যেমন সুন্দর তার গানের গলাও অনেক সুন্দর। আমি তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। অন্তরার সাথে চোখাচোখি হতেই সে লজ্জা পেয়ে ছুটে নিচে নামতে যাবে তখনেই পা স্লিপ করে পরে যেতেই আমি ধরে ফেললাম। এই মূহুর্তটা এখানে থমকে গেলেই হয়তো ভালো হতো। সে চলে গেল নিচে সাথে আমার মনটাও নিয়ে গেল। এখন তার আগে পিছে ঘুরঘুর করতাম। সে বুঝতো কিন্তু চুপ থাকতো কারন সে এই বাড়িতে আশ্রিতা হয়তো তাই চুপ থাকতো। আমার কার্যকলাপে মা বুঝতে পারলো। মা আমার রুমে এসে বললো……
– কি রে আবভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রেমে পরেছিস ?
– হুম মা অন্তরার প্রেমে পরেছি আমি।
– তো কি ওকে জানাবো ?
– আমি জানাবো আমার মনের কথা।
– সেটাই ভালো হবে। এই বলে মা চলে গেল। সন্ধায় অন্তরাকে বললাম……
– অন্তরা চলো একটু ছাদে যাই! তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– আচ্ছা চলুন। দুজনেই ছাদের রেলিং ধরে দারিয়ে আছি।
– অন্তরা অনেকদিন থেকে একটা কথা বলবো ভাবছি কিন্তু বলা হয়ে উঠেনি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি তোমার জীবন সঙ্গী হতে চাই। তোমার মতামত চাই আমি ?
– কি বলছেন এসব মা শুনলে কি ভাববেন বুলন তো ? পাশ থেকে মা বলে উঠলেন……
– আমি তো সেই কবে থেকেই রাজি। তুই রাজি থাকলেই বিয়ের কথা এগোবো আমরা।
– বাবা মাকে না জানিয়ে ?
– তোমার বাবা মাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা আমি করবো তুমি শুধু তোমার মতামত জানিয়ে দেও।
– আপনারা যা ভালো বুঝেন।
এই বলে ছুটে নিচে চলে গেল। আজ অন্তরার বাবা মা সবাই এসেছেন। বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে ৩দিন পর বিয়ে ঠিক করলেন। ঘরোয়া ভাবেই আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ন হলো। পরেরদিন সকালে বাবারা চলে যাচ্ছে। বাবা বললো……
– ভালো থাকিস মা সুখে থাকিস সজিবকে নিয়ে। মায়ের আদর পাসনি তো কি হয়েছে এই মায়ের কাছে খুব ভালো ছিলি আর ভালো থাকবো দোয়া রইলো তোমাদের জন্য।
– সাবধানে যেও তোমরা। শাশুড়ী মায়ের উদ্দেশ্যে বাবা বললেন……
– আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন। তার মা নেই তো কি হয়েছে আরেকটা মা পেয়েছে আমার মেয়ে।
– আপনি কোনো চিন্তা করবেন না সাবধানে যাবেন। পৌঁছে একটা ফোন দিয়েন।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল বাবারা।খুব কান্না পাচ্ছে তাই রুমে চলে আসলাম। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে বাবার জন্য। কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে দেখি সজিব।
– কাদছো কেন ?
– বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে। না জানি আর কবে দেখা হবে।
– ওহ এই ব্যাপার সামনের মাসে নিয়ে যাবো তোমায়। এবার খুশি তো।
– হুম ( তবুও মুখটা ভার )
– আমার মহারানীর এখনও মন খারাপ তুমি পাদলে আমিও পেদে দেব ( প এর স্থানে ক হবে ওকে হাসানোর জন্যেই মজা করলাম )
এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো অন্তরা।
– এই হাসিটা সারাজীবন তোমার মুখে দেখতে চাই।
– হুম জনাব।
সুখেই কাটছে অন্তরার সংসার জীবন। পেয়েছে একটা ভালো মা যে সবসময় অন্তরাকে চোখে হারায়। এবার বুঝি অভাগিনীটা একটু সুখের আলো দেখতে পেল। ভালো থাকুক অভাগিনীটা তার ছোট্ট সংসার নিয়ে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক