আমার সবই ভাল লাগল ওর। নীলের পুরুষালী চেহারা, পেটা একখানা চৌকস দেহ, পুরুষ্ঠু শরীর, আর মেজাজ। বেশ চড়া মেজাজেই খুব লাগল নীলকে। নিলয় আহমেদ। আমার নেংটাকালের বন্ধুর বর্তমান বর্ণনা। সেইসময় নাক থেকে পানি ঝরত। আর মুছত। সেন্টু গেঞ্জীর কোনায় কত নাকের পানি মুছতে দেখেছি! ওর আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিল।
ও মেয়েদের পছন্দের কালার গোলাপী রঙের হাফপ্যান্ট পড়ত। পাশের বাসার শফিক আঙ্কেল ওকে দেখলেই বলতেন, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে।’ আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল রেললাইন। সকাল বিকাল নিয়মিত ট্রেন যেত। আমরা ওকে ক্ষ্যাঁপানোর জন্য ট্রেন যাওয়া মাত্তর চিল্লাতাম, ‘ গোলাপী এখন ট্রেনে।’ আল্লাহ মালুম কোন কামরায় ছিল গোলাপী! নীল রাগতনা। ফিক ফিক করে হাসত। ‘ববিতাকে আমার খুব পছন্দ।’ আমার বড্ড রাগ লাগত। আমাকে পছন্দ না করে ববিতাকে! রাগে গা রি রি করত। তিন চাকার আমাদের ঠেলা গাড়ীটাতে আমি গাল ফুলিয়ে বসতাম। নীল কি বুঝত কে জানে! কষ্ট করে ঠেলে নিত।
:কি রে এত রাগ কেন?
:কে কইছে?
:তোর মুখ দেইখাই বুঝছি।
নীল বিজ্ঞের মতন ওর গোলাপী হাফপ্যান্টের পকেটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিত। ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ হত। মারবেলের শব্দ। হাতমুঠো করে বের করে আনত। তারপর তা থেকে বেছে বেছে তার পছন্দের ভেতরে নঁকশা করা মারবেলগুলোন আমার হাতে গুঁজে দিত। আর বাকীরা চোখ বড় বড় করে দেখত। ইকবালতো প্রায় বলেই বসত।
:কিবা তুই আঙগোরে দেছ না ,সায়মারে দিলি কেনে?
:মুন চাইছে।
দুজনের বেশ লেগে যেত। মান ভাঙত গুলতি বানানোর সময়। আমরা বলতাম গুলাইল। পাখি মারার গুলাইল। আমরা কত কষ্ট করে করে এ গাছ ও গাছ ঘুরে পারফেক্ট ডাল খুঁজে বের করতাম। তারপর ইকবাল আমাদের বাসা থেকে লুকিয়ে আনা দাও দিয়ে ডাল কাটত। তারপর রাবার কিনতাম পাঁচটাকা করে। তারপর গুলাইল হত। আর চিকন গুনার তার দিয়ে বানাতাম পাখির বাসা। সেকি দিন ছিল! একবার ইকবালের গুলাইল থেকে ছোড়া মারবেলে এক চড়ুইপাখি মরে পড়ল। আমার সে কি কান্না! সবাই ভয় পেল। এরপর গুলাইল বন্ধ।
নীল আর ইকবাল মিলে নতুন খেলা বানিয়ে ফেলল। মাছ ধরা খেলা। ইকবাল বঁড়শি বানাল। বঁড়শির মাথায় বাঁকানো সূঁই। দু টাকা এক পিছ। আর ইকবাল মাটি খুঁড়ে বার করত কেঁচো। পাঁচ টাকা করে কিনে নিতাম। আমরা বলতাম জির। জিরকে দুই তিন টুকরা করতাম। এক টুকরা বঁড়শির মাথায় সূঁইয়ে আটকে ডোবায় ডুবিয়ে রাখতাম। মাছ যেই সে জির খেত, তখনই হ্যাঁচকা টান দে উপরে আনতাম। মাছ বলতে টাকি মাছ। আমাদের এলাকায় বলে লাটি মাছ। মাছ ধরা খেলার সাঙ্গ হল, যেদিন নীলের বঁড়শিতে ঢোড়া সাপ উঠল। আমার সেকি চিৎকার। নীল আমাকে প্রমিজ করল সে আর এখানে মাছ ধরবে না। এরপর খেলতাম চারকটি। খেজুর বিঁচিকে দুভাগ করে কটি বানাতাম। বেশ ঘষতে হত সুন্দর কটি বানাতে। যখন বৌঁচি, গোল্লাছুট, বরফপানি সব খেলা শেষ হত। তখন আমাদের চারকটি খেলা শুরু হত। বেশ চলত। কবে যেন কুটকুট করে বড় হয়ে গেলাম। দাদু বলল সে কথা।
:এহন বড় হয়েছিস সায়মা।
:তবে?
:তবে বাইরে যাইতে নাই। ছেলেগো লগে খেলা বারণ।
:ওরাতো ছেলে না। ইকবাল, নীল, সোহাগ!
দাদু হাসল। তারপর মা, কাকীমাও আমাদের বেশ বোঝাল। আমি আর রাইমাও আর বের হতাম না। রাইমা ছিল আমার তখন একমাত্র খেলারসাথী। আমরা দু চাচাতোবোনে খেলার নতুন জগত সৃষ্টি করলাম। কিন্তু আমার আর কাউকে মনে না পড়লেও নীলকে মনে পড়ত। একদিন নীল রমজানের দোকান থেকে টিকটিকির ডিমের প্যাকেট কেনার সময় ধরল।
:বারে, তুই না বড় হয়ে গেছিস? বড়র মতন চুপ রইলাম। জবাব দিলাম না। কারণ বড়রা অনেক কথার জবাব দেয়না।
:বড়রা টিকটিকির ডিম খায়? আমি তারপরও জবাব দিলাম না। হেঁটে গেইট পর্যন্ত এসে বড়দের মতন মুখ করে বললাম।
:হুম বড় হলে ছেলেমেয়েতে কথা কইতে নেই।
:কে কইল?
:দাদু কইছে।
নীল মাথা চুলকে চলে গেল । আমি ভিতর ভিতর খানিকটা কষ্ট পেলাম। দাদু বলেছে, এটা পাপ। পাপতো করা যায়না!
এরপর নীল বা ইকবাল বা সোহাগ কারও সাথেই কথা বলতাম না। দেখতাম, নীল আর গোলাপী প্যান্ট পড়েনা। ওরাও বেশ বড় হয়ে উঠেছে।আমিও উঠেছি বড় হয়ে। আমি গার্লস স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করলাম স্টার পেয়ে। গার্লস কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করলাম। তারপর ঢাকা ভার্সটিতে পাড়ি জমালাম। রসায়নে। এদিকে রাইমার বিয়ের তোড়জোড় চলছে। ওর গলায় মালা চড়লেই আমার সিরিয়াল। অনেককাল নীলের সাথে দেখা নেই। শুনেছি বুয়েটে পড়ে। ইকবাল বাপের ব্যাবসায়। আর সোহাগ মেডিকেলে পড়ে। এরচে বেশী জানতাম না আমি। হঠাৎ এক ঝড়ের রাত। বাইরে শোঁ শোঁ আওয়াজ বইছে। টিনের চালে উড়ে এসে পাতা আর নুড়ি ঝরছে। দরজায় খটখট আওয়াজ।
:কে? কে?
:দরজা খোল। পুরুষকন্ঠ! এ তো আমাদের বাড়ির কোন কন্ঠ না! রাইমা পাশে এসে দাঁড়াল।
:কে?
:আমি।
: আমি কে?
:আমি নীল।
রাইমা অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। দরজার ছিটকিনি খুলল ও। দুয়ার ঠেলে ভিতরে ঢুকল নীল। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে আছে। হাতে একটা চিঠিখাম। আমি হড়বড়ালাম।
:কোইতে আইলি? আর সদর দিয়া ঢুকলি কেমনে? আর আঙ্গো ঘর চিনলি কেমনে? নীল কাঁদে।
:কান্দোস কেরে?
:জার্মান যাইতাছি। স্কলারশীপে।
:এইডাতো খুশীর কতা!
:সায়মা, তুই খুশী অইছছ?
:হ।
নীল আমার হাতটা টেনে ধরল। ডানহাতে চিঠিখানা গুঁজে দিয়ে বামহাতে ওর হাত থেকে একটা পুরুষালী আংটি পরিয়ে দিল আমার আঙুলে। আমি বোকার মতন তাকিয়ে রইলাম। এরপর নীলের খবর জানিনা। কেটে গেছে কতকাল। সে চিঠিটা পড়ে রইল অযতনে আমার ড্রয়ারে। রাইমা নীল চলে যাবার পর চিঠিটা পড়ে আমাকে শুনিয়েছিল। ছোটবেলার হরেক স্মৃতি। লাড্ডু খাওয়ার, কদমা কেনার, গাট্টা খাবার। সারাদিন ঘুরে ঘুরে লোহা লক্কর আর কাঁচের বোতল জমিয়ে গুড়ের গাট্টা আর বড়ইয়ের আচারের গল্প। সব ছাপিয়ে আমাকে মিস করার সাথে আমাকে পাবারও যে আকুতি ছিল আমার মনে রেখাপাত করলেও দাদুর কল্যাণে স্থায়ী হয়ে করেনি তা।
এরপর রাইমার বিয়ে হল। বাচ্চা হল। কত্তদিন কেটে গেল! আমার বিয়ের বেলা। ছেলে বড় মেজিস্ট্রেট। বাড়িতে লাল নীল বাতি জ্বলছে। একদল মেয়ের হাসি শোনা গেল।
:জামাই আইয়া পড়ছে। আমি দুরু দুরু বুকে একলা বসে। হৈ হুল্লোড়। খাওয়া দাওয়া শেষ। রাইমা আসে।
:সামু মনে অয় অহন বিয়া পড়াই লাইব!
টিকটিক করে সময় বয়ে যায়। রাত বাড়ে। আমি হাঁটিহাঁটি করে এঘর ওঘর ঘুরে উঠানের পাশে দরজা ধরে দাঁড়াই। সবাই উঠানে স্থবির। কানে কানে কথা হচ্ছে। বরের বাবার সাথে পনের লাখ টাকার চুক্তি ছিল। বাবা বিয়ের আগে পরিশোধ না করাতে বর উঠে গেছে। আমি ফিরে যাই ঘরে। ড্রয়ার খুলি। চোখে পড়ে নীলের চিঠিখানা। রিংটাও চোখে পড়ে। কি মনে করে বা হাতের আঙুলে রিংটা পড়ে নেই। চুপিচুপি পিছনের দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ি। দৌড়ের মতন করে হাঁটি। পুকুরপাড়ে পৌঁছতে হবে। ওইতো দেখা যাচ্ছে। ঘাটপাড়ে চলে এসেছি। মাথার ঘোমটাটা সরিয়ে যেই প্রথম সিঁড়িতে পা রেখেছি, এমনসময় কেউ শক্তহাতে আমার হাতটা মুচড়ে ধরল।
:যদি আত্মহত্যাই করবি, বাবামার এতগুলান পয়সা নষ্ট কইরা লেহাপড়া করলি কে!
:আপনে কেডা? আত ছাড়েন। ব্যাতা লাগে।
:পুকুরে ডুবলে আর ব্যাতা লাগব না! ব্যাতা ছাড়াই মইরে যাবি! এত সস্তা!
আমার মুখ চেপে কোলে করে বাড়ির উঠানে নিয়ে এল। নামিয়ে দিয়ে সবার সামনে। তারপর সজোরে ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নীল! উসকো খুসকো চুল আর দাড়ি। আমার অতৃপ্ত প্রেম! বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠলেন।
:কাকা, আপনের মাইয়া আমারে জিন্দা ফালাইয়া পুকুরে ডুবত গেছিল। বাবা ডুকরে উঠলেন।
:কাকা, কাজী ডাকেন। বিয়া আজকাই অইব। আমি পাঞ্জাবী পিন্দা আইতাছি।
আমি হতভম্ব দাঁড়িয়ে। হাতে নীলের দেয়া আংটিখানা লুকানোর চেষ্টা করলাম। নীল একবার যাবার আগে স্থিরচোখে আংটিটা দেখল। আমি আমার গালে হাত দিলাম । জ্বলছে গালটা। নীল মুচকি হাসল।
:আত্মহত্যা সমাধান নয়। বেঁচে লড়াই করাই সাহসী মানুষের জবাব।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক