মৃত সন্তানের মায়া

মৃত সন্তানের মায়া
আমাদের একমাত্র ছেলে আয়াজ মারা গেছে যে বেশিদিন হয়নি।অথচ এর মধ্যেই আমার বউ শিউলী বোধহয় কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে!আয়াজের মৃত্যুর ব্যাপারটা কেবলই অজুহাত মাত্র, পরকীয়া লুকোবার অজুহাত। নাহলে প্রতিরাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পরে শিউলী এভাবে চুপিচুপি বেরিয়ে যায় কেন? ঘটনাটা শুরু হয়েছে একমাস আগেই।আয়াজের মৃত্যুর ঠিক পনেরো দিন পর থেকে। প্রথম প্রথম আমি টের পেতাম না, কিন্তু অফিসের এক কলিগ যেদিন বলল, —“কাল রাতে আপনার স্ত্রীকে নাইট ড্রেস পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম, আমি ওনাকে থামাবারও চেষ্টা করলাম, কিন্তু উনি গ্রাহ্যই করলেন না।” সেদিনই আমার বুকের ভিতরটা শিরশির করে উঠেছিল।শিউলীর কোনো মেন্টাল প্রবলেম হলনা তো?আয়াজের মৃত্যুটা আমাদের কাছে ছিল একটা বিশাল ধাক্কা।আমাদের আড়াই বছরের ছেলে আয়াজ।
এই সদ্য সদ্য কথা বলতে শিখছিল। আধো আধো সুরে। এমনি খাবার খেলেও মায়ের দুধ ছাড়া সে থাকতেই পারতনা। কিন্তু মারাত্মক দুর্ঘটনাটা এভাবে ঘটে যাবে আমরা ভাবতেও পারিনি। কোথা থেকে ওই ছোট্ট লিকলিকে জীবটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল কে জানে? সেটাকে ধরে মুখে পুরে নিয়েছিল আয়াজ। রাতে প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনা নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। অপারেশন করে বিশাল সাইজের জোঁকটাকে পেটের ভিতর থেকে বার করা গেলেও আয়াজকে বাঁচানো যায়নি। মানসিক ভাবে আমরা দু’জনেই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই ধাক্কা কাটিয়ে আমরা তো আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, তা সত্বেও শিউলী এমন করছে কেন? সেদিনই শিউলীকে ডেকে প্রশ্নটা করেছিলাম আমি, “কাল রাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
নিষ্পৃহ ভাবে শিউলী উত্তর দিয়েছিল, ” আমার ছেলের কাছে।” বুকের ভিতরটা ধক করে উঠেছিল আমার।বললাম, “তুমি কবর খানায় গিয়েছিলে?” শিউলী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। বড্ড কাঁদছিল আয়াজ সোনা। ওর ভীষণ খিদে পেয়েছিল।” বললাম, “তুমি কেন বুঝতে চাইছনা,আয়াজ আর এই পৃথিবীতে নেই। ও আর কোনো দিনও কাঁদবেনা।” শিউলী চিৎকার করে উঠেছিল, “তুমি বুঝতে চাইছনা।ও এখোনো আছে। এই পৃথিবীতেই আছে। প্রতিরাতেই সে কাঁদে। আমাকে ‘মা’ ‘মা’ করে ডাকে। ওর ডাককে যে অবহেলা করতে পারিনা আমি।”
সেদিনই শিউলীকে নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। উনি ওকে কিছু অষুধ পত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে কোনো লাভ হয়নি সে কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আজকাল রাতের খাবার খেলেই আমি অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ি। সম্ভবত আমার রাতের খাবারে ঘুমের অষুধ মিশিয়ে দেয় শিউলী। তারপর রাত হলেই বেরিয়ে যায়। প্রথম প্রথম সন্তানের শোক ভেবে চুপ করে থাকলেও এখন আমার মনেহচ্ছে শিউলী কোনো পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। দুঃখের সময় মানুষ একটা অবলম্বন খোঁজে। হয়তো সেই অবলম্বন খুঁজতে গিয়েই! কিন্তু দুঃখ তো আমিও কম পাইনি, তবে আমি কেন কাউকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি না? সেদিন থ্রেটটা দিয়েছিলাম, “আমার মনেহচ্ছে তোমার এই প্রতি রাতে বেরিয়ে যাওয়াটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার না।” শিউলী বলল, “কি মনেহচ্ছে তোমার?” বললাম, “আমার সন্দেহ তুমি কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছ।”
শিউলী বলল, “জড়িয়ে পড়েছি তো বেশ করেছি। তার জন্য তুমি কি আমাকে ডিভোর্স দিবা? নাকি বাড়ি থেকে বের করে দিবা?” আমার মাথা গরম হয়ে গেল। বললাম, “প্রয়োজনে হলে তাই করতে হবে।” সে বলল, “কিন্তু কাউকে ডিভোর্স দিতে গেলে প্রমানের দরকার হয়। সন্দেহের বশে কাউকে ডিভোর্স দেওয়া যায়না। তুমি আগে প্রমান জোগাড় করো, তারপরে আমাকে ডিভোর্সের কথা বলবা।” মাথা গরম করে বারান্দায় চলে গেলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। মনেহল শিউলী আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আসলে আয়াজ একটা বাহানা মাত্র। রাত হলেই শিউলী ওর নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যায়।আমাকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের অষুধ খাইয়ে দিয়ে যায়, যাতে আমি ওকে ফলো করতে না পারি। কিন্তু আমার নামও রাহী চৌধুরী।
এই অনাচারের শেষ দেখে ছাড়বো আমি। প্রয়োজনে একটা রাত ডিনার করবো না, প্রয়োজনে একটা রাত বাইরে খেয়ে আসবো, তবু আমি প্রমান করে দেবোই শিউলী অবৈধ সম্পর্কে জড়িত।আমি চাইলে ডিটেকটিভ লাগাতে পারতাম, কিন্তু এইটুকু ব্যাপারের জন্য ডিটেকটিভের পিছনে খরচ করার কী দরকার? সেদিন রাতে অসুস্থতার অজুহাতে শুয়ে পড়লাম। রাতের খাবার খেলাম না।শিউলী আমাকে একগ্লাস দুধ খাওয়ানোর জন্য জোর করছিল, সেটুকুও খেলাম না। বিছানায় শুয়ে চুপচাপ মড়ার মতো পড়ে রইলাম। এমন ভান করলাম যেন সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছি। আজ রাতে আমার নষ্ট বউয়ের মুখোশ খুলবোই। ওকে আর ওর নতুন বয়ফ্রেন্ডকে হাতে নাতে ধরবো।প্রমাণ করে দেবো আমার সন্দেহ অমূলক নয়।
বিছানায় উত্তেজিত ভাবে শুয়েছিলাম। দেখতে দেখতে ছায়ার মতো রাত বাড়ছিল। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত দেড়টা বাজে। পাশেই অঘোর ঘুমে তলিয়ে রয়েছে শিউলী। কোনো হেলদোল নেই। কি নিষ্পাপ লাগছে ওর মুখ খানা! দেখে মনেই হচ্ছেনা ওর কোথাও যাবার তাড়া আছে। শুয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিলাম, মনেহচ্ছিল শিউলী হয়তো আমার প্ল্যান বুঝে গেছে, আজ রাতে হয়তো সে বেরুবেই না। কিন্তু হঠাৎই ঘড়িতে ঠক করে রাত দুটো বাজতেই দু’বার এপাশ ওপাশ করে বিছানার উপরে উঠে বসল শিউলী। ধীরেধীরে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল।আমি প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম। অঘোরঘুমে ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে শিউলী যে এভাবে বেরিয়ে যাবে আমি কল্পনাই করিনি। একটু ধাতস্ত হতেই বিছানা ছেড়ে আমিও শিউলীর পিছনে পিছনে বেরিয়ে পড়লাম।
কেমন যেন টলতে টলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে শিউলী।
মনেহচ্ছে ও যেন সুস্থ অবস্থায় নেই, ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। হাত দশেক দূরত্ব রেখে ওর পিছনে পিছনে হেঁটে চলি আমি।আমার গা ছমছম করতে লাগল। বড়ো রাস্তা ছেড়ে শিউলী এখন জঙ্গলের দিকে বাঁক নিয়েছে। চারপাশে ঘনিয়ে আছে এক আদিগন্ত অমানিশা। কৃষ্ণবর্ণ আকাশ থেকে ফ্যালফ্যালিয়ে উঁকি মারছে আধখানি চাঁদ। আশেপাশের বাতাস ভরে আছে এক অদ্ভুত শিহরনে। দুপাশের গাছগুলো যেন অদ্ভুত এক আতঙ্ক গায়ে মেখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমাঝে অদ্ভুত শব্দে পাখা ঝাপটে উঠছে পাখ-পাখালির দল। হঠাৎ একটুকরো আবছায়া অন্ধকার পার হতেই শিউলীকে আর সে দেখতে পেলাম না। কোথায় গেল সে? এই তো আমার সামনে দিয়েই হাঁটছিল এতক্ষণ? এক্ষুণি কিভাবে হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে গেল? বুকের ভিতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল।
বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পরে, ক্রমশ রাস্তাটাকে চিনতে পারলাম। খুব ছোটবেলায় যখন লুকোচুরি খেলতাম এই রাস্তা দিয়েই তো সে যাতায়াত করত। রাস্তার শেষ মাথায় রয়েছে বাচ্চাদের কবরখানা। ওখানেই কালু, রশিদ, জন, নিয়ামত, রৌনকের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতাম। তিন ধর্মেই বাচ্চাদের কবর দেওয়া হয় বলে কবরখানাটা একটা মহামিলন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বেশ কাটছিল দিনগুলো, কিন্তু একদিন আমাদের পাড়ার আলতাফ কাকা আমাকে কবরখানার দিকে যেতে দেখে ফেলেন, তারপরই খুব বকাবকি করেন, বলেন, ওই কবরখানায় যেসব বাচ্চারা থাকে, তারা নাকি কেউই জীবন্ত নয় সেই থেকেই তো কবরখানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।বউ কি তবে কবর খানাতেই যাচ্ছে? কারোর সঙ্গে মিট করার জন্য কবর খানার চেয়ে ভাল জায়গা আর কীই বা আছে? কেউ সেখানে যাবেনা।
চিন্তা ভাবনা করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালে হয়তো শিউলীকে ধরতে পারবো না,
তাই চিন্তা ভাবনা বন্ধ করে ধীরেধীরে কবরখানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কোমর সমান উঁচু ঝোপঝাড়। যেতে যেতে বারবারই মনেহতে লাগল ছায়ার ভিতর থেকে কারা যেন কৌতূহলী মুখে আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কবর খানাতে পৌঁছে গেলাম। কবরখানার মাঝবরাবর আসতেই দেখতে পেলাম মাটির উপরে আমার বউ বসে আছে।আমার দিকে পিছন ফিরে। ওর কোলে কিছু একটা বস্তু। সেটাকে দুলিয়ে দুলিয়ে সে ঘুম পাড়াচ্ছে। বস্তুটা কি? আরো ভাল করে দেখবো বলে বউয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি আসতেই আমার বুকের ভিতরটা শিহরনে কেঁপে উঠল।শিউলীর কোলে শুয়ে আছে ওরই দেড়মাস আগে মৃত সন্তান আয়াজ।
দেড়মাস ধরে মাটির তলায় থাকার দরুন আয়াজের সারা শরীরের মাংস খসে পড়েছে। অক্ষিকোটর থেকে বিভৎস ভাবে বেরিয়ে পড়েছে দুটো চোখ। চাঁদের আলোয় মাড়িহীন দাঁতগুলো চকচক করছে। তবু শিউলীর কোলে শুয়ে দুধ খেতে খেতে খিলখিল করে হাসছে সে। আর এক একবার মুখ তুলে বলছে, ” আম্মু দেখ দেখ, আজ আব্বুও আমার কাছে এসেছে, দেখ আম্মু দেখ…”
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত