চরিত্রহীন

চরিত্রহীন
শুনেন, ঘরে পরার জন্য একটা শাড়ি দরকার।  বিলাসিতা কম করো নীরা। সংসারে আয় উন্নতি হয় না বিলাসিতা করলে! বিয়ের প্রথম দিকে নীরার মনে হয়নি হাসান মানুষটা খুব কৃপণ। এখন বুঝতে পারছে। ধুমধাম করে তাঁর বিয়ে হয়নি। হয়েছে হুট করে। তাই কেউ শাড়ি আনেনি বিয়েতে। যে কয়েকজন এসেছে। টাকা পয়সা দিয়েছে। সে টাকাগুলো বাবার বাড়িতেই ভাগবাটোয়ার হয়ে যায়। হাসানের ধমক শুনে নীরা চুপ করে শুয়ে রইল। বাতি না নিভালে নীরার ঘুম আসে না। কিন্তু আজকে বাতি না নিভিয়েই ঘুমানোর চেষ্টা করল। গরমের মধ্যে ঠান্ডা পানির পিপাসা সবারই পায়। কিন্তু বাসায় কোনো ফ্রিজ নেই। হাসানের যথেষ্ট টাকা আছে ফ্রিজ কেনার। কিন্তু সে কেনে না। কালকে এই কথাটা নীরা তুলেছিল।
“ ফ্রিজে বোতল ভরে পানি রাখলে আমরা ঠান্ডা পানি খেতে পারব। একটা ফ্রিজ আনার দরকার না? ”
“ বাসায় কী আনা দরকার আর কী দরকার না। সেটা আমার চেয়ে বেশি বুঝো তুমি? ”
নীরা আর কথা বাড়ায়নি। ঝগড়াঝাটি করতে মন চায় না তাঁর। মেনে নেয়। একটু আধটু মেনে নেওয়া লাগে মেয়েদের। বিয়ের পরে বেশিরভাগ রাতেই সে মন খারাপ নিয়ে ঘুমুতে যায়। বিয়ের আগে এমনটা ছিল না। দুবোন মিলে গড়াগড়ি করে ঘুমাত। নীহার গায়ের উপর পা তুলে দিত। এখন এই অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। একদিন মনে হয় রাতে ঘুমের ঘোরে হাসানের গায়ে পা তুলে দিয়েছিল। এজন্য হাসান লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিয়েছিল! একথা সে কাউকে বলেনি। স্বামীর সাথে আঁধারের কথাগুলো বহিঃপ্রকাশ করতে নেই। ক্রিংক্রিং করে বেজে উঠলো নীরার বাটন ফোনটা। হাসান কড়া গলায় বলল।
“ কে ফোন করেছে? ”
“ বাড়ি থেকে ফোন। নীহা মনে হয়। কথাটা বলে নীরা ফোন ধরল।
“ হ্যালো? “
“ হ্যালো আপা, কেমন আছিস? ” ছোট বোন কেমন আছিস জিজ্ঞেস করলে বড় বোন কখনো ভাল নেই বলে না। শত খারাপ থাকলেও না।
“ এইতো ভাল। তুই কেমন আছিস? “
“ আমি তো ভাল, দুলাভাই কী করছে? “
“ হিসাবনিকাশ করছে। “
“ আচ্ছা আপা শোন, আমি কালকে তোর বাসায় আসছি। জরুরী কথা আছে। ফোনে বলা যাবে না। ”
এই কথাটা শুনে নীরার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। গতবার নীহাকে এক প্রকার তাড়িয়েই দিয়েছিল হাসান! ছোট্ট মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে এসেছিল বোনের সাথে কদিন থাকবে। সংসারে নাকি ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল বেশি। সেজন্য নীহাকে চলে যেতে হয়। নীহা অবশ্য আসল ব্যাপারটা বুঝেনি। আচ্ছা, আয়। আর শোন, পারলে ডাব আনিস কয়েকটা তোর দুলাভাইয়ের জন্য। গরম তো। দুপুরে খেলে ভাল লাগবে উনার। ফোন কেটে দিতেই হাসান বলল।
“ তোমার বোন আসছে? ”
“ হ্যাঁ, জরুরী একটা কথা বলতে চাচ্ছে। ফোনে নাকি বলতে পারবে না। ”
“ আসবে ভাল কথা। এক দুদিনের বেশি থাকতে দিও না। দিনকাল ভাল না। চারদিকে খালি ধর্ষণ হচ্ছে। নিজের বাড়িতে থাকলে মেয়েটা সেফ থাকবে। নীরার নরম গলায় উত্তর।
“ আচ্ছা। ”
হাসান জানে বাতি না নিভালে নীরা ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু সে নিভাচ্ছে না। নাকি ভুলেই গিয়েছে বাতি নিভানোর কথা কে জানে? জ্বর জ্বর লাগছে নীরার। হাসনকে এই কথা বললে উত্তর দিবে, এটা কিছু না। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে। একবার জ্বর হয়েছিল তাঁর। বেশ ভাল জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না। হাসান শুধু দুই প্যাকেট নাপা এনে দিয়েছিল। নীরা আশা করছিল হাসান কমপক্ষে বাসায় ডাক্তার নিয়ে আসবে। কিন্তু তাঁর আশায় গুড়েবালি। হাসানের এমন আচরণ দেখে মনে হয় জ্বর ভয় পেয়েছিল। সে রাতেই জ্বর কমে যায়! ভোর রাত্তিরে দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। হাসান খুব বিরক্ত হলো। নীরা উঠে গিয়ে দরজা খুলল। হাতে তিনটা ডাব নিয়ে নীহা দাঁড়িয়ে আছে।
আপা, খুচরা টাকা থাকলে দে। রিকশা ভাড়া। নীরার কাছে দেড়শ টাকা ছিল। অনেক দিন ধরেই শাড়ির আঁচলে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। ডাবগুলো নীরার হাতে দিয়ে নীহা ভাড়া দিতে চলে গেল। নীহার পুরো নাম নীহারিকা আক্তার। আর জন্মের পর থেকেই নীরা নীরব থাকতে পছন্দ করে। সেজন্যই তাঁর নাম নীরা। নীরবতার সঙ্গে মিল রেখে নাম। ভাড়া দিয়ে নীহা উপরে চলে আসলো। সোফায় বসিয়ে তাঁর বড় বোন জিজ্ঞেস করল।
“ আস্তে কথা বল। তোর দুলাভাই ঘুমাচ্ছে। সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলে রাগারাগি করে। “
“ বুঝতে পারছি আমি। “
“ আচ্ছা এখন বল কী খাবি? কি নাশতা করব? “
“ যা রান্না করো তাই। তোমার রান্নার হাত তো খুব ভাল। নীরার রান্নার প্রসংশা তাঁর ছোট বোন কোনো কালেই করেনি। বিয়ের পরে করছে। বিয়ের পরে নাকি হাতের রান্না ভাল হয়েছে।
“ আয় তাহলে, রান্না করতে করতে বাড়ির আলাপ করি। রান্নাঘরে ঢুকলো দুজন। নীহা এবার দশম শ্রেণীতে পড়ে। দেখতে সুন্দরী হওয়ায় বাবা থাকে খুব চিন্তায়। কখন না জানি কোন কুকুর থাবা মারে! পাত্র দেখছেন তিনি। ভাল ঘর পেলেই বিয়ে দিয়ে দিবেন।
“ বাবা কেমন আছে রে? “
“ ভাল আছে, তুই জানিস বাবা আমার জন্য পাত্র দেখছে? কদিনের মধ্যেই নাকি বিয়ে দিয়ে দিবে। “
“ তো বিয়ে দিবে না? আমার বিয়ে দেয়নি? “
“ কিন্তু তুই তো আপা বড় হয়েছিস। আমি তো অনেক ছোট। “
নীরাও জানে তাঁর বোন খুব ছোট। কিন্তু কিছুই করার নেই। গরীব ঘরের মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়। দেরি করলে মানুষ নানান কথা বলে। ভাতের হাড়ি বসিয়েছে নীরা। তাঁর আবার পান চিবানোর অভ্যাস আছে। কিন্তু বিয়ের পরে আর পান খাওয়া হয় না। হাসান বলে পান খেলে দাঁতের ক্ষতি। নীহার কথার উত্তর দিল তাঁর বড় বোন।
“ বিয়ে যখন হবে তখন দেখা যাবে। এখন তোর গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বল। নীহার চুলগুলো বেশ বড়। নীরার দুই গুন। নীরার চেয়ে ফরসাও বেশি। কিন্তু নীরা লম্বা অনেক। এজন্য সুন্দর লাগে বেশি নীরাকে।
“ আমার পাঁচ হাজার টাকা লাগবে আপা। একটা কাজ করব। ” নীরা হাঁ করে বলল।
“ পাঁচ হাজার? এত টাকা দিয়ে কী করবি? “
“ সেটা বলতে পারব না এখন।
দিবি কিনা বল? বাবা তো দিবে না তুই জানিস। তাই তোর কাছে চলে আসলাম। নীরা পড়ে গেল চিন্তায়। হাসানের কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাইলে হয়তো বাসা থেকেই বের করে দিবে! নীরার চিন্তিত মুখ দেখে ছোট বোন বলল আবার।
“ কী হলো আপা, দিতে পারবি না? নীহার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় কলিজাটা খুলে দিতে নীরার। কি লক্ষ্মী দেখতে মেয়েটা। এত নিস্পাপ। এই মেয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। যে কোনো ভাবেই হোক সে টাকাটা বের করে দিবে।
“ আচ্ছা, টাকা তো কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তুই করবিটা কী টাকা দিয়ে? খারাপ কিছু না তো? “
“ আপা, তুই আমাকে চিনিস না? আমি খারাপ কিছু করতে পারি? ”
নীরার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর ছোট বোন কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না। আটটার দিকে হাসানের ঘুম ভেঙ্গেছে। দুবোন তখন সোফায় বসে গল্প করছিল।
“ কেমন আছেন দুলাভাই? “
“ ভাল, তুমি কেমন আছো? ”
“ ভাল, মার্কেটে যাবেন কখন? “
“ নাশতা করে। ”
হাসানের বিরক্ত লাগল এই কথাটার উত্তর দিতে। তাঁর নিজের দোকান আছে নিউমার্কেটে। যখন খুশি তখন যাবে। অন্য কেউ জিজ্ঞেস করার কে? টেবিলে ভাত, ডাল আর কৈ মাছের ঝোল রাখা আছে। হাসান হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসেছে।
“ নীহা, মোটা হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। নিজের দিকে এখন একটু খেয়াল রাখা দরকার। “
নীহা কথাটা নেহায়েত মশকরা ধরে নিয়েছে। নীরা বুঝতে পেরেছে তাঁকে এই কথা বলে বারণ করে দিয়েছে। ভাল মন্দ না রান্না করতে। বাজার করতে যেন না বলে। চোখের কোণে এক ফোঁটা জল এসেছে। খুব সুন্দর করে লুকিয়ে রেখেছে সে। কেউই খেয়াল করল না।
“ কেন দুলাভাই? নিজের দিকে এখনই কেন খেয়াল রাখা দরকার? কদিন পরে খেয়াল রাখলে হবে না? “
“ যা বলছি তা শুনো। অতিরিক্ত কথা বলবে না। ”
নীহা আর কথা বাড়ায়নি। দোকানে যাবার সময় হাসান টিভির রিমোট সাথে করে নিয়ে গেছে। এর কারণ আছে। দুবোন যেন বাড়িতে বোরিং হয়ে যায়। টিভি থাকলে তাঁরা সারাক্ষণই নাটক দেখে। নীহা জিজ্ঞেস করল।
“ আপা, দুলাভাই রিমোট নিয়ে গেল কেন। ”
“ রিমোটটা নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়। ঠিক করে আনবে। ”
নীহা তাই বিশ্বাস করল। হাসান কোথায় টাকা রাখে নীরা জানে না। বিয়ের দুই বছর হয়ে গেছে তাও বলবে পারবে না হাসান কোথায় টাকা রাখে। পাঁচ হাজার টাকা সে এখন পাবে কোথায়? এক জোড়া স্বর্ণের দুল দিয়েছিল মা বিয়ের সময়। সে দুলগুলো ছাড়া তাঁর কাছে পাঁচ হাজার টাকা হবে বিক্রি করলে, এমন কিছুই নেই! সেই কানের দুল দুটো দিলে নিশ্চিত নীহা নিবে না। বিক্রি করে টাকা দিয়ে দিলে বুঝবে না। কিন্তু কানের দুলগুলো বিক্রি করে টাকা এনে দিবে কে? এমন লোক মনে মনে খুঁজছে নীরা। হঠাৎ করেই নীহা বলে ওঠল।
“ চল আপা, বোরকা পরে দুলাভাইয়ের কাছে যাই। তারপর অনেক কিছু নিয়ে টাকা না দিয়ে চলে আসি। মজা হবে। ”
“ না রে, তোর দুলাভাই এমন মজা পছন্দ করে না! ”
“ তাহলে কেমন মজা পছন্দ করে? “
“ ইদানীং কিজানি হয়েছে উনার। বেশি কথা পছন্দ করে না। ”
“ আরে কিচ্ছু হবে না। চল আপা দুলাভাইয়ের কাছে যাই। ”
নীহার জোরাজুরি। নিউমার্কেটে যাবে দুজন বোরকা পরে। হাতেও মৌজা লাগানো থাকবে। মুখোশ থাকবে, চোখে থাকবে চশমা। তারপর হাসানের দোকানে গিয়ে অনেক কিছু নিবে। টাকা না দিয়েই চলে আসবে! হাসান যদি আটকায়ও, তাঁরা মুখোশ খুলবে না। লোকজন জড়ো করলে মুখোশ খুলবে। তখন হাসানের রিয়্যাক্টটা দেখার মত হবে। বোরকা পরে দুজন বের হয়েছে। নীরার উদ্দেশ্যে হলো কানের দুল দুটি বিক্রি করা। নিজের কানের দুল। তবু হাসান জানতে পারলে বকবে। বকুক, তবুও সে বোনের আবদার ফেলতে পারবে না।
নিউমার্কেটে যাওয়ার পর নীরা বলল, “ তুই এক কাজ কর, তোর দুলাভাইয়ের দোকানে গিয়ে যা যা নিতে মন চায় নিতে থাক। আমি একটা ছোট্ট কাজ করে আসছি। নীহা তাই করলো। হাসানের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। এর ফাঁকে নীরা কানের দুল দুটি বিক্রি করলো। ওজন খুব কম। দাম হয়েছে মাত্র পনের হাজার টাকা। টাকাগুলো নিয়ে সেও হাসানের দোকানের দিকে রওনা হলো। হাসানের বিশাল দোকান। কাপড়চোপড় আর কসমেটিকস মিলিয়ে কোটি টাকার মাল আছে। নীহা ইতিমধ্যে কিছু কাপড়চোপড় পছন্দ করে ফেলেছে। নীরা হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রেতার সাথে ব্যস্ত। কথা বলছে। চেহারায় মায়া আছে একটা। অদ্ভুত মায়া। নিজের বউয়ের সাথে খিটখিটে মেজাজ দেখালেও, ক্রেতাদের সাথে কত সুন্দর ব্যবহার। নীহা কনুই দিয়ে হালকা করে ধাক্কা দিল।
“ আপা, কী দেখ হাঁ করে? বাসায় দেখ না? ” নীরা জবাব দিল।
“ শোন, কিচ্ছু নিস না এখান থেকে। তোর দুলাভাই খেপবে খুব। বাসায় গিয়ে তখন চিল্লাচিল্লি করবে। আয় তোকে অন্য দোকান থেকে জামা কিনে দিচ্ছি। ” নীহাকে মানাতে খুব কষ্ট হলো। অন্য দোকান গেল দুজন।
“ শাড়ি কিনে দিব? ”
“ অমা, শাড়ি দিয়ে আমি কী করব? ”
“ কাল পরশু বিয়ে হয়ে গেলে তখন শুধু শাড়ি লাগবে। ”
নীহা কথাটা শুনে ভেঙচি কেটেছে। কিন্তু মুখ ঢেকে রাখার কারণে বড় বোন বুঝতে পারেনি। আসলে নীরারই শাড়ি দরকার কয়েকটা। ঘরে পরার জন্য। কম দামি শাড়ি। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচটি শাড়ি কিনল তাঁরা। সবকটার রঙ হালকা লাল। শাড়ি নিয়ে আবার বাসার দিকে রওনা দিল দুজন। রিকশায় বসে আছে। এসেছিল বাসে করে। নীহা জিজ্ঞেস করল।
“ আচ্ছা আপা, তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে। চারটে শাড়ি তুই রাখ। আমি একটা নেই। কি বলিস? ”
“ নাহ, আমার দুইটা হলেই হবে। একটা আম্মাকে দিবি। আর বাকি দুইটা তোর। ”
“ আচ্ছা, টাকাগুলো কোথায় পেয়েছিস? ”
“ আমি টাকা কোথায় পাব তোর দুলাভাই না দিলে? আমার কি কামাই আছে? ” নীহা স্বস্তির নিশ্বাস নিল।
“ দুলাভাই তোকে অনেক ভালোবাসে না? ”
“ বিয়ে করেছে ভালোবাসবে না? “
“ তাও কথা। ”
রিকশা ভাড়া দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয় বাসা পর্যন্ত যেতে। চার তলা একটা দালানের দুতলায় তাঁরা থাকে। তখন দুপুর দুইটা বাজে। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছে দুজন। খাওয়ার এক পর্যায়ে নীরা বলল।
“ টাকাগুলো তোর দুলাভাই দিয়ে গেছে। বড় কষ্টের টাকা। কোনো খারাপ কাজে ব্যবহার করবি না ওয়াদা কর? ”
“ থাক, তোমার টাকা লাগবে না। ”
“ অহেতুক রাগ করিস না। আর কোথাও তুই টাকা পাবি না। ”
“ তো আপা আমি কি খারাপ কাজ করব টাকা দিয়ে? “
“ নাহ। আমার মনে হয় নাহ। তবুও সাবধান। পাঁচ হাজার টাকার ব্যাপার। ”
ছোট বোনের হাতে টাকাগুলো দিয়ে আবার নীরা বলল।
“ সাবধানে যাস। তুই তো রাস্তায় চললে হুঁশ থাকে না। নীহা অবাক হয়ে বলল।
“ আপা, আজকেই চলে যাব? ”
“ হুম, আজকেই চলে যাবি।
তোর দুলাভাইয়ের কিছু আত্মীয় আসবে বাসায় সন্ধ্যায়। তাঁরা তোকে পছন্দ করে ফেলতে পারে। আমার সেই ভয় হচ্ছে। তাই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুই না বিয়ের জন্য রেডি না? নীহা বরাবরই বিয়েকে ভয় পায়। তাই বোনের কথা মেনে নিল। পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চলে এলো। নীহা চলে আসার পরে অনেকক্ষণ তাঁর বড় বোন কান্না করেছে। একলা বাড়িতে কান্না করলে এক সুবিধা আছে। কেউ শুনতে পায় না। শান্তনাও দিতে আসে না। হাসান বাসায় ফিরেছে রাত এগারটার দিকে। বাসায় নীহাকে না দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। এরকম হাসি কখনোই হাসানের মুখে থাকে না।
“ নীরা, ইউ লুক ড্যাম টুনাইট! এই ইংলিশ বাক্য শুনে নীরার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা!
“ এর মানে কী? ”
“ তোমাকে আজকে অস্থির লাগছে। ”
“ অন্যদিন লাগে না? ”
“ লাগে, কিন্তু আজকে বেশি লাগছে। আচ্ছা নীহা কি চলে গেছে? “
“ হুম। ”
“ ওর জরুরী কথাটা কী ছিল? ”
“ বাবা নাকি বিয়ের জন্য পাত্র দেখছেন। ও বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। ”
“ বিয়ের প্রথম দিকে কোনো মেয়েই প্রস্তুত থাকে না। হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যায়। ”
শোবার রুমে আয়নাটা খুব ছোট। নীরার খুব অসুবিধে হয় চুল আঁচড়াতে। আজকে মনে হয় হাসানের এই বিষয়টা চোখে পড়েছে।
“ নীরা। “
“ হুঁ। ”
“ তোমাকে একটা বড় আয়না এনে দিব কালকে। ”
“ কী দরকার? এতেই তো হয়। ”
“ দরকার আছে। এতে হয় না। ”
নীরা ভাবছে লোকটা এমন কেন? এখন যদি নীহা বাসায় থাকত। এই কথাগুলো কখনোই সে বলত না। উল্টো আরো মন মেজাজ খারাপ থাকত।
“ নীরা। “
“ হুঁ। “
“ ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? আমার কাছে আসছো না কেন? “
“ মাথা ব্যথা তো। তাই ভাবছি আজকে একটু পরে ঘুমাব। “
“ তোমার মাথা ব্যথা আমি দূর করে দিচ্ছি আসো। নীরা বসেই রইল আয়নার সামনে। এবার হাসানের কড়া গলা।
“ কী হলো? কথা শুনতে পাচ্ছ না? ”
চিরুনিটা রেখে নীরা বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। পাঁচ হাজার টাকা এনেছে নীহা খুব কঠিন একটা জিনিস কেনার জন্য। কঠিন জিনিসটার নাম পিস্তল! একজনকে খুন করবে সে। একটা জানোয়ারকে। জানোয়ারটার নাম হাসান! তাঁর আপন বোনের স্বামী! বিয়ের পরে যখন শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসতো হাসান নীরাকে নিয়ে। তখন মাঝ রাত্তিরে হুটহাট নীহার রুমে ঢুকে যেত! প্রথম দিন ভেবেছিল দুলাভাই ভয় দেখাতে ঢুকেছে। কিন্তু না। দুলাভাই কামনাদ্যোতক নিয়েই ঢুকত! কানের কাছে গিয়ে বলত। চুপ নীহা, বাড়াবাড়ি করে কাউকে বলতে গেলে তোমার জীবনও নষ্ট হবে। তোমার বোনেরও। চিল্লাচিল্লি করলে তোমার বোনকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব একদম। ”
নীহার কাছে তাঁর বোন জীবনের চেয়েও বেশি কিছু। দুনিয়াতে সে আছে কিন্তু নীরা নেই! এটা সে কল্পনা করতে পারে না। নীরবে সহ্য করে গেছে সব। একদিন জিজ্ঞেস করেছিল নীহা, “ আপনার এত টাকা পয়সা তো গরীব ঘরে বিয়ে করলেন কেন? হাসান জবাব দিয়েছিল।  এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য। বুঝনি? আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছো। এই কথাগুলো নীহা কাউকে বলতে পারে না। কাকে বলবে? মাকে? বাবাকে? নাকি নীরাকে? নীরা জানলে প্রথম দিনই আত্মহত্যা করবে! পেটে বাচ্চা এসে গেছে নীহার। কত খুশির কথা। কিন্তু কাউকেই সে বলতে পারছে না! বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে হবে!
নীরাকে পাঁচ বছরের আগে বাচ্চা ধরতে মানা করেছে হাসান। জীবনে উপভোগ বলতেও একটা শব্দ আছে। খুব কষ্ট করে পিস্তল জোগাড় করেছে সে। পিস্তলটা হাঁতে নিলেই কেমন শরীরে জ্বর ওঠে! কিন্তু হাসানকে খুন না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না। হাসান কোনোদিনো নীরাকে বাচ্চা নিতে দিবে না। কদিন পর বাচ্চা নেওয়ার কথা বললে আরেকটা বিয়ে করবে নিশ্চিত। এই মুহূর্তে বউ রেখেও তাঁর তিন তিনটে প্রেমিকা আছে! এসব জেনেছে নীহা অনেক আগেই। নীরা কিছুই জানে না। দিনদিন ঠকে যাচ্ছে। বোরকা পরে রওনা দিল নীহা নিউমার্কেটের উদ্দেশে। দোকানের ভেতরেই গুলি করবে। মানুষজন গুলির আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে পালায়। কোনো সমস্যা হবে না। দুপুরের দিকে ক্রেতা কম থাকে। নীহা ঢুকতেই হাসান জিজ্ঞেস করল। “ আসসালামু আলাইকুম আপা, কী লাগবে আপনার? ”
নীহা কোনো জবাব না দিয়ে বোরকার ভেতর থেকে পিস্তল বের করে হাসানের বুকে একসাথে তিনটে গুলি করল! রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারদিকে। মানুষ দৌড়ে পালাল সব। নীহা খুব চালাকির সাথে বেরিয়ে এসেছে। হাসানের মৃত্যুর খবর শোনা মাত্রই নীরা অজ্ঞান হয়ে যায়। হাসপাতালে থাকে সাতদিন। এর মাঝে হাসানের দাফনও হয়ে যায়! হাসানের কবরটা দেখতে গেছে দুজন। নতুন কবর। কিছু মাটি হাতে নিয়ে নীরা হাসানের কবরে দিচ্ছে। “ নীহা, কাজটা তুই ভাল করিসনি! উনাকে একবার বিয়ের কথা বলেই দেখতি! আমি নাহয় মারা যেতাম। আজকাল হয় না এমন? বড় বোন মারা গেলে ছোট বোনকে স্বামী বিয়ে করে? ” নীহা হাঁ করে বড় বোনের দিকে তাকিয়ে রইল!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত