শেষ দেখা

শেষ দেখা
এই নিয়ে নয় বার রিং হচ্ছে। ফোনটা ধরছে না। বুকটা ধুকধুক করছে। পাগলীটা নিশ্চই অনেক রেগে আছে। রাগবেই তো। গত এক সপ্তাহ ধরে এতবার কল দিয়েছে সরি লিখে মেসেজ দিয়েছে। ধরি নি। মেসেজের উত্তর দেই নি। বিরক্তি আসাটা স্বাভাবিক। রাগ করে গতকাল থেকে কল দিচ্ছে না। যখন কলের উপর কল দিচ্ছিল তখন রিসিভ করি নি। আর এখন কল দিচ্ছে না বলে বুকের কোথায় যেন ব্যথা করছে। বাধ্য হয়ে থাকতে না পেরে আমিই কল দিচ্ছি। এখন আর পাগলীটা রিসিভ করছে না। অভিমান করেছে খুব।
আমি নেহাল। আমার প্রেমিকা নিসা। প্রেমিকা বললে ভুল হবে। আমি ওকে শুধুমাত্র প্রেমিকার চোখে দেখি না। প্রেমিকা, বউ, জীবনসঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনীর চোখে দেখি ওকে। ছোট একটা চাকরি করি আমি। বাবা মা আর ছোট ভাই কে নিয়ে আমার পরিবার। বিয়েটা অনেক আগেই সেরে ফেলতাম। কিন্তু একটা ভাল চাকরির অপেক্ষা করছি। যে সামান্য বেতন পাই তাতে পরিবার চালাতে হিমশিম খেয় যাই। এর মধ্যে নিসাকে এনে ওকে কষ্ট দিতে চাই না।
কিছুদিন অপেক্ষা করছি। ভাল চাকরির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কয়েক জায়গায় কথাও হয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই ভাল কিছু হবে আশা করি। তখন পাগলীটাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। দূরে থাকলে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। কাছে নিয়ে আসলে সব ঝগড়া শেষ হবে। তখন শুধু ভালবাসব। আমার মা নিসাকে খুব স্নেহ করেন। রূপে যেমন মায়াবী আচরণে তেমন বিনয়ী কাজে তেমন পারদর্শী। আমার গায়ের রঙ ফর্সা হওয়ার কারণে মায়ের ইচ্ছা ছিল আমার জন্য লাল টুকটুকে একটা বউ আনবেন। নিসার সাথে রিলেশনের পর মায়ের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেই। মা ওকে বিশেষ পছন্দ করেন নি তখন। মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা। মায়ের ভাল লাগে নি। মায়ের কথা তার ফর্সা ছেলের সাথে শ্যামলা মেয়েকে মানাবে না।
মায়ের মুখের ওপর কথা বলি নি সেদিন। মাকে কষ্ট দেই নি। আবার নিসাকেও ছাড়ি নি। গর্ভধারিণী মাকে কোনভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আবার ভালবেসে যার হাত ধরেছি, সারাজীবন একসাথে থাকার ওয়াদা করেছি, তার হাতও ছাড়তে পারব না। কয়েকদিন ধরে মাকে বোঝালাম। মা বুঝতে রাজী নন। এদিকে নিসাকেও কথাটা খুলে বলতে পারছি না। মেয়েটা কষ্ট পাবে। যেভাবেই হোক মাকে মানাতে হবে। এ নিয়ে একদিন মায়ের সাথে গভীর আলোচনায় বসলাম।
– তুই আমার বিরুদ্ধে যেতে চাস?
– কি যে বলো না মা। আমি তোমার বিরুদ্ধে যাব কেন? তোমার উপরে কখনও কথা বলেছি?
– তবে আজ বলছিস কেন?
– কেন বলছি জানো মা? কারণ এখানে প্রসঙ্গটা আমার সারাজীবনের সাথে জড়িত। মৃত্যু পর্যন্ত আমি কারো সাথে থাকব। তাহলে আমার কি অধিকার নেই তাকে পছন্দ করে বিয়ে করার? আচ্ছা মা তুমি বলো, কখনও তোমার অবাধ্য হয়েছি?
– না হোস নি। তাহলে আজ হচ্ছিস কেন?
– না মা। আমি তোমার অবাধ্য হচ্ছি না। আমি তোমাকে বোঝাচ্ছি। যার সাথে সংসার করব তার রূপের চেয়ে চরিত্র, আচরণ, গুণাগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা মা একটা কথা বলো
– কি?
– তুমি চাও একটা সুন্দর লাল টুকটুকে বউ মা। আচ্ছা,, সেই মেয়েটা যদি তোমাকে আর বাবাকে ভাল না বাসে? যদি সম্মান না করে? যখন তোমরা বুড়ো হয়ে যাবে তখন যদি একবেলা রান্না করে না খাওয়ায়? তখন কি করবে মা তার সুন্দর চেহারা দিয়ে?
– মা, আমরা সবাই সৌন্দর্য ভালবাসি। কিন্তু বাইরের সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যটা বেশি জরুরী। যার সাথে আমি সারাজীবন ভাল থাকব, যে আমাকে সারাজীবন ভাল রাখবে, তার বাইরের সৌন্দর্যটা আমার কাছে কোন গুরুত্ব রাখে না। তবুও তুমি যদি ওকে না মেনে নাও, তোমার অনিচ্ছায় আমি কখনও ওকে বিয়ে করব না। তবে হয়ত সারাজীবন আফসোস করব, মা একটা সুযোগ দিলে আজ আমি অনেক ভাল থাকতাম। মনে হল আমার কথা মায়ের মনে ধরেছে। মা চুপ করে আছেন। তার মানে মা ভাবছেন কি করা যায়। আর মা যখন ভাবছেন তার মানে অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে।
– আচ্ছা বেশ। তাহলে আমি ওকে পরীক্ষা করতে চাই
– নিশ্চই। তোমার পুত্রবধূ তুমি যেভাবে ইচ্ছা পরীক্ষা নাও। আমার কোন আপত্তি নেই
– ওকে বাসায় নিয়ে আয়।
– আচ্ছা মা। সামনের শুক্রবার নিয়ে আসব।
নিসা এসবের কিছুই জানতে পারল না। নিসার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম মা যেভাবেই পরীক্ষা নেন না কেন। ও পাশ করবেই। ওকে বাসায় নিয়ে এলাম। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। নিসা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলত খোঁজ খবর নিত। ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বাসায় আসত। রান্না করত। ওর রান্না খেয়ে মা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ধীরে ধীরে নিসা আমার পরিবারের সবার মন জয় করে নিল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এখন আর মায়ের নিসাকে নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। এখন শুধু একটা ভাল চাকরির অপেক্ষা।
এক সপ্তাহ আগে নিসাকে রাত এগারোটায় ফোনে ওয়েটিং পাই। জিজ্ঞেস করলে বলে ওর অফিসের কলিগের সাথে কথা বলছিল। আমি ব্যাপারটা নিয়ে রেগে যাই। ও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে অফিসের কাজের কথা বলছিল। আমি শুনি নি। বলেছিলাম এত রাতে অফিসের কাজের কথা বলতে হবে কেন? দিনের বেলা কি করেছে?
ও আমাকে যতই বোঝায় আমি মানতে চাই নি। রাগ করে ফোনটা দুদিন বন্ধ রাখি। দুদিন পর ফোনটা অন করার সাথে সাথে অনেকগুলা মিসড কল এলার্ট। আর অনেক মেসেজ। তাতে অনেক কিছু লিখা। ফোনে কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করেছে। সরি বলেছে। অনেক ভালবাসে বলেছে। তবুও আমার রাগ কমেনি। তারপর আরও অনেকবার কল দিয়েছে। আমি রিসিভ করি নি। কিন্তু কাল থেকে ওর কোন কল মেসেজ আসে নি। এতদিন চেষ্টা করেও যখন আমার রাগ করে নি পাগলীটা এবার অভিমান করে বসে আছে। বুঝতে পারছি এবার আমাকেই সরি বলতে হবে। আমাকেই ওর অভিমান ভাঙাতে হবে। যতই রাগ করে কথা না বলে থাকি না কেন, ভালবাসাটা তো কমে নি। একটু নিখোঁজ থাকলেই মনটা ছটফট করে।এগারো বার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হল।
– হ্যালো
– কে মিশু? কেমন আছ? তোমার আপু কোথায়? সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি
– নেহাল ভাইয়া!!
– কি হয়েছে মিশু? তোমার কথা এমন শোনা যাচ্ছে কেন? নিসা আবার বকেছে? ওকে কতবার বলেছি তোমাকে যেন না বকে। ফোনটা ওকে দাও। আমি ইচ্ছামত বকে দিব
– নেহাল ভাইয়া….
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল নিসার ছোট বোন মিশু। বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। যতই জিজ্ঞেস করছি মিশু ততই কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে।
– মিশু কিছু তো বলো। কি হয়েছে আপু?
– ভাইয়া, কাল সকালে আপু এক্সিডেন্ট করেছে
– কি???? ও এখন কোথায়? কোন হাসপাতালে?
– বাড়িতে
– বাড়িতে কেন? এক্সিডেন্ট করেছে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও নি? বেশি আহত হয়েছে?
– ভাইয়া আপনি বাসায় আসেন। এক্ষুণি
– আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি বের হলাম। আধাঘন্টা লাগল নিসাদের বাসায় পৌছাতে। বাসায় ঢুকতেই দেখলাম অনেক মানুষের ভীড়। সবাই কান্নাকাটি করছে। বুকের ভেতর আরও মোচড় দিয়ে উঠল। আমাকে দেখেই নিসার মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিশু দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। দূরে একটা খাটিয়া দেখলাম। দেখেই আমার দু পা স্থির হয়ে গেল। সামনে এগোতে পারছি না। খাটিয়ায় কে শুয়ে আছে? আন্টি আর মিশু এত কান্না করছে কেন? তবে কি নিসা??? না না এসব কি ভাবছি। এটা হতেই পারে না
– মিশু আমাকে বলো কি হয়েছে। নিসা কোথায়?
– মিশু বলো আপু। নিসা কোথায়?
মিশু অদুরে রাখা খাটিয়া দেখাল। নিসা ওখানে শুয়ে আছে। পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে আমার পাগলীটা। আর কোনদিন ওর ঘুম ভাঙবে না। আমার পা চলছে না। শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। মাটিতে বসে পড়লাম।
– কিভাবে কি হল? আমাকে জানান নি কেন আন্টি?
– কাল সকালে নিসা রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে। হাসপাতালে নিয়ে যাই।
খুব খারাপ অবস্থা ছিল। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। সারাদিন রক্ত জোগাড় করেছি। যতই রক্ত দেওয়া হচ্ছে ওর রক্তক্ষরণ থামছে না। ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিল বাঁচানো যাবে না। তবুও চেষ্টা করেছি যদি শেষ রক্ষা হয়। কিন্তু হল না। আজ ভোরে আমার মেয়েটা কথা বলতে পারছেন না আন্টি। ওনার কান্না থামানোর শক্তি আমার নেই।
– আমাকে একটি বার জানাতেন!!
– কি করব বাবা বলো। আমাদের অবস্থা এমন ছিল যে তোমাকে জানানোর ব্যাপারটা মাথায় আসে নি।
– বুঝতে পারছি।
নিসার মুখটা আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। নিসার জন্য আমি বেগানা পুরুষ। আর ইসলামে বেগানা পুরুষকে মৃত মহিলার মুখ দেখতে দেওয়া হয় না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়েটা হয়ত আমাকে ভেবেছে। হয়ত আমাকে খুঁজেছে। একটিবার কথা বলতে চেয়েছে। শেষ দেখাটা আর হল না। শেষ কথাটা আর হল না। শেষ বার বলা হল না “ভালবাসি”।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত