আইরিন আর কেয়া খুব ভালো বন্ধু। দুজনে একই কলেজে পড়ে।খুব ভালো ছাত্রী দুজনেই।তাদেরই কলেজে একই ক্লাসে পড়ে আরিয়ান মাহাবুব রাজ।সবাই যাকে বখাটে রাজ বলেই চিনে।ক্লাসে সবচেয়ে অমনোযোগী ছেলেটা।প্রতিদিন ওর নামে বিচার আসেই।ছেলেটা সব সময় মাস্তানি করে বেরাই।আর কলেজে এসে সবার সামনে সিগেরেট খাই। এজন্যে আইরিন ছেলেটিকে দুচোখে দেখতে পারেনা। একদিন আইরিন কলেজে যাচ্ছে এমন সময় রাজ নামের ছেলেটি ওর সামনে এসে বলল…….
রাজ:-আই লাভ ইউ আইরিন।(ফুল দিয়ে)
আইরিন:-তোর মতো ফালতু ছেলেকে ভালোবাসবো আমি যা দূর হ আমার সামনে থেকে।(ফুলটা ফেলে মাটিতে পিষে দিলো) আইরিন চলে গেলো।এদিকে রাজ নামের বখাটে ছেলেটি কান্না করে ফেললো।সে আইরিনকে খুব ভালোবাসে।মন খারাপ করে চলে গেলো নদীর পাড়ে।ইমন ও মেহেদী আসলো নদীর পাড় এ। কারন রাজ সবসময় নদীর পাড় এ বসে থাকে।
ইমন:-দোস্ত মন খারাপ ক্যান তোর।
রাজ:-না রে বন্ধু মন খারাপ নয়।
ইমন:-আমার কাছেও ফাকি দিচ্ছিস।
রাজ:-আমি আইরিনকে ভালোবাসার কথা জানালে সে রিজেক্ট করেছে।আমাকে ফালতু বলেছে।(কান্না করতে করতে)
ইমন:-কষ্ট পাস না সোনা।
আমি:-হুম চলো বাসায় যায়।
বাইক নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। পরিচয়টা দিয়ে দেই….আমি আরিয়ান মাহাবুব রাজ।ধনী বাবা মায়ের ছেলে।বাবা মা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে আর ছেলে বাইক নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারামারি করে বেরাই। বাইক নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।এসে দেখি বাবা মা ঝগড়া করছে।
আব্বু:-কি ছাতা রান্না করে রাখো খাওয়া যায়না ভালো কিছু রান্না করা যায় না।
আম্মু:-যা রান্না করেছি তার চেয়ে আর ভালো পারিনা ইচ্ছে হলে কেও খাক না হলে না খাক।
আব্বু:-তোর এতো বড় সাহস কথা বলিশ মুখে মুখে যা খা তুই বেশি করে।(গরম খাবার ফেলে দিলো আম্মুর গায়ের ওপর)
আম্মু:-উহ (কান্না করে দিলো) আম্মুর হাতে গরম খাবার পরে পুড়ে গেছে হাত।আম্মু কান্না করছে।
আব্বু:-যা তোর মতো কাওকে আমার লাগবেনা তুই চলে যা তোর যেখানে ইচ্ছা।
আম্মু:-যার সমস্যা সে যাক।
আব্বু:-কি বললি তুই।(চুল ধরে)
আম্মু:-চুল ছাড়ো লাগছে।
আব্বু:-তোকে একদম মেরে ফেলবো। তোর এতো বড় সাহস।
আমি:-আব্বু ছাড়ো কি করছো ছাড়ো।
আব্বু:-আমি যা ইচ্ছা তাই করবো তোর কি যা তোর রুমে যা।
আমি:-আগে ছাড়ো তারপর।
আব্বু:-যা রুমে যা।(চিৎকার করে)
আম্মু:-রাজ যাও রুমে যাও।
চলে আসলাম রুমে।কিছুই ভালো লাগছেনা।রাত ১-০০ তখন বাইরে বেড় হলাম।কি সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ। কেও রাস্তায় নাই।মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি তার আপন গতিতে চলে যাচ্ছে।শুধু ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। ল্যামপোস্ট এর আলোটা ক্রমশ বাড়ছে। আচ্ছা কি আছে এই বাতি গুলোতে যে কোনো তার বা বিদ্যুৎ লাগেনা।রৌদ্র তাপে জ্বলে।তাহলে কি এই বাতিটার মনে আমার মতো দুঃখ। এই বাতিটাও কি জ্বলে পুড়ে ছাড়কার হয়ে তারপর তার শরীরে আগুন জ্বলে ঝলসে পড়ে। আমারও তো কষ্ট।আমি কি কখনও একটু সুখের দেখা পাবোনা। এই ল্যামপোস্ট তুইতো জ্বলে পুড়ে অন্যদের পথ দেখাচ্ছিস।কিন্তু আমি তো পারিনা তোর মতো জ্বলতে। আমার দহন এর আগুন দেখা যায়না। বলনা আমি কি করবো।এসব ভাবতে ভাবতে ফযরের আযান হয়ে যায়।রাজ আবার তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুম থেকে উঠে দেখে সকাল ১০ টা বাজে।
রাজ:-আম্মু আম্মু কোই তুমি?
আলো:-ভাই জান আম্মা তো বাসায় নাই অফিসে গেছে।(কাজের মেয়ে)
আমি:-ওহ্ ওকে তুই কিছু খেয়েছিস বোন?
আলো:-না ভাইজান। আপনি আগে খেয়ে নেন তারপর খাবো।
আমি:-আমি পরে খাবো।যা তুই খেয়ে নে। আর আম্মুকে বলিস আমি খেয়েছি। বাইকটা নিয়ে চলে আসলাম কলেজে। এসে আইরিনকে গিয়ে বললাম…..
আমি:-আইরিন আই লাভ ইউ।
আইরিন:-ঠাস্ ঠাস্।তোর মতো ছেলেকে আমি ভালোবাসিনা আমি ঘৃনা করি।
আমি:-কেন আমার মধ্যে কি কোনো জিনিসের কমতি আছে যে ভালোবাসা যায়না ঘৃনা করা যায়।
আইরিন:-তোর মতো ছেলের স্টাইলটাই খারাপ।কলেজে এসে আর শান্তিতে থাকা গেলোনা যত্তসব ফালতু ছেলেপেলে আমার সামনেই আসে।ধুর। চলে গেলো আইরিন।আমিও মন খারাপ করে চলে গেলাম ক্লাসে।স্যার আসলো পড়ানো শুরু করলো।আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি।
স্যার:-রাজ গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস।
আমি:-ওকে।
ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম।তারপর বাসায় চলে গেলাম।বাসায় গিয়ে প্রতিদিনের মতো নদীর পাড় এ গেলাম।সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরলাম আমি আর ইমন।তারপর বাসায় আসলাম। প্রতিদিনের মতো আজ ও বাবা মা ঝগড়া করছে।আমি আর রাগ থামাতে পারলাম না হাতের কাছে ফুলদানি ছিলো।ওটা আছার মারলাম।সবাই চুপ হয়ে গেলো।আমি রুমে চলে আসলাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম।আলো এসে বললো……
আলো:-ভাই জান খাবেন না আপনি?
আমি:-না রে আলো ভালো লাগছেনা সবাই খেয়ে নে।
আলো:-আচ্ছা ভাই জান।
বসে বসে পুরনো দিন গুলোর কথা ভাবছি। কতোই না সুন্দর ছিলো আমার জীবন। আম্মু আমার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতো। প্রতি সপ্তাহে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতো। আর আজ তারা এরকম পরিবর্তন হয়ে গেছে।তারা আমাকে একটুও বুঝেনা।আমি কি চাই ত জানার চেষ্টাও করেনা।আচ্ছা আমার কি কোনো চাওয়া পাওয়া নাই। আমার এই কষ্ট কি দূর হবেনা কখনও। আমি যা চাই তা কি কখনও পাবোনা। আমিও তো মানুষ আমার ও তো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে সেগুলে কি কখনও পূরন হবেনা।ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি তা নিজেও জানিনা।সকাল বেললা ঘুম ভাঙলো আলোর ডাকে।
আলো:-ভাই জান উঠেন দরজা খুলেন রুম পরিষ্কার করতে হবে।উঠেন ভাইজান।
আমি:-হুম উঠছি। দরজা খুলে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলাম।ফ্রেশ হয়ে খেয়ে কলেজে গেলাম।আড্ডা দিচ্ছি আমি ইমন আর মেহেদী। হঠাৎ ইমন বললো……
ইমন:-রাজ দেখ আইরিন ওই আবির ছেলেটার বাইক এ করে আসছে।
আমি:-আবির কে রে?
ইমন:-ওর বাবা কোটিপতি। ও তো জামা চেন্জ এর মতো মেয়েদের ইউজ করে ছেড়ে দেয়।
আমি:-কি বলিশ এসব?
ইমন:-আমি ঠিকই বলেছি রাজ।
আমি:-ওকে আজ এটাকে শিক্ষা দিবো।
আইরিনকে নামিয়ে দিয়ে আবির নামের ছেলেটি চলে গেলো।আমি ইমন আর মেহেদী চলে আসলাম বাইক নিয়ে ছেলেটির পেছন পেছন।একটা ফাকা রাস্তা সোজা আসতেই আমি জোড়ে গিয়ে ওর বাইকের সামনে দাঁড়ালাম।আর ও গাড়ি থামিয়ে দিলো….
আবির:-তোমরা কারা আমার পথ আটকালে কেন?
আমি:-আমরা তোর জম।আমি আরিয়ান মাহাবুব রাজ।খাদিজা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্টিজ এর চেয়ারম্যান আসাদ চৌধুরীর ছেলে। তুই আমার আইরিনের দিকে নজর দিয়েছিস কেন বল?তুই অনেক মেয়ের লাইফ নষ্ট করেছিস আইরিন এর সাথে আর কথা বলিশ না এটা আমার আদেশ।
আবির:-যদি আদেশ না পালন করি।
আমি:-হার্ট বিট চারশো বিশ।তুই থাকবি তোর একটা হাত থাকবেনা।এক লাথি দিলাম ওর বাইক এ।
আবির:-ওর পিছু ছাড়বো না।
আমি:-ঠাস্ ঠাস্। থাপ্পড় দিলাম আর ও পরে গেলো।
ইমন:-শালাকে খালাস করে দেই।
আমি:-না চল।
চলে আসলাম বাসায়।প্রতিদিন এর মতো আজও ঘুরে ফিরে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।পরেরদিন কলেজে আসলাম। কলেজে এসে আমি ইমন আর মেহেদী আড্ডা দিচ্ছি।আইরিন আবির এর হাত ধরে আমাদের সামনে আসলো।আর আমাকে….
আইরিন:-ঠাস্ ঠাস্। তুই কি করে ভাবলি যে আবিরকে মেরে আমার থেকে দূরে রাখতে পারবি।আমি ওকে ভালোবাসি। তুই কেন তোর মতো হাজার হাজার মানুষ এসেও আমাদের আলাদা করতে পারবে না।আর হ্যা জেনে রাখ আমি তোকে ঘৃনা করি।আর যদি আমার আর আবিরের মাঝে আসিস তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো।
ইমন:-এই তুই কার গায়ে হাত তুললি.. জানিস ও তোর জন্যে কি কি করছে?
আমি:-ইমন চুপ আর একটা কথা বলবিনা।চল এখান থেকে।
আইরিন:-যা যত্তসব ফালতু বখাটে ছেলেদের যে কে এই কলেজে নিয়ে আসে।
আমি:-মিস্ আইরিন চৌধুরী।হ্যা আমি বখাটে।হ্যা আমি খারাপ।কেও কি ইচ্ছে করে বখাটে হয়?না হয়না সব কিছুতেই কোনো না কোনো রহস্য থাকে।ধন্যবাদ আমার অবস্থানটা বলে দেওয়ার জন্যে। একটা কথা মনে রাখবেন দাঁত থাকলে দাঁতের মর্ম কেও বুঝেনা।একদিন আপনি আমাকে খুব করে খুঁজবেন খুব করে চাইবেন।কিন্তু আমাকে পাবেন না।আমি চলে যাচ্ছি আর এই নিন আপনার ছোটবেলার খেলার সাথিকে দেওয়া চেইন।যখন আপনি গ্রামে ছিলেন তখন এই চেইন টি দিয়েছিলেন আমাকে। আপনি আমার গান শুনতেন বসে বসে। আমি গিটার বাজাতাম আর গান গাইতাম। আমি সেই ছোট্ট রাজ যে আজ পরিস্থিতির কারনে কলেজের বখাটে কলেজের সবচেয়ে খারাপ ছেলে।কাকে কি বলছি ফালতু ছেলেদের কথা ভালো মানুষদের শুনতে নেই। ভালো থাকবেন। বিদায়। চলে আসলাম বাসায়।এসে দেখি বাবা মা আবার ঝগড়া করছে।তাই হাতের কাছে থাকা সকল জিনিস ফেলে দিলাম।সাথে সাথে বাবা মা থেমে গেলো।আর আমি তখন বললাম……
আমি:-কি পেয়েছেন আপনারা।এখনও এরকম মারামারি করবেন।আরে আমার বয়স কম হয়নি।আপনাদের ছেলে এখন ১২ এ পড়ে। আসলে আপনারা মানুষ না আপনারা জানোয়ার হয়ে গেছেন। কখনও কি এই টাকা আর ব্যবসা ছাড়া কিছু ভেবেছেন।কখনও আমাকে নিয়ে ভেবেছেন আপনারা।
আম্মু:-কেন তোমাকে তো আমরা টাকা দেই প্রতি মাসে।
আমি:-আরে আপনাদের টাকা আমি ঘৃণা করি।কখনও যদি ওই টাকা না দিয়ে ভাবতেন যে আমার ছেলেটা খেয়েছে কি না।কখনও কি একটুও সময় পান নি আমাকে বুকে নিয়ে বলতে যে আমার সোনা মানিক টা কেমন আছে।না পান নি আপনি।আসলে আপনি আমার মা নন আমার মা তো ওই বায়োমিল ল্যাকটোজেন।দুধ এর কৌটাগুলো। কারন ওই কৌটার দুধ ছাড়া তো আর কখনও মায়ের বুকের দুগ্ধ শিশুকালে খাইনি।আপনার কি একটিবার ও মনে হয়নি আমার কথা।আপনার কাছে আমার একটায় প্রশ্ন বলুন “আপনি কি আমার গর্ভধারিনী মা নাকি সৎ মা?(কান্না করতে করতে)
আব্বু:-রাজ থামবি নাকি মার খাবি? (রেগে বললো)
আমি:-মারুন না মারুন।ওটা ছাড়া আপনি কি পারেন?আপনার তো অনেক টাকা পয়সা।কখনও কি টাকা দিয়ে সুখ কিনে আনতে পেরেছেন মিস্টার আসাদ চৌধুরী।আরে আপনার টাকা আছে সব আছে আছে বাড়ি গাড়ি।অথচ আপনি প্রতিদিন ঝগড়া করেন।কেন আপনার ছেলেটাকে নিয়ে কতোদিন ভালো কথা বলেছেন কতোদিন ঘুরতে নিয়ে গেছেন কখনও অফিস থেকে এসে দেখতে গিয়েছেন নাকি যে আপনার ছেলেটা ঘুমিয়েছে নাকি জেগে আছে।আজ সবার মুখে আমি বখাটে।কিন্তু আমাকে বখাটে কে করলো বলুন মিস্টার আসাদ চৌধুরী বলুন।আপনার কি আমি ছেলে নই আমি কি আপনার দত্তক নেওয়া সন্তান যে কখনও আমার খবর নেন না।বলুন আসাদ চৌধুরী বলুন।(কান্না করতে করতে)
আব্বু:-রাজ ঠাস্ ঠাস্।তোর এতো বড় সাহস তুই আমার নাম। ধরে কথা বলিশ।
আমি:-হা হা হা।হাহাহাহা।গুড জব মিস্টার চৌধুরী। রুমে চলে আসলাম কান্না করতে করতে। এসে দরজা লক করে দিলাম। এক প্যাকেট সিগেরেট কিনেছিলাম আসার সময়।সিগেরেট জ্বালালাম। একে একে সবগুলো সিগেরেট শেষ করলাম। পরেরদিন সকালে……
আব্বু:-আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি খাদিজা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ রাজকে আর তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো।
আম্মু:-হুম আমাকেও ক্ষমা করে দিও তুমি।আমিও কেমন যেন হয়ে গেছিলাম তোমার সাথে সবসময় ঝগড়া করতাম। কাল রাজ না বললে আমরা মনে হয় সারাজীবন এরকম ঝগড়া করতাম।
আব্বু:-রাজকে ডাকো একসাথে খেয়ে বেড়াতে যায়।
আম্মু:-এই আলো যা তো তোর ভাইজান কে ডেকে নিয়ে আয়।
আলো:-জ্বি আম্মা যাচ্ছি। আমারও আজ ভালো লাগছে আপনারা ছোট সাহেবকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন।
আম্মু:-হুম যা ওকে ডাক। আলো রাজের রুমের দরজায় কড়া নাড়ছে…..
আলো:-ভাইয়া ভাইয়া দরজা খোলেন আপনারে আম্মা ডাকছে। কি হলো ভাইয়া খোলেন দরজা। দরজা খুলছেনা দেখে আলো জানালায় নজর দিলো আর জোড়ে একটা চিৎকার দিলো…
আলো:- আম্মা আআআআ।
আম্মু:-কি রে চিল্লাচ্ছিস কেন?
আলো:-আম্মা ভাইজান আর নেই।
আবু আম্মু দৌড়ে আসলো। দরজা ভেঙ্গে ভেতরে গেলো।দেখলো রাজ ফ্যানের সাথে মায়ের একটা শাড়ী জড়িয়ে ফাস নিয়ে ঝুলে আছে।ততোক্ষণে আশেপাশের লোকজন ও জড়ো হয়ে গেছে। আর জানাজানি হয়ে গেছে রাজ মারা গেছে। ইমন মেহেদী শহিদুল রিফাত আদি সবাই আসলো খবর শুনে। রাজকে নামানো হলো ওর হাতে কাগজ রয়েছে রয়েছে।হাত থেকে সেগুলো বের করে নিলো ইমন।দেখলো ওগুলো চিঠি। একটার ওপর মা-বাবা একটার ওপর বন্ধু আর আরেকটার ওপর লেখা আইরিন।ইমন প্রথম চিঠিটি পড়তে শুরু করলো……
প্রিয় আম্মু ও আব্বু।
চিঠিটা যখন হাতে পাবা তখন আর আমি এই পৃথিবীতে নাই।
আমি জানি না কি অপরাধ করেছি। কখনও তো তোমাদের ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারি নি।জানো আম্মু আমার না খুব ইচ্ছে করতো তোমাদের সাথে আড্ডা দিতে।খুব ইচ্ছে করতো তোমাদের সাথে গল্প করে তারপর ঘুমাতে যেতে।পড়ার সময় যখন পড়া হতোনা ভাবতাম তুমি অথবা আব্বু এসে বলবে রাজ বাবা কোনটা হচ্ছেনা দাও আমি করে দেই। জানো আম্মু আমার সব বন্ধুর আম্মু আব্বুরা একসাথে ঘুরতে যায়।আমার খুব ইচ্ছে করে তোমাদের সাথে ঘুরতে। কিন্তু তোমরা আমাকে তো সময় দিতে পারোনি।সকালে তোমরা অফিসে চলে যেতে আমি কি করতাম কি খেতাম তা তো জানতেও না।
আব্বু এখন থেকে রাগ কম করবা।জানো অধিক রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।আর হ্যা কখনও আমার ব্যবহারে কষ্ট পেলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।আম্মু আমি রাত জাগলে তুমি ঘুমাতে বলতে আর রাগ করতেনা। দেখোনা আজ ঘুমিয়ে গেলাম চিরতরে। তোমার আর আমাকে রাগ করে ঘুমাতে যেতে বলা লাগবেনা আম্মু।আজকের এই ঘুমতো আর কোনোদিন ভাংবেনা।মা মাগো কোনোদিন কিচ্ছু চাইনি তোমার কাছে শুধু আজকে চাইবো। আমার না খুব ইচ্ছে করছে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে আমাকে একটু তোমার পায়ে ঠায় দাওনা আম্মু।একটিবার আমার কপালে তোমার ভালোবাসার পরশ একে দাওনা আম্মু। দোআ করি সুখে থেকো আর সুস্থ থেকো। আব্বু তুমি আম্মুকে দেখে রেখো।আর আমার কবর আমার ছোটবেলার স্মৃতি বকুল গাছটির তলায় দিও।
ইতি তোমাদের রাজ
প্রিয় বন্ধুরা
যখন চিঠিটা পাবি তখন আর আমি নেই অনেক দূরে চলে গেছি ততোক্ষনে। জানিনা তোদেরকে কতো বকেছি কতো জ্বালাইছি।পারলে আমাকে ক্ষমা করিস। কাল বলেছিলাম না তোদের এমন একটা সারপ্রাইজ দিবো যা তোরা কল্পনাও করতে পারবিনা।সারপ্রা ইজ দেখে তোদের মুখের কথা বন্ধ হয়ে যাবে।দেখনা তাই হয়ে গেলো।যাইহোক, ইমন তুই আমাকে বলতি দুজন বাইক নিয়ে ঘুরবো আর মেহেদীকে নিবো না। আমি তো আর পারলাম না মেহেদীকেই তোর বাইকে নিয়ে ঘুরবি ভাববি আমিও আছি। রিফাত তুই না আমারে বলতি শালা তুই সবসময় উল্টোটাই করিস দেখলি এবার সোজাটা করছি। তুইনা বললি কাল মনে হচ্ছে আজীবনের জন্য যাচ্ছিস ছেড়ে। দেখনা তাই হলো।আমি সত্যিই তোদের ফাকি দিয়ে চলে গেলাম ওই পরোপারে।
আর আদি তুই ভালো হ হারামি স্বভাব পরিবর্তন কর।মেয়েদের পেছনে কম কম ঘুরবি আর পড়াশোনায় মন দিবি।
শহিদুল তোর বিয়েতে আর যেতে পারলাম না।খুব ইচ্ছা ছিলো তোর বিয়েতে আমরা সবাই শেরওয়ানি পড়বো আর একসাথে সব বন্ধুরা মজা করতে করতে বরযাত্রী যাবো।কিন্তু সব ইচ্ছে তো পূরন হয়না।তবুও বলি সুখে থাক সবসময় তোরা। আর হ্যা সবাই পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করবি। আজ থেকে ভালো হয়ে যাবি প্লিজ আমার এই কথাটি রাখবি তোরা। সবাইকে সরকারি চাকরী করতে হবে তোদের। আর যদি পারিস প্রতি শুক্রবার আমার কবরটা জিয়ারত করে আসিস তোরা।আর হ্যা আইরিন এর জন্যে একটা চিঠি লিখে গেলাম এটা কেও খুলবিনা প্লিজ।যদি কখনও আইরিন আমার সাথে দেখা করতে আসে তাহলে ওকে দিস।আর আমার বাবা মা কে তোরা দেখে রাখিস।
ইতি তোদের বন্ধু আরিয়ান মাহাবুব রাজ চিঠি পড়ে ইমন আর ওর বন্ধুরা কান্না করছে।রাজের বাবা মা ও কান্নায় ভেঙে পড়লো।ইমন তখন বললো……
ইমন:-আরে কান্না করছেন কেন আপনারা। দেখেন আপনাদের বোঝা দূর হলো।নিন এই চিঠিটা রাখুন।যদি কোনো মেয়ে এসে বলে তার নাম আইরিন তাহলে তাকে দিয়েন।ওর এই চাওয়াটা পূরণ করুন। রাজের লাশ দাফন করা হলো তাদের বাড়ির পাশের বকুল গাছটির নিচে। কয়েকদিন পর একটি মেয়ে আসলো রাজের বাসায়। এসে রাজের আব্বুকে বললো……
মেয়েটি:-আসসালামু আলাইকুম আংকেল আমি আইরিন রাজের সাথে একি কলেজে পড়ি।
আসাদ চৌধুরি:-জ্বি মা আমি বুঝতে পেরেছি।
আইরিন:-আংকেল রাজ কোথায়?
আসাদ চৌধুরী:-আমার সাথে আসো। আইরিনকে নিয়ে রাজের বাবা আসাদ চৌধুরি সেই বকুল গাছটির নিচে গেলো।
আইরিন:-আংকেল আমার রাজ কোথায়?আপনি আমাকে এখানে কেন আনলেন?
আসাদ চৌধুরী:-ওই যে ওখানে তোমার রাজ চিরনিদ্রায় আছে।এই নাও এই চিঠিটা ও তোমার জন্যে রেখে গেছে। আমার বখাটে ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিও মা।আমি এখন আসি তোমার আন্টিকে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
আইরিন:-রা…..জ।(চিৎকার করে) আইরিন রাজের কবরের কাছে গিয়ে বসে পরলো। আইরিন চিঠিটা পড়তে শুরু করলো……
প্রিয় আইরিন।
জানিনা আমার মৃত্যুর কতদিন পর তুমি এই চিঠিটা হাতে পাবে।জানো আইরিন আমি সবার সব কথা সব কষ্ট সইতে পারি কিন্তু তোমার রাগ করা লথাগুলো আমার সহ্য হতোনা।জানো তুমি যখন আমাকে বখাটে বলতে তখন আমার বুকে মনে হয় পাথর পড়ছে।যখন তুমি আমাকে ফালতু বলতে তখন নিজের ওপর রাগ হতো।তোমাকে আমি খুব ভালোবাসতাম।যেদিন জানলাম তুমি আবিরকে ভালোবাসো সেদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আবির ছেলেটা ভালোনা অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে ওই ছেলেটা।তখন আমি ওই ছেলেটাকে সাবধান করি।ওকে আমি শুধু একটা থাপ্পড় মারছিলাম তাছাড়া ওর গায়ে আর আঘাত করিনি ও তোমাকে মিথ্যে বলেছিলো।আর সেদিন আমি রাগের মাথায় এতো কিছু বলেছিলাম আমাকে ক্ষমা করে দিও।দেখলে সেই ছোটবেলায় এই বকুল গাছের নিচে আমি আর তুমি বসে কতো খেলা করতাম।
এই গাছে হেলান দিয়ে তোমাকে আমি গান শোনাতাম।আর তুমি আমার কাধে মাথা রেখে গান শুনতে।মনে আছে আমি তোমাকে বকুল ফুলের মালা গেঁথে গলায় পরিয়ে দিতাম।দেখোনা আজ সেই বকুল গাছটির নিচে আমি বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছি। আইরিন তোমার কন্ঠে ওই গানটি শুনতে ইচ্ছে করে (হও যদি ওই নীল আকাশ আমি মেঘ হবো আকাশের। হও যদি অথৈ সাগর আমি ঢেও হবো সাগরের।হও যদি ওই হিমালয় তোমাকে করবো আমি জয়।তোমাকে চাই তোমাকে তুমি যে আর কারো নও।বলতে পারি আমি নির্ভয়ে….তুমি আছো হৃদয়ে)।আইরিন তুমি আমার বাবা মাকে একটু দেখে রেখো।আমার কথা ভেবে কষ্ট পাবেনা।আর আমার কথা মনে পড়লে ওই আকাশের তারাদের সাথে কথা বলবা।আমি তারা হয়ে ওই দূর থেকে তোমাকে দেখবো।যখন বৃষ্টি হবে তখন বৃষ্টিতে ভিজবা মনে করবা আমি তোমাকে ছুয়ে দিচ্ছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও আইরিন।
ইতি (সেই বখাটে ছেলেটি) চিঠিটা পড়ে আইরিন কান্না করছে।
আইরিন:-রাজ কেন করলে এরকম। আমি সত্যিই ভুল ছিলাম রাজ। তুমি কোনো দোষ করোনি দোষ আমার।আমি আমার ভালোবাসাকে চিনতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও রাজ।তুমি ঠিক বলেছিলে আবির ছেলেটা ভালোনা। কয়েকদিন আগে মিতা আমাকে কল দিয়ে পার্কে ডাকে আর আমাকে দেখায় আবিরের আসল রূপ।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি রাজ।তুমি এমনটা কেন করলে।কেন কেন কেন?(কান্না করছে কবরে মাথা দিয়ে)
সেদিনের পর আইরিন আর বাসায় যায়নি। রাজের কথা মতো আইরিন রাজের বাবা মায়ের খেয়াল রাখে। এখনও সে আর বিবাহ করে নি।সে এখনও রাজকে ভালোবাসে।প্রতি রাতে আকাশের তারাগুলোর সাথে কথা বলে। বৃষ্টিতে ভিজে আর বকুল ফুলের মালা গেঁথে রাজের কবরের ওপর রাখে।প্রতি শুক্রবার রাজের কবর জিয়ারত করে রাজের বন্ধুরা। ইমন মেহেদী শাওন আর রাজের বাবা তাদের ব্যবসা দেখাশোনা করে।রাজের আম্মু অসুস্থ।প্রতিরাত
ে রাজের আম্মু রাজ বলে চিৎকার করে ওঠে।এখন আর রাজের বাবা মা ঝগড়া করেনা এখন সবাই চুপচাপ থাকে।তাদের সব আছে শুধু একটা জিনিস নাই তা হলো রাজ। এখনও রাজের শূন্যতা তাদের কাঁদায়।এখনও তারা সবাই মাঝে মাঝে ভাবে যে রাজ তাদের বলছে (তোমরা সবাই ভালো থেকো) এই পৃথিবীতে রাজের মতো অনেক রাজ আছে যারা অবহেলায় অবহেলিত এবং নিজেদের জীবন দিয়ে দেয়।আর ইমনদের মতো অনেক ইমন আছে যারা হারাচ্ছে তাদের প্রিয় বন্ধুকে।আর আইরিনের মতো অনেক আইরিন আছে যারা ভুল মানুষকে বেঁছে নিয়ে আসল মানুষকে ছেড়ে দিচ্ছে আর হারিয়ে ফেলছে সত্যিকারের ভালোবাসা।
আর অনেক বাবা মা আছেন যারা সবসময় ব্যবসা নিয়েই পরে থাকেন।কখনও সন্তানের সাথে একটু ভালোকরে কথা বলার ও সময় পাননা।বুঝতে চান না তাদের মনের অনুভুতি। সন্তানকে অবহেলা করেন। এখনও সময় আছে সন্তানদের বুঝতে শিখুন তাদেরও কিছু আশা থাকে সেগুলো পূরণ করুন। আর অবহেলা না করে ভালোবাসুন।নইলে রাজ এর বাবা মায়ের মতো সন্তান হারানোর কষ্ট সইতে হবে আর সারাজীবন কান্না করতে করতেই শেষ হয়ে যাবেন।তাই এখনও সময় আছে নিজের সন্তানকে ভালোবাসুন তাদেরর ছোটখাটো আবদার গুলো পূরন করুন।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক