মৌমিতা নিয়ম করে বিকালবেলা ঘুমায়। কারন অসময়ের ঘুম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ঘুম। শ্রেষ্ট ঘুমটা মৌমিতা মিস করতে চায় না। তবে আজ তার শ্রেষ্ঠ ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে মা আসমা খানম। ঘরে ঢুকে ডাকাডাকি শুরু করলেন, “মা মৌ, ঘুমাচ্ছিস?”
মৌমিতার শ্রেষ্ঠ ঘুমের অবশ্য একটা বাজে বৈশিষ্ট্য আছে। সামান্য শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়। তাই মায়ের এক ডাকেই চোখ খুলে গেল।
-উউ? কী হইছে?
=ঘুমাচ্ছিস?
-উউউ?
=ঘুমাচ্ছিস মা??
-কই না তো! কুত কুত খেলি!
=ছবিটা একবার দেখ তো মা..
-কিসের?
=পাত্র। খুবই ভালো ছেলে। ইঞ্জিনিয়ার! ঢাকায় বাড়ি…
শেষ কথাগুলো আসমা খানম খুব তাড়াহুড়ো করে বললেন। তবে তাড়াহুড়োয় লাভ হলো না। মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো মৌমিতা। বললো, “আম্মু! তুমি এই জন্য আমার ঘুম ভাঙ্গাইছো? বলছি তো বিয়ে করবো না।”
আসমা খানম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “এভাবে বললে হবে? বড় হইছিস, বিয়ে তো করতেই হবে রে মা।”
-“করবো না করবো না করবো না!”
আসমা খানম হাসেন। বড্ড অসহায় হাসি। ছবিটা মেয়ের বালিশের নিচে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যান তিনি।
আসমা খানম নিজের ঘরে এসে জানালার পাশে দাড়ান। চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। মেয়েটার বিয়ের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। বিদ্বেষটা অন্য এক জায়গায়….
মৌমিতা মুখে এসব বললেও আসমা খানম জানেন এখন মেয়েটা ঘরে কী করছে…
মেয়েটা খুব মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখবে। খুব ভালো করে দেখবে। চুপি চুপি ওড়না দিয়ে ঘোমটা বানিয়ে বউ সাজবে। কপালে রঙ বেরঙের টিপ লাগাবে। তারপর মায়ের কাছে এসে হয়তো জিজ্ঞেস করবে, “আম্মু আমাকে কোন টিপে ভালো লাগে? লাল না নীল?”
মৌমিতার এই আহলাদ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পাত্র পক্ষ এসে মেয়েটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যায়।
গতবারের ঘটনা। ঘটক মারফত কথা বার্তা হবার পর পাত্র পক্ষ খুব আগ্রহী ছিলো। ঘটকের কাছে মেয়ের ছবি দেখে আর শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে ছেলের মা তো একদিন ফোনে বলেই ফেললেন, “এমন শিক্ষিত মেয়ে ঘরের বউ করতে পারলে আমার জীবন সার্থক হয়ে যাবে..”
ছেলের মা তার জীবন সার্থকের প্রথম ধাপ হিসেবে আত্মীয় স্বজন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে এলেন।
কিন্তু মেয়ে দেখে তারা চুপসে গেলেন। পাত্র পক্ষের লোকজনদের মাঝে অসন্তোষের কানাকানি শুরু হয়ে গেল। ছেলের মামা সবার সামনে বলে বসলেন, “আমাদের কি বোকা পাইছেন? কম্পিউটার দিয়া মেয়েরা ফর্সা বানাইয়া ছবি দেখাইছেন। কিন্তু মেয়ে তো আসলে কালো। ছি ছি! এই যুগে দেখি কাউরেই বিশ্বাস করা যাবে না।”
মৌমিতা দরজার আড়াল থেকে সব শুনলো। তারপর খুব আশা নিয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালো। সিনেমার মত কিছু ঘটেনি। ছেলেটাও মামাকে সমর্থন জানালো নীরবে…
মৌমিতার জন্য প্রস্তাব আসে। কিন্তু সৌভাগ্য আসে না। কারন আসমা খানম এখনো কম্পিউটার দিয়েই মেয়ের মুখ ফর্সা করান। আর মনে মনে ভাবেন, কম্পিউটার দিয়ে যদি ঐসব মানুষের মনটা ফর্সা করে যেত, খুব ভালো হতো…
মৌমিতার ডাকে পেছনে ঘুরে তাকান আসমা খানম।
-“আম্মু? আমাকে কোন টিপে ভালো লাগে? লাল না নীল?”
=দুটোতেই সুন্দর লাগে রে মা..
মেয়েকে বুকে টেন আসমা খানম। এখন মা মেয়ে দুজনই কাঁদবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে এভাবেই তারা প্রতিবাদ জানায়।,