আত্মহনন

আত্মহনন
আজ আমার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো। ঠিক এক বছর আগে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছিলাম। অভিমান হবে না কেন বলো?? চার বছর রিলেশনের পর ও এসে বলে আমাকে নাকি ওর বাড়ির লোকেরা পছন্দ করবে না। কারণ আমি খাটো, মোটা। কই এতোদিন তো একবারও এই কথা বলেনি। ফিজিক্যালি যখন আমাকে বাধ্য করত তখন কেন বলেনি?? উল্টো আমাকে মিথ্যে বিয়ের আশ্বাস দিতো। আবেগে পড়ে সব বিশ্বাস করতাম। অনেক রিকোয়েস্ট করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি তারপরও বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বলে কিনা ফ্যামিলির পছন্দেই ও বিয়ে করবে। বলেই চলে গেল, পিছু ফিরে একবার দেখলোও না।
কোনো এক শুক্রবারে ওর বিয়ে হয়ে গেল। আমি এটা মেনে নিতে পারিনি। ওর জন্য বাবা মায়ের অবাধ্য হয়েছিলাম। ঠিকমতো পড়ালেখা করতাম না, কোচিং এর নাম করে সারাদিন ওর সাথে ঘুরতাম। একবার ওর টাকার খুব দরকার ছিল। বাসা থেকে চুরি করে টাকা এনে দিয়েছিলাম। এতো কিছু করেও আমি ওকে পেলাম না। আমাকে মাঝপথে ফেলে রেখে চলে গেল। সারাদিন রাত শুধু কাঁদতাম। পড়ালেখা মোটেও করিনি। পরীক্ষায় করলাম ফেল। আব্বা খুব বকাঝকা করলো। বড়ভাই খুব মারধর করলো। এত প্রেশার আমি নিতে পারিনি। সেদিন রাতেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিলাম। পরদিন সকালে পুলিশ এসে আমার ঝুলন্ত নিথর দেহটাকে নামালো। সবাই ভেবেছে পরীক্ষায় ফেল করায় আমি আত্মহত্যা করেছি। আমার ভেতরের যন্ত্রণাটা কেউ কোনদিন জানতে পারলো না।
আমাকে কবরে শোয়ানোর সময় আব্বার বুক ফাটা আর্তনাদ আমি শুনেছি। কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। আজ আমার আত্মা জেগে উঠেছে। মাত্র এক দিনের ছুটি নিয়ে আমি পরলোক থেকে মর্ত্যলোকে নেমে এসেছি, প্রিয় মুখগুলোকে একবার দেখার জন্য। প্রথমেই আমার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে গেলাম। আমার মৃত্যুর খবর শুনে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। আমাকে ছাড়া কেমন আছে ও?? সে ছাদে পায়চারি করছিলো। এমন সময় তার বন্ধু রাফি এসে বলল, “আজ লিপার মৃত্যুবার্ষিকী। ওদের বাসায় মিলাদ পড়াচ্ছে। “
– শালী মরছে ভালই হইছে!! গলায় কাঁটা হয়ে ঝুলছিলো। খালি বলত, “বিয়ে করো, বিয়ে করো”.. এরকম ফালতু সস্তা মেয়েকে বিয়া করে কে!! শালী তো আমার টাইম পাস ছিল!! তার মুখে এমন কথা শুনে আমার অশরীরী আত্মা কেঁপে উঠল। কাকে বিশ্বাস করেছিলাম এতদিন!!! মাসখানেক আগে বাবা হয়েছে সে। সব মিলিয়ে খুব সুখেই আছে। আমার কথা ভাবার টাইম নাই তার। চলে যাওয়ার আগে একবার বাবা মায়ের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করলো। জানি, তাদের কাছে আমার কোন গুরুত্বই নাই। বেঁচে থাকতে তাদের কোন কথাই শুনিনি আমি। তাদের সম্মান বাড়ে এমন কোনো কাজও করিনি। তারা কেন মনে রাখবেন আমাকে!!
বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। মিলাদ পড়ানো শেষ, মোনাজাত হচ্ছে। আব্বার উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ পেলাম,
“আমার মাইয়াডারে মাফ কইরা দিও আল্লাহ। আত্মহত্যা করলে নাকি মানুষ জাহান্নামে যায়। আমার অবুঝ মাইয়াডারে তুমি জাহান্নামে দিও না আল্লাহ। ওর দোষ নাই, সব দোষ আমার। পরীক্ষায় ফেল করছে বইলা আমি ওরে বকছি। সহ্য করতে না পাইরা মাইয়াডা আমার গলায় ফাঁস দিছে। সব দোষ আমার আল্লাহ, তুমি আমারে শাস্তি দেও। ওরে শাস্তি দিওনা ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে আব্বার পা ধরে ক্ষমা চাই। কত বেয়াদবি করেছি, কত কষ্ট দিয়েছি। অথচ আব্বা কিনা… আমার নিষ্প্রাণ চোখদুটি ভিজে গিয়েছে। পাশের ঘরে শুয়ে মা কাঁদছেন। এক বছর ধরে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। ঐ কোলে শুয়ে কত আবদার ধরেছি, আজ সেই কোল শূন্য। ঐ যে কোণে বসে বড়ভাই বুক চাপড়ে কাঁদছে। ছোট বোনের কত আবদার মিটিয়েছিস রে, বোনের যন্ত্রণাটা মেটাতে পারলি না ভাইয়া??
আমার বান্ধবী নিপা এই বছর গ্রাজুয়েট হল। বেঁচে থাকলে আমিও হতে পারতাম। হয়তো জীবনের চাকাটাও ঘুরে যেতো!! কিন্তু সেই পথটাই আমি নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছি। নিজেকে নিজে শেষ করে আমি কি পেয়েছি? কি লাভ হয়েছে আমার?? যার জন্য আত্মঘাতী হয়েছিলাম তার তো কিছু এসে যায় না। সে দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছে। আমার আবেগের কোনো মূল্যই তার কাছে ছিল না। যাদের ভালোবাসা উচিত ছিল, তাদের মূল্যায়নই করিনি। আর যে আমার ভালোবাসার যোগ্যই ছিল না, তাকে সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছি।
ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম আমি। কিন্তু সত্যিকার ভালোবাসা কোথায় থাকে তা আমার জানা ছিল না। সত্যিকারের ভালোবাসা বাবা মায়ের কাছে থাকে। একমাত্র বাবা মা ই পারেন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসতে। আজ এই চরম সত্যিটা উপলব্ধি করে গেলাম।
চলে যাচ্ছি আমি। একরাশ হতাশা আর যন্ত্রণা নিয়ে চলে যাচ্ছি আমি। আর পেছনে রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য এক চরম শিক্ষা। আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। যদি পারো ঘুরে দাঁড়াও। বেঁচে থেকে লড়াই করো। মরে গেলে তো সব শেষ!!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত