মেয়েটিকে দেখছি টানা তিনদিন ধরে কাজী অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে। মাথায় ফুলতোলা ছাতা, পরনে নীল-সবুজ সস্তা বাটিকের শাড়ি। মেয়েটার বেশভূষা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়ত তিনদিন একই জলছাপা শাড়ি পরে কারো জন্যে অপেক্ষা করত না।অথবা পুরুষ বন্ধুটি এই শাড়িটি উপহার দিয়ে বলেছে।
-এটা তোমার বিয়ের শাড়ি। স্ত্রীকে সে এই আটপৌরে পোশাকে দেখতেই বেশি পছন্দ করবে। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের নানারকম আবেগ করে। তাদের আবেগ মাত্রাজ্ঞান হারালে কেউ কেউ আবার লুকিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে সেরে ফেলে। কাজী অফিসের পাশে মুদি দোকান দেবার পর গত দশ বছরে বহু নরনারীকে নবদম্পতি রুপে এই অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। মেয়েটির মুখে থাকে নবপরিণীতা সুলভ লাজুকতা। আর ছেলেটি হাতের মুঠোয় এক টুকরো স্বর্গ বুঝে উঠতে পারে না সে এখন ঠিক করবে। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে স্ত্রীর হাত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়ত এদের গল্প আর দশজনের মত সানাই বাজিয়ে পরিবারের আশীবার্দ নিয়ে শুরু হয় নাই তবু আমি এদের মন থেকে দোয়া করি শেষটা যেন সুন্দর হয়। ভিন্ন কিছুও চোখে দেখতে হয়। মেয়েটির হাতে থাকে বড়সড় লাগেজ,পরনে টুকটকে লাল শাড়ি। সারাদিন প্রিয়জনের জন্যে অপেক্ষা থাকার পর সন্ধ্যায় স্বপ্ন ভাঙার গল্প নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে। সেদিন দোকানে ভালো বেঁচাকানা হলেও মনটা আমার খারাপ থাকে। সৌম্যর মাকে এই কথা বলতেই হাসতে শুরু করল,
-আমার নাকি চাল-ডাল না বেঁচে কবি হওয়া উচিত ছিল। যাদের বিয়ে ভেঙে যায় তাদের নিয়ে বিরহের কবিতা রচনা শুরু করতাম। কি অদ্ভুত কথা৷ এই মহিলাকে বিয়ে করাই উচিত হয় নাই। মুরব্বীরা দেখেশুনে একটা সাদা বানর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে যার সব ব্যাপারে রসিকতা করা চাই। যা বলছিলাম সেই মেয়েটির কথা। চৈত্র মাসের দমফাটা গরমে সে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ ধূলা উড়িয়ে বাস-ট্রাক চলে যায়। হর্ণের শব্দে মেয়েটা একচুল নড়ে না পর্যন্ত৷ শুধু সিএনজি -অটোরিকশা থামলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ এর সামনে গত তিনদিনে কয়েকজন একলা থেকে দোকলা হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। ও তবু স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে ডেকে বলতে ইচ্ছা হয়।
-শোনো মা, লক্ষী মেয়ের মত ঘরে ফিরে যাও। যার আসার কথা সে আর আসবে না। বলতে সঙ্কোচ হয়৷ ও নিশ্চয়ই সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পরবে। বোকা মেয়েটির সাথে কি ফোনও নাই! এযুগে ফোনে-ফেসবুকে অর্ধেক বিয়ে সারা হয়ে যায়। বাকি থাকে আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলা। নির্ঘাত হারামজাদা ছোকড়াটা পরাজিত সৈনিকের মত ফোন-টোন অফ করে দূরে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। আর এইদিকে একজন উৎসুক হয়ে পথ চেয়ে আছে। ব্যর্থ প্রেমের জন্যে ভালোবাসা না রেখে এড়িয়ে যাওয়াটাই শ্রেয় মেয়েটি তাও বুঝি জানে না। তিনদিনের দিন মেয়েটি আমার দোকানে এসে দাঁড়াল।
-চাচা, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি হবে? খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি দিলাম। মনে হল পানি খেতে আসা এক প্রকার অজুহাত। আকাশে মেঘ করেছে ওর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা আশ্রয় চাই।
-দোকানে উঠে বসো। বাতাস ছাড়ছে। বৃষ্টি আসব।
বলতে বলতে প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দিলাম। মেয়েটা চটি খুলে দোকানে এসে বসল। টুকিটাকি কথা হল। রুবি নাম। দেশের বাড়ি টাঙ্গাইল। গ্রামের বাড়ি বৃদ্ধ মা থাকেন। বড় একজন ভাই আছেন মায়ের ভরণপোষণ করতে অপরাগ। অতএব রুবিকেই সংসার চালাতে হয়। বেসরকারি একটা এনজিওতে মাঠপর্যায়ে কাজ করে।রুবি ঢোকঢোক করে পানি শেষ করে আঁচলে মুখ মুছে বলল,
-চাচা, বেতন পাই ছয় হাজার। মায়ের মাসে ঔষুধই লাগে সাড়ে তিন হাজার টাকার। ভাই এক পয়সা দিয়া সাহায্য করবে না। বাধ্য হয়ে রাতে দুইটা টিউশন করাই, কোনোমতে পেটেভাতে বেঁচে আছি বলতে পারেন। এবার মেয়েটাকে ভালোমত লক্ষ্য করলাম৷ একসময় ফর্সা ছিল এখন সেই ত্বকের ছিটেফোঁটা আভা ওর চেহারার মাঝে রয়ে গেছে। মুখে কোমলভাব নেই শুধু চোখদুটি নমনীয়। যেই মেয়ে সারাদিন রোদে ঘুরে বেড়ায় সে হাত-পায়ের যত্ন নেবার সময় পায় না। বলা চলে এই ধরনের মেয়েদের আমরা অহরহ দেখি কিন্তু আলাদা দুদণ্ড তাকানোর ফুরসত পাই না। জিজ্ঞেস করলাম,
-থাকো কই?
-শ্যামবাজার মসজিদের এড়িয়ায় মেসবাড়িতে।আমার সাথে আরো দুইটা মেয়ে থাকে। তিনজনে চিলেকোঠার মত ছোট্ট একটা রুমে থাকি। বাথরুম আর রান্নাঘর একটা ফ্যামিলির সাথে শেয়ার করতে হয়৷
টিফিন ক্যারিয়ার বের করে বললাম,
-আম্মাজান,আমার স্ত্রী দুপুরের খাবার দিয়ে পাঠিয়েছে। বসেন,আমার সাথে দুইটা ভাত খান।
-না, চাচা। দুপুরে আমার ক্ষুধা লাগে না। ফিল্ডে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনি খান। ও আসলে দুজনে মিলে কাচ্চি হাউজে যাব। আমার আবার বিরিয়ানি খুব পছন্দের। রুবি সলাজ হাসল। এত শক্তপোক্ত মেয়ে পচা শামুকের পা কাটবে মনে হয় না। ভাত খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম,
-যার সাথে বিয়ের কথা। সে কই? তিনদিন ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ।
-সাজ্জাদ আমাদের এলাকার ছেলে। পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়েছিল কিন্তু এলাকার লোক ভাঙানি দিল । আমি
নাকি বাজে মেয়ে। রাতের বেলা পার্কে দাঁড়িয়ে থেকে টাকা রোজগার করি৷ সেই হারাম পয়সায় আমাদের অন্ন জোটে। রুবির মুখ থমথম করছে।
-তারপরের ঘটনা কি!
-সাজ্জাদের আমাকে খুব পছন্দ ছিল। বলেছিল ওর ছোট বোনের বিয়ে দিয়েই আমাদের বিয়ে হবে। দেখেন ওর ছোট বোন আজকে দুই বাচ্চার মা আমার হাতে মেহেদীর রঙই জুটল না।
-এমন ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছ না কেন?
-কপাল খারাপ আমার। এক বছর আগে এই কাজী অফিসে এসে ও অপেক্ষা করছিল। আমি আসলাম কাঁদতে কাঁদতে। মার রিকশা থেকে পড়ে হাত ভেঙে গেছে। হাতে টাকাপয়সা নাই৷ ও বিয়েতে খরচ করবার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আসছিল। সেই টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল মায়ের কাছে যাও। আমাদের আর বিয়ে করা হল না।
-তিনদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছ। তুমি অপেক্ষা না করে ওকে একটা ফোনও তো দিতে পার।
– ও হাসপাতালে ওর্য়াড বয়ের কাজ করে।গত দু’দিনই সকালে ফোন করে বলে দিয়েছিল আসতে পারবে না। ছুটি পায় নাই। আর এদিকে আমি বিয়ে উপলক্ষ্যে সাতদিন ছুটি নিয়ে বসে আছি। বাসায় বসে করার কিছুই নাই। তাই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি।কাজী অফিস থেকে কতজন স্বপ্ন পূরণ করে প্রতিদিন ফিরে যায়। আমার দেখতে ভালো লাগে।
-আজ সকালে ফোন করেছিল?
-না।গত বছর আজকের দিনেই আমাদের বিয়ে হবার কথা ছিল।
৩১ শে আগস্ট,২০১৮।গ্রাম থেকে মায়ের ফোন আসার পর আর বিয়েটা হল না। ও বলেছিল ঝড় হোক বৃষ্টি হোক পরের বছর এই দিনে আমাকে ওর ঘরে তুলবেই। দেখুন না, আমি ঐদিনের জন্যে কেনা শাড়ি পরে অপেক্ষা করছি। আমার ধারণা ও এসে আজকে আমাকে চমকে দিবে।তাই ফোন করে নাই। রুবির চোখ চকচক করছে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে।ও বসে আছে দরজার কাছাকাছি। বৃষ্টির দমকে ওর শাড়ির আঁচল ভিজে যাচ্ছে কিন্তু ওর হুশ নেই। মিটিমিটি করে হেসে যাচ্ছে। বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। আমি আল্লাহপাকের কাছে খাশ দিলে দোয়া করছি,
-হে আল্লাহপাক, আপনি এই দুঃখী মেয়েটার মনের ইচ্ছা কবুল করে নিন।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক