– পিঠের উপর হঠাৎ কারো হাতের চাপ টের পেয়ে চকিতে পেছন ফিরে তাকালো নিতু। মাথাটা করে ঘুরে উঠল তার – এ কী ! রতন স্যারের এমন নোংরা আচরণ ! সপ্তাহে তিনদিন নিতুকে গণিত শেখার জন্য রতন স্যারের বাসায় আসতে হয়। সেকেন্ডের মধ্যেই নিতু সরে গেলো খানিকটা। এর মধ্যেই সে হিসেবটা মিলিয়ে নিল – সে ছাড়া তার ব্যাচের অন্য পাঁচজনই কেন এখানে অনুপস্থিত আজ। লোকটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হতে নিতু দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে শুধু বলল,’ এটা কী?’ পশুটার পশুত্ব ততক্ষনে চরমে উঠেছে। ঝাপিয়ে পড়ল সে নিতুর উপর!
— রায়হান সাহেব বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরে প্রতিদিন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন। ফিরলে একসাথে চা খেতে খেতে অনেক গল্প করেন। আজ মেয়ের দেরি দেখে অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন। দুশ্চিন্তায় যেন তার হার্ট বন্ধ হবার উপক্রম । নাহ,আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কোনোমতে শার্ট গায়ে চাপিয়ে মাত্র বের হবেন তিনি , সেই মুহূর্তে নিতুকে সামনে পেলেন। মেয়ের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিতু বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর্তচিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। পুরো ব্যাপারটি তখন আঁচ করতে পেরে রায়হান সাহেবের বুকটা হিম হয়ে এলো। পৃথিবীটা যেন তার পায়ের নীচ থেকে সরে যাচ্ছিল!
— সারারাত ঘুম হলো না রায়হান সাহেবের। মাঝরাতে বালিশ মুখে চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। নিতুর মা গত বছর লিভারজনিত সমস্যায় মারা গিয়েছেন। তখন থেকে তার অতটুকুন মেয়ে বাড়ীর সব কাজকর্ম একা হাতেই করে। উচ্চমাধ্যমিক সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। বরাবরই পড়াশুনায় সে খুব ভালো। সামনেই এইচ,এস,সি। তবুও বাবার এতটুকু অযত্ন হতে দেয় না সে।
— অন্যান্য দিনের মতই নিতু আজও বাবাকে অফিসে যাওয়ার জন্য ডাকতে এলো,কিন্তু তিনি জানালেন আজ অফিসে যাবেন না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো নিতু। একটু বেলা হলে রায়হান সাহেব মেয়েকে বললেন, ‘চল মা, আমার সাথে।’ নিতু কোনো প্রশ্ন না করে বেরিয়ে পড়ল বাবার সাথে। কারণ এই বাবাই তাকে মাথা উঁচূ করে বাঁচতে শিখিয়েছেন – তিনি অন্তত ওর ব্যাপারে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না।
— ধর্ষণ মামলার জবানবন্দী লিখবেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, অথচ এস,আই ফরহাদ সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ধর্ষণ কাহিনী শুনতে শুরু করলেন, আর সে সময়ে তার চোখ দুটোকে আর এক ধর্ষকের চোখ মনে হলো নিতুর। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট মাহিন সাহেবের পালা। নিতু ছোট থেকে বিভিন্নভাবেই বুঝেছে যে, সে দেখতে খুব সুন্দর। মানুষের অনেক খারাপ দৃষ্টির সাথে তার পরিচয় আছে, কিন্তু আজ যেন তার অগ্নিপরীক্ষা। মাহিন সাহেবের প্রশ্নের তো কোনো শেষ নেই – ধর্ষক নিতুর ঠিক কোথায় কোথায় দাঁত বসিয়েছে, কোথায় কোথায় হাত রেখেছে, নিতু কতটুকু বাঁধা দিয়েছে, বাঁধা দেয়ার সময় ঠিক কি কি ঘটেছিল আরো কত কী!
— চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি কক্ষে নিতুকে নিয়ে যাওয়া হলো। ভিকটিম এক্সামিনেশন টিম এলো সেখানে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার পর একজন নার্স নিতুকে পাশের রুমে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষার জন্য তার ভ্যাজাইনাল সোয়াব নেয়া হলো। এরপর তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হতে বলা হলো। নিতু যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল,তাকে আবারও বার বার ধর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ততক্ষণে টিমের একজন পুরুষ ডাক্তারও সেখানে উপস্থিত হলেন। নিতু একটু আড়াল হয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করল,’ ভিকটিম কি সব এবাবেই পরীক্ষা করা হয়? ‘ নিতুর অসহায় চেহারা দেখে বোধহয় নার্সটির মায়া হলো। সে নিতুকে জানালো, ‘ আপনার ভাগ্য খারাপ, এই স্যার এভাবেই সম্পূর্ণ পোশাক খুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। উনি লোক সুবিধার নন । কিন্তু অন্য স্যারেরা এভাবে দেখেন না। আমাদের ডাক্তার ম্যাডামরাই বেশি দেখেন এগুলো। কিন্তু উনারা আজ নেই।’
নিতুর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। পুরুষ ডাক্তারটি নিতুকে ধমকালেন। তার তাড়া আছে বলে নিতুকে বিবস্ত্র হওয়ার কথাটির পূনরাবৃত্তি করলেন। নিতুর হাত, পা,পুরো শরীর কাঁপছিল। সে অস্ফূট গলায় শুধু বলল, ‘বাবার কাছে একবার যাব।’ বাইরে এসে বাবাকে কোনোমতে ব্যাপারটি বলে নিতু নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। বাবার চোখেও টলমল করছে জল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। ইন্টার্নি ডাক্তারের একটি দল তখন পাশ থেকে যাচ্ছিল। ওদের মধ্যে থেকে একটি ছেলে তখন দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,’আঙ্কেল, আপনাদের কি প্রব্লেম? আমাকে বলা যায়?’
মানুষ বিপদের সময় খড় কুটো আঁকড়ে ধরে। নিতুর বাবা ছেলেটিকে তাই সব বললেন। ছেলেটি সব শুনে ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেলো। একটুক্ষণ পর বাইরে এসে ওদেরকে বলল,’শুনুন,উনার যে ভ্যাজাইনাল সোয়াব নেয়া হয়েছে, তাতে যদি স্পার্মাটোজোয়া পাওয়া যায়, তাহলে প্রমাণ হবে,উনি ধর্ষিতা, আর না পাওয়া গেলে ধর্ষণ প্রমান হবে না। আর সত্যি তো এটাই যে , তাৎক্ষণিক না এলে আসলে কখনোই স্পার্মাটোজোয়া পাওয়া সম্ভব নয়। তাইতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। শুনুন, আমি ভেতরে গিয়ে কথা বলেছি। উনি যা চাইছেন না,সেটা করতে হবে না। তবে উনাকে ডিটেইলস বলতে হবে আর ইনজুরি যতটুকু দেখানো সম্ভব দেখাতে হবে।’
— নিতু তার ধর্ষণের পর এক মাস পার করেছে। ধর্ষক ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে। বিচারের রায়ের অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বাবা আর মেয়ে। জীবন চলছে জীবনের নিয়মেই। কিন্তু বাবা তার প্রাণোচ্ছল মেয়েটিকে আর কোথাও পান না। প্রায়ই মাঝরাতে ভয়ে চিৎকার করে উঠে মেয়েটি। বাবা দৌঁড়ে পাশে গিয়ে বসেন। নীরবে দীর্ঘ সময় বসে থাকেন!
— সেদিন বিকেলে অন্যদিনের মতই নিতু বাবার সাথে বসে ছিল। একজন অপরিচিত মহিলা এলেন ওদের বাসায়। নিতু উনাকে বসিয়ে চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে চলে গেলো। মহিলাটিও এটাই চাইছিলেন। নিতুর অনুপস্থিতিতে বাবার সাথেই কথা বলতে চাইছিলেন। তিনি কোনো ভূমিকা না করে একবারেই বলে ফেললেন,’ভাই,আপনার মেয়েটিকে আমি চাই। আমার ছেলের বউ হিসেবে।’ রায়হান সাহেব অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন। উনিই আবার বলতে শুরু করলেন,’ আপনার অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। ঠিক আছে, আমি আপনাকে খুলে বলছি। আমার ছেলের নাম নিলয়। ইন্টার্নি ডাক্তার। আপনাদের সাথে তার কথা হয়েছে। মনে করতে পেরেছেন?’
– জি পেরেছি।
– আপনি রাজী থাকলে আমি নিতুর সাথে কথা বলতে চাই।
– জি, বলুন। ও রাজী থাকলে আমার আপত্তি থাকবে না।
— নিতু বিয়ের পর থেকে বাবার সাথেই থাকছে।
এটাই তার শর্ত ছিল। নিলয় আর নিতু দুজন দুজনের বাসায় থেকে যে যার জীবন গড়ছে। শুধু মাঝখানে এসেছে অপরিসীম ভালোবাসার বন্ধন যা একটা ধর্ষণ কেন, এমন অনেক ক্ষত সারিয়ে তুলতে সক্ষম। নিতু বিয়ে করার আগে নিলয়কে দুটো প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি সেইদিনে ভিকটিম এক্সামিনেশন টিমকে কি বলে ব্যাপারটি বন্ধ করেছিলেন?’
নিলয়ের অকপট জবাব,’ বলেছিলাম,স্যার ও আমার হবু স্ত্রী। আর কিছু বলার দরকার হয়নি। ও শালার যা ক্যারেক্টার, এটা না বললে তোমায় ঐ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারতাম না। ‘ নিতুর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ‘ আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন? দয়া করে?’ আর সে প্রশ্নের জবাবে নিলয় বলেছিল, ‘ভালোবেসে। ভাবছ, এক মুহূর্ত দেখে ভালোবাসা হলো কি করে। হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। তোমার ঐ সময়ের চোখের জল তোমার মনের সব কষ্ট আমার বুকের ভেতরে পৌঁছে দিয়েছিল। কি করব, ভালো না বেসে যে আর পারলাম না।’ নিতু সেদিন নিলয়ের কথা শুনে খুব করে কেঁদেছিল আর সেই চোখের জলে স্পষ্ট লেখা ছিল – এই পৃথিবীতে শুধু রতনের মত ধর্ষকই জন্মায় না। জন্মায় নিলয়ের মত মহাপুরুষরাও যাদের ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম!
( সমাপ্ত)
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক