রাশেদ!! এই, ওঠো না একটু!
– রাশেদ আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠলো। কি হয়েছে নীরা? স্বপ্ন দেখেছো কোন?
-না আমার খুব খারাপ লাগছে!
– রাশেদ নীরাকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে আমাকে বল! একি, ঘেমে গিয়েছো তো! আচ্ছা শরীর কি খারাপ লাগছে?
– রাশেদ আমার বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে নিশ্বাস টা ভারী লাগছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাশেদ।
– আচ্ছা দেখি উঠে বসো ভালো করে। চোখে মুখে কি পানি দিবা একটু?
– রাশেদ আমার মনে হচ্ছে আমি সব কিছু হারিয়ে ফেলবো। মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো। আমার ভয় লাগছে খুব। ডেলিভারীর যত দিন ঘনিয়ে আসছে ততই ভয় লাগছে। আচ্ছা আমার বেবীটা হতে গিয়ে যদি আমি মরে যাই? ওর কি হবে?
– আহ্ নীরা কি বাজে বকছো বলতো! কিছু হবেনা। প্রথম বার কনসিভ করেছো তো! তাই বেশী টেনশান করছো। এত টেনশান করার কিছুই নেই। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো। নীরা বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার জন্য তুমি ঠিক করে ঘুমাতেও পারোনা। এক্সট্রেইমলি স্যরি। ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ঠিক আছি।
রাশেদ বলল, এত বেশী বুঝতে হবেনা। আসো তো! তুমি ঘুমাও । রাশেদ নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নীরা নিষ্পাপ একটা বাচ্চার মতো শুয়ে থাকলো। রাশেদ বলল, এই নীরা শোননা, তুমি তো ছেলে পছন্দ করো, আর আমি তো মেয়ে । আচ্ছা যদি এরকম হয় যে আমাদের যমজ বাচ্চা হয়ে গেল তাহলে কেমন হবে? নীরার মুখ আনন্দে চকচক করছে। নীরা বলল, খুব ভালো হবে। একসাথে দুইজন হেসে খেলে বড় হবে। একজনের নাম রাখবো ইউসুফ আরেকজনের নাম রাখবো ইব্রাহীম।
রাশেদ নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, মানে কি? নীরা বলল, কিসের মানে? নাম পছন্দ হয়নি? না নামের কথা বলিনি। দুইটাই ছেলে বাচ্চার কথা বলছো কেন? আমি তো জমজ বললাম কারণ একটা ছেলে একটা মেয়ে এটা ভেবে। আমাদের কি মেয়ে থাকবেনা নাকি! উফফ রাশেদ! মেয়ে থাকবেনা কেন? এই ধরো প্রথমবার একসাথে দুইটা ছেলে হল , তারপর একটা মেয়ে হল। ব্যাপারটা ভালো হবেনা? রাশেদ হেসে বলল, হুম খুব ভালো হবে। আর শোন নীরা ওর নাম রাখবো জান্নাতি। নীরা বলল ঠিক আছে। পরক্ষণের নীরা বলল, আমরা এমন ভাবে গল্প করছি যেন আমরা যা বলবো তা-ই হবে! রাশেদ আর নীরা একসাথে হেসে উঠলো। রাশেদ বলল, বুক ব্যথা কমেছে কিছুটা? নীরা একেবারে কমে গিয়েছে। এখন একটু ভালো লাগছে? নীরা ছোট করে বলল হুম। তারপর রাশেদকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রাশেদ জেগে থাকলো। স্বপ্নালু চোখে দিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকলো। একটা বাচ্চার স্বপ্ন।
——রাশেদের মা গ্রামের বাড়ি থেকে চলে এসেছে। রাশেদ আর নীরা কে চাকুরীসূত্রে বাইরেই থাকতে হয়। নীরাকে দেখাশোনা করা ও সঙ্গ দেওয়ার জন্যই রাশেদের মায়ের এখানে আসা। নীরার সাথে তার শাশুড়ির সম্পর্ক চমৎকার। একেবারে বন্ধুত্বপূর্ণ বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে ও বেশী। দিনের বেলাতে রাশেদ অফিসে থাকে। তখন শাশুড়ি বউমার সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে নীরা খুব ভয় পায়। কেন জানি তার ভয় হতে থাকে যদি সে ডেলিভারি করার সময় মারা যাবে। তার শাশুড়ী তাকে সব সময় সাপোর্ট দিতে থাকে। সবসময় তাকে বুঝাতে থাকে এ সময় মেয়েদের হরমোনাল চেঞ্জ এর কারণে এসব মনে হয়। নীরা এসব আজেবাজে চিন্তা করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে।
দিন যেতে থাকে৷ একদিন রাতে আবারও রাশেদের ঘুম ভাঙলো নীরার ডাকে। আজ নীরাকে খুশিতে একটু উত্তেজিত মনে হল। কি হয়েছে প্রশ্ন করার আগেই নীরা বলল, রাশেদ আমাদের না খুব সুন্দর একটা মেয়ে হবে। টুকটুকে গায়ের রঙ। মুখ টা হাসি হাসি। ওর পায়ে, হাটুর কাছে একটা জন্মদাগ আছে। আমারো আছে দেখো এই যে। রাশেদ অবাক হয়ে বলল, এগুলা কিভাবে জানলে! নীরা বলল, আমি স্বপ্ন দেখেছি রাশেদ৷ রাশেদ হেসে নীরাকে বুকে টেনে নিল। নীরা বলল, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছোনা? আমি ওকে দেখেছি। রাশেদ বলল, বিশ্বাস করেছি নীরা, ঘুমাও তুমি। নীরা ঘুমোচ্ছে, রাশেদ তাকিয়ে আছে তার দিকে। নীরার স্বপ্ন কি সত্যি হবে? কি জানি! স্বপ্ন কি কখনো সত্যি হয়?
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, দুপুরে নীরা ঘুমিয়ে আছে হঠাৎ করে একটা স্বপ্ন দেখলো। সেই বাচ্চাটা- খিলখিল করে হাসছে। নীরা অবাক হয়ে দেখলো বাচ্চাটা কথা বলতে পারছে। বাচ্চাটা নীরা কে মা বলে ডাকছে। বাচ্চাটা নীরা কে বলল, মা এতদিন তোমার সাথে ছিলাম, আর হয়তো একসাথে থাকা হবেনা৷ মা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি?
নীরা চমকে উঠলো। চিৎকার করে শাশুড়ি মা কে ডেকে বলল মা আমি মরে যাচ্ছি৷ আমি মরে যাচ্ছি মা। স্বপ্নের কথা ভুলে গেলে পেট ব্যথাতে। তার প্রচন্ড পেইন হতে শুরু করলো।
—–রাশেদ ও তার মা হাসপাতালে ওয়েট করছিল। নীরার মা বাবা ও রওনা দিয়ে দিয়েছে। রাশেদ টেনশানে পায়চারী করতে লাগলো। যেই ডাক্তার নীরার ডেলিভারি করাচ্ছিল সে রাশেদের ছোট বেলার বন্ধু আসিফ। ডাঃ আসিফ বের হয়ে আসলেন৷ রাশেদ শুধু উঠে দাঁড়ালো৷ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলোনা। এক অজানা ভয় উঁকি দিয়ে গেল তার মনে আচ্ছা নীরা ভালো আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো? এসব ভাবছিল তখন ডাক্তার আসিফ বললেন নীরা ভাবী ভালো আছে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে ইনশাল্লাহ জ্ঞান ফিরবে। তোর একটা মেয়ে হয়েছিল। কিন্তু হওয়ার আড়াই মিনিট পরে মারা গেছে। মন শান্ত কর রাশেদ। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমাকে এখনি আরেক পেশেন্ট এর কাছে যেতে হবে। আমি আসছি। রাশেদ কিছুই বললনা কয়েক সেকেন্ড। তারপর মাটিতে বসে পড়লো। তার মা ও ভীষণ কষ্ট পেলেন। রাশেদ তার মায়ের হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ, খুব শব্দ করে কাঁদল।
——-নীরার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হল। নীরার বাবা মা ও চলে এসেছে। নীরা সবটা শুনেছে। রাশেদ নীরার বেডে বসে আছে। তারপর নীরাকে কিছু বলতে যাবে এই সময় নীরা বলল, রাশেদ! তুমি এত কষ্ট কেন পাচ্ছো? এই দেখোনা আমি একদম কষ্ট পাচ্ছিনা। বলতে গিয়ে কণ্ঠটা জড়িয়ে গেল নীরার। সে বলল, তুমি নিজের মেয়ের নাম জান্নাতি রাখতে চেয়েছিলে না? দেখো আমাদের জান্নাতি, জান্নাত থেকে এসে আবার জান্নাতেই চলে গেল। ও ভীষণ সুখে থাকবে যেই সুখের বিন্দুমাত্র আমরা বাবা মা হয়েও ওকে দিতে পারতাম না। নীরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে।
কেবিনে রাশেদ আর নীরা ছাড়া আর কেউ নেই। রাশেদ, আমি একবার আমার মেয়েকে কোলে নিতে চাই। রাশেদ তখন মেয়েটাকে এনে নীরার কোলে দিয়ে বলল, নীরা দেখো কি সুন্দর আর ফুটফুটে ওর মুখ! যেন মরে যাওয়ার পরও মুখে হাসি লেগে আছে। বলতে গিয়ে আবার চোখ ভিজে গেল। নীরা তাকিয়ে দেখল তার মেয়েকে! অনেক গুলো চুমো খেল পুরো শরীরে। আজ সবাই ওকে প্রথমবার দেখছে কিন্তু নীরা তো আগেও দেখেছে। রাশেদ বলল, নীরা! ওর হাঁটুটা একটু দেখো। নীরা দেখলো বাচ্চাটির হাটুতে একটা জন্মদাগ আছে। নীরা বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাশেদ আটকালোনা৷ কাঁদুক একটু। কাঁদলে কষ্টটা হয়তো একটু হালকা হবে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা এত তীব্র এটা হয়তো কখনোই কল্পনাতে আসেনি।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক