স্বার্থপর সন্তান

স্বার্থপর সন্তান

আমি একজন হাই সোসাইটির হাই এডুকেটেড পারসোনালিটি সম্পন্ন ব্যক্তি। আমার বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স সবই আছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমার কিছুই নেই। সবচেয়ে গরিব,অসহায় আর সম্মানহীন, অপরাধী একটা অমানুষ আমি।

আমার দাদা একজন গরিব কৃষক ছিলেন। আমার বাবা প্রবাসী। ছোটবেলাতেই আমার বাবা মারা যায়। মা এঘর ওঘর করে এর ওর কাজ করে লোকের হাজারো কথা সহ্য করে আমার আহার যোগাড় করতেন। শুধু তাই নয়,,আমায় পড়া লিখাও শিখিয়েছেন। আমায় উচ্চ শিক্ষিত করতে নিজের সব শক্তি দিয়ে দিন রাত অন্যের ঘরে খেটে এসে নিজের ঘর সামলাতেন। আমাকে ভালো ভার্সিটি তে এডমিশন করাতে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য মা তার অতি প্রিয় আর শেষ সম্বল মানে আমার বাবার শেষ স্মৃতি আমাদের ভিটেমাটি বিক্রি করে দেন আর আমায় চিকিৎসক বানিয়ে তুলেন। মেডিকেলে শিক্ষারত অবস্থায় আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরি মেয়েটা নিজেই আমাকে প্রপোজ করে। সে সবসময় একটা বড় প্রাইভেট কারে করে আসতো।

বেশ সুন্দরি, মেধাবী আর পয়সাওয়ালার মেয়ে ছিলো না করার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। আমিও তার প্রতি দূর্বল হয়ে যাই। একসময় আমি চিকিৎসক হয়ে বের হই আর সুভা ও চিকিৎসক হয়ে বের হয়। আমরা দুজনই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হই। ও আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। সুভার বাবার সোসাইটি তে অনেক নাম ডাক। সুভা তাই আমায় জানায় আমি যদি মা কে ছাড়তে পারি তবেই সুভা আমায় বিয়ে করবে। ভালোবাসা পেতে আর টাকার মোহে আমিও মা কে খ্যাঁত ভেবে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। উঁহু,, একা ফেলিনি বৃদ্ধাশ্রম এ রেখে আসি। এতে পারসোনালিটি কমে না তাই। অনেক বড়লোক এমনি করে।

সুভাকে বিয়ে করি আমি। আমাদের বিয়ের বছর চার পর সুভার বাবা কার এক্সিডেন্ট এ মারা যায়। আমার কি একমাত্র সন্তানকে বিয়ে করেছি সবই তো সুভার মানে আমার। কিন্তু আমার জীবনে অন্যায় টা যে একটু বেশি ছিলো। আমার পাপের ভান্ডারে আর হয়তো পাপ রাখার জায়গা হচ্ছিলো না তাই স্রষ্টা আমার পাপের ফল আমাকে দুনিয়াতেই দেখাতে শুরু করেন। সুভা ধিরেধিরে আমার কাছ থেকে কেমন দূরে সরে যেতে লাগলো। কারণে-অকারণে ঝগড়া করতো। আমাদের এক ছেলে ও ছিলো সুহান। ও তখন ৭ম শ্রেণী তে পড়ে।

সুভাকে বোঝানো দিনকে দিন আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যেতে লাগলো। এমন এক পরিস্থিতি চলে এলো যে সুভা ডিভোর্স চাইলো। এ সময় ডিভোর্স? আমাদের ছেলে?? আমার এত সহায় সম্পদ দিয়ে আমি একা কি করবো?? সবই তো সুভার জন্যই করেছিলাম। ওর মন রাখতে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ওর নামে করে দিলাম। তবুও কাজ হলো না। ওকে বোঝাতে আমাদের কলিগ, সিনিয়র কলিগ, অনেক সম্মানিত ব্যক্তিদের ঘরে আনলাম। সবার সামনে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইলাম পায়ে চুমু খেলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব আমি ততটাই ছোট করলাম কিন্তু তবুও মন গললো না সুভার।

ও ডিভোর্স নিয়ে নিলো। আমাকেই সরে যেতে হলো সুভা আর সুহানের জীবন থেকে। সুহান কে সাথে আনার চেষ্টা করেছিলাম ও এক কথায় অটল “আমি বাবাকেও চাই না মা কে ও চাই না আমি নানুর সাথেই থাকবো “। কি আর করার!! ওর সব খরচ প্রতি মাসে দিয়ে দিতে লাগলাম। মাস দুয়েক পর খবর পেলাম সুভা নতুন বিয়ে করতে যাচ্ছে। যাকে বিয়ে করছে সে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করে এবং কানাডার এক হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কানাডায় স্যাটেল। এটা ওদের প্রেমের বিয়ে। বাহহ!!! সুভা কি করে পারলো?? আমি ওর জন্য কি ত্যাগ করিনি?? ওর কিসে কমতি রেখেছিলাম?

আজ আমার টাকা আছে, বাড়ি-গাড়ি আছে। কিন্তু তবুও সাথে কেউ নেই। সুভার স্থান কাউকেই দেওয়া সম্ভব নয় তাই বিয়ে করবো না আমি এটাই আমার জেদ। এদিকে আমার সন্তান থেকেও নেই। সুহানের তো কোনো কমতি রাখিনি। তবে কেনো ও আমার সাথে আসে নি?? আমি কি ওর জন্মদাতা নই?? তারপর একদিন আশ্রম থেকে মায়ের চিঠি এলো সেখানে লিখা ছিলো “আজাদ, বাবা আমার। কত বছর তোকে দেখিনা। তুই ভালো আছিস তো?? জানিনা কেনো মন তোর জন্য খুব বেশি কান্না করে। বারবার ভয় হয় তোর কিছুর প্রয়োজন পড়ে কি না।

আমিতো নেই তাই তোকে দেখতে পাই না। তোর কিছু লাগলেও তোকে দিতে পারিনা। কতো বছর বাবা তোকে দেখা হয় না। বুড়ো মা কে নাই বা দেখলি। তোর একটা ছবি দিস তো একনজর দেখে পড়ানড়া জুড়াবে। তোর ওই ছবি দেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারলে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি মা হিসেবে নিজেকে মনে করবো। বাবা ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস।মন বড্ড আনচান করছে জানিনা কেনো। বেশি বলে ফেলেছি হয়তো রাগ করিস না রে । তোকে বিরক্ত করতে চাইনি কিন্তু কি করা বল?? মা এর মন তো। আচ্ছা বৌমা ভালো আছে তো?? আচ্ছা আমার কি কোনো নাতি-পুতি আছে?? যদি চিঠিটা তোর কাছে পৌছায় আর যদি তোর সময় হয় উত্তর দিস।

ইতি
তোর মা”

চিঠিটার এক একটা বাণী মনে খুব জোড় আঘাত দিলো। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো।আজ আসলেও আমি বড্ড একা। আমার যে এই একার সময়ে মা কে খুব প্রয়োজন। তাই দেরি না করে আশ্রমের দিকে গাড়ি ছুটালাম। কথায় আছে না “মরা সব দিক দিয়েই মরে “। হলো তাই। গিয়ে শুনলাম মা সকালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মা কে কবর দিয়ে আসলাম। নিজ হাতে মাটি চাপা দিলাম। মা কে কোলে তুলে কবরে নামালাম। মাটি পাড়িয়ে পাড়িয়ে কবর দিলাম।

কলিজাটা ছিড়া পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আজ মা আর নেই। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সম্পদ আর নেই। যে কি না আজীবন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেলেন তাকেই আমি অবহেলা করলাম?? আজ মা কে বড্ড বেশি মনে পড়ছে।

আগে একটু কষ্ট পেলেই মায়ের আঁচলে মাথা লুকিয়ে কান্না করতাম। দারিদ্র্যতার জন্য যখন সবাই অবহেলা করতো একা করে দিতো একমাত্র মা ই হতো সাথি। যার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতাম। দুনিয়ার সকল ব্যাথা মা এর বুকে দিয়ে নিজে সুখকর জীবন যাপন করতাম। আমি আজীবন স্বার্থপর ছিলাম। আজো স্বার্থপর আর তাই নিজ প্রয়োজনে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
কিন্তু নিঃস্বার্থতার সাথে, অপরাধ বোধের সাথে, নিজের প্রতি অসম্মান আর ঘৃণার সাথে এক একটা সময় কাটাচ্ছি।

কিন্তু কি হবে এই আফসোস দিয়ে?? পাবো কি ফিরে মাকে?? চাওয়া কি হবে আর ক্ষমা?? করা হবে কি পূরণ মা এর শেষ ইচ্ছে?? না,কখনোই না। কারণ আমি চাইলেও আর আমার আওয়াজ মা এর কাছে যাবেনা। না যাওয়াই ভালো। এই শাস্তি আমার পাওনা। হ্যা, আমারই পাওনা।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত