তোমার অপেক্ষায়

তোমার অপেক্ষায়

ফারাবী দিব্যি আরাম করে এক্সিম ব্যাংকের ভিতরে একটা সোফায় বসে আছে। একটু পরপর এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে আর সোফায় বসে একটু একটু ঝাঁকুনি খাচ্ছে। সোফাটা বেশ নরম। বেশ ভালোই লাগছে ঝাঁকুনি খেতে।
বাইরে ভীষণ রোদ উঠেছে আজকে। দাঁড়ানোই যাচ্ছে না একেবারে। তার থেকে বরং ভালো ব্যাংকে বসে ফ্রি’তে এসির বাতাস খাওয়া। ব্যাংকের সিকিউরিটিগুলো বারবার আঁড়চোখে তাকাচ্ছে ফারাবীর দিকে। এজন্য ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার। না পারছে কিছু বলতে না পারছে সইতে। সে মনে মনে ভাবছে,আরে আমি তো কোনো চোর-ডাকাত নই। তবে কেন তাদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে আমার দিকে??

ভার্সিটি ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের এক কোণায় ফারাবী,অভ্র,মেহরাফ আর সন্ধ্যা বসে আছে। সন্ধ্যা আজকে বাসা থেকে চিকেন নুডুলস বানিয়ে এনেছে সবার জন্য। অর্ন্যা আর তানিয়া চলে এলেই সবাই খাওয়া শুরু করবে। এদের সবার সাথে ভার্সিটি উঠেই পরিচয় হয়েছে ফারাবীর। ‘জানিস সন্ধ্যা?’ ‘না বললে জানব কীভাবে গরু!’ ফারাবী একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে অর্ন্যার দিকে তাকালো। তারপর সন্ধ্যাকে বলল, ‘আমি মনে হয় অর্ন্যার প্রেমে পড়ে গেছি।’ কথাটা বলতে না বলতেই অর্ন্যা আঁড়চোখে তাকালো ফারাবীর দিকে। তারপর আশেপাশে কি যেন খুঁজতে লাগল।

‘কি খুঁজছিস অর্ন্যা?’
‘লাঠি খুঁজছি।’
‘কেন কেন?’
‘তোকে আজকে সাইজ করব দাঁড়া।’
‘দোস্ত পারলে আমার সাইজটা পরিবর্তন করে একটু মোটা বানিয়ে দে। এরকম লাঠির মতো শরীর আর ভালো লাগে না।’

অর্ন্যা চোখ দু’টো বড় বড় করে ফারাবীর দিকে তাকালো। ‘যদি আমায় একটু মোটা বানিয়ে দিতে পারিস তবে আজকে বুফে নিয়ে খাওয়াবো তোকে।’ অর্ন্যা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর হাতে থাকা প্লেট নিয়ে ফারাবীকে তাড়া করলো। ‘দাঁড়া হারামজাদা দাঁড়া বলছি,মোটা হবি না? আয় আজকে তোকে প্লেট দিয়ে পিটিয়ে মোটা বানিয়ে দিব।’ ফারাবী দিয়েছে এক দৌঁড়। তাকে আর পায় কে!

‘অর্ন্যা?’ ফারাবী অনেকটা কবিদের মতো উদাসী ভাব নিয়ে অর্ন্যাকে ডাক দিলো। অর্ন্যা আইসক্রিম খেতে খেতে বলল-
‘দেখ ভাই এখন আইসক্রিম দিতে পারব না।’
‘আইসক্রিম লাগবে না।’
‘তবে কি?’ ফারাবী একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
‘তোর চোখগুলা এরকম মুরগীর আন্ডার মতো কেন রে?’

কথা শুনে অর্ন্যা আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে ফারাবীর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। ‘জানিস তোর দাঁতগুলা না একদম আহটের পেত্নীর মতো।’ ফারাবী কথাগুলো বলছে আর অর্ন্যা গরম লুচির মতো ফুলছে। ‘তোর নাকটা বানরের মতো বোঁচা। আর একটা যেন কি?’ ফারাবী উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল আর ভাবতে লাগল। ‘ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোর চুলগুলো ঘোড়ার লেজের মতো হিহিহি।’ ফারাবী চুপিচুপি আঁড়চোখে অর্ন্যার দিকে একবার তাকালো। সাথে সাথে ফারাবীর পিঠে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো অর্ন্যা। সাথে কানটা ইচ্ছেমতো টেনে দিলো।

‘হারামী,আজকে তোরে প্লাস্টিকের ঝাড়ু দিয়ে পিটাবো।’ ফারাবী উঠে দৌঁড় দিবে এমন সময় পিছন থেকে অর্ন্যা তাকে দাঁড় করিয়ে ফেলল।
‘এখন যদি চলে যাস তবে আমাকে আর পাবি না কিন্তু।’

এই কথা শুনে ফারাবী সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। ‘আমাকে রাগাতে খুব ভালো লাগে তোর?’ ‘হু।’ ‘আমি যখন থাকব না তখন কাকে রাগাবি?’ ফারাবী,অর্ন্যার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি দিয়ে বলল, ‘যা ভাগ। আজাইরা ইমোশনাল কথাবার্তা বলিস না তো।’ কথাটা বলেই অর্ন্যাকে একটা চোখ মেরে ফারাবী সেখান থেকে চলে গেলো। গুরু বলেছেন,একটা ছেলে আর একটা মেয়ে নাকি কখনও ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। একসময় না একসময় তারা একটা ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হবেই। ফারাবী দুষ্টামীর ছলে কখন যে অর্ন্যাকে ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না।

‘অর্ন্যা কোথায় তুই?’
‘কেন?’
‘কিছু বলার ছিল তোকে।’
‘আমারও কিছু বলার আছে তোকে।’
‘কি বলবি?’
‘তুই আগে বল।’
‘না তুই আগে বল।’
‘তুই বল।’
‘আই এম ইন লাভ উয়িথ ইউ।’

‘ফোনেই সব বলবি হাম্বা নাকি সামনাসামনি বলার জন্যও কিছু রাখবি?’
কথাটা শুনে এক নিমিষেই ফারাবীর মনটা ভরে গেলো।
‘অর্ন্যা কোথায় আছিস এখন?’
‘বাসায়। একটু পরে ব্যাংকে যাব।’
‘সেখান থেকে ফিরে দেখা করবি আমার সাথে?’
‘জানি না।’
‘মানে?’
‘বললাম তো জানি না।’
‘তার মানে দেখা করবি তুই?’

‘চুপ। রাখছি এখন। দেরি হয়ে যাবে পরে।’ ফোন রেখে ফারাবী দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। মার্কেট থেকে ২২০ টাকা দিয়ে একটা হাতের রিং কিনে নিলো। খালি হাতে তো আর প্রপোজ করা যায় না। আধাঘন্টা পর ফারাবী,অর্ন্যাকে ফোন দিলো।

‘অর্ন্যা কই তুই?’
‘এই যে ব্যাংকে।’
‘আর কতক্ষণ?’
‘এইতো আর পাঁচ মিনিট।’
‘জলদি আয়। আমি ক্যাম্পাসে বসে আছি।’
‘আচ্ছা আসছি।’

ফারাবী ভার্সিটি ক্যাম্পাসের বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার রিংটার দিকে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। ইশ,কখন যে অর্ন্যা আসবে!!! ‘এক্সকিউজ মি ভাই? শুনতে পাচ্ছেন?’ ফারাবী আনমনে হয়ে কল্পনার জগতে ডুবে ছিল। ব্যাংকের ম্যানেজারের ডাকে সে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো।

‘জ্বি স্যার বলুন।’
‘ভাই,ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে এখনই।’
‘ওহহ আচ্ছা। অর্ন্যা আসেনি ম্যানেজার সাহেব?’
ম্যানেজার সাহেব একটু দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,
‘না ভাই আজকেও আসেনি।’
‘আচ্ছা আমি তাহলে আসি।’
‘ভালো থাকবেন ভাই।’

ফারাবী এক্সিম ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে নিচের দিকে হাঁটতে লাগল। সেদিন যে অর্ন্যা ব্যাংকে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। তার কোনো খোঁজখবরও পাওয়া যায়নি। ফারাবীর সাথে অর্ন্যার শেষ কথাটা ছিল,’আমি আসছি পাঁচ মিনিট।’ কিন্তু আর কখনও ফিরে আসেনি অর্ন্যা। আজকে দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু অর্ন্যার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও। এই সাত বছর ধরে ফারাবী ব্যাংকের ভিতরে অর্ন্যার ফিরে আসার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে। মানসিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ সে। ব্যাংকের সবাই তাকে খুব ভালো করে চেনে। তার এই অপেক্ষার পিছনের কারণটাও সবাই জানে। সেজন্য প্রতিদিন এসে এখানে বসে থাকলেও কেউ তাকে কিছুই বলে না।

ফারাবী এখনও অপেক্ষা করে অর্ন্যা ফিরে আসবে বলে। হাতে থাকে সেই ২২০ টাকা দামী রিংটা। অর্ন্যা যখনই আসবে তখনই ফারাবী তাকে প্রপোজ করে ফেলবে এই আশায়। ফারাবী জানে অর্ন্যা তাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। সে একদিন অবশ্যই ফিরে আসবে। অবশ্যই আসবে।

জীবনে এমন কিছু কিছু ভালোবাসার গল্প থাকে যা কিনা অপেক্ষার মাঝেই সমাপ্ত হয়ে যায়। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু কিছু ভালোবাসার গল্প গভীর রাতে চোখের জলের অন্তরালেই রয়ে যায়। কেউ দেখতে পায় না সেটা। কিন্তু থেকে যায় কিছু স্মৃতি যা শত চেষ্টা করলেও ভুলা যায় না। সেই স্মৃতিগুলো মোড়ানো থাকে ডাইরির পাতায়।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত