ভালবাসার অভিনয়

ভালবাসার অভিনয়

আপনি কিন্তু আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন না। আমি আপনার বিয়ে করা বউ হলেও আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না। এক নিশ্বাসে কথা দুটি বললেন আমার সদ্য বিবাহিতা বউ হিমা। আমি যেন তার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেলাম। বিয়ের আগে আমি ওর সাথে কথা বলিনি আর ওর সাথে দেখা করা বা ছবি দেখা এমন কিছুই দেখিনি। বাবা মায়ের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করেছি ওরে কোথায় বিয়ে করছি নাম কি কিছুই জানিনা। আজই প্রথম দেখেছি ওরে আজই জানলাম ওর নাম।

অপ্সরীর মতো সুন্দর আমার বউ, চোখ দুটো দেখলে মনে হয় দুনিয়ার সব মায়া ওর চোখেই রয়েছে আর কাজল দিয়ে বসে থাকায় মায়াবী চোখ দুটো যেনো আরও মায়ায় ঢেকে যায়। চোখ জোরা যখন প্রথম দেখি তখন পণও করেছিলাম এই চোখে পানি আসতে দিবো না। কিন্তু এসব ভেবে এখন বিন্দুমাত্র লাভ নেই ও যে অন্যের। শুনেছি বাসর রাত জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত হয়। আজ তা আমি বিশ্বাস করি, এই শ্রেষ্ঠ রাতে আমার জন্য এতো বড় উপহার ছিলো তা ভাবতেই পারিনি। যে চোখে পানি না আসার জন্য পণ করেছি কিছু সময় আগে আর এখন সে চোখ জোরাই আমার সামনে অশ্রুসিক্ত। তাকে কান্না থামিয়ে,

আমিঃ আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো কিছুতেই জোর করবো না।

হিমাঃ জ্বি আচ্ছা।

আমিঃ আপনাদের রিলেশন কতো দিনের?

হিমাঃ ৩বছর ধরে আমি তাকে ভালবাসি।

আমিঃ সে কি করে?

হিমাঃ চাকরির জন্য চেষ্টা করছে।

আমিঃ আপনিতো এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আপনার ভালবাসার মানুষকি আপনাকে এখনো মেনে নিবে?

হিমাঃ আমি ওর কথাতেই বিয়ে করি, ও বাসায় জানাতে বারণ করেছে। বলেছে, বিয়ের পরে ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করে ওর কাছে যেতে।

আমিঃ আচ্ছা বুঝলাম। ( নির্বাক হয়ে ভাবছি কি বলবো! ভালবাসার মানুষ এমনো করতে বা বলতে পারে?)
হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে হিমা বলে উঠলো “ওর সাথে আমার সব হয়ে গেছে, আপনি চাইলেও কিছু পাবেন না!” আমি চোখ গরম দিয়ে ওর দিকে তাকালাম, কি হয়েছে জানিনে তবে এতোটুকু বুঝছি যে আমার সাথে ডিভোর্সটা হওয়ার জন্য সে বধ্য পরিকর। শুধু বলেছিলাম ” বিশ্বাস করতে বলেছি, নিজেকে বিলিন দিয়ে ছোট করতে বলিনি।”

আমিঃ আপনি এখানে শুয়ে পড়ুন আমি ওই সোফায় গিয়ে ঘুমাচ্ছি (রুমের ভিতরেই সোফা) বাইরে গিয়ে ঘুমালে সমস্যা হবে।

সে কিছুটা চিন্তা নিয়ে সম্মতি জানিয়েছে বৈকি কিন্তু এখনো আমার প্রতি অবিশ্বাস তার চোখে মুখে ভরপুর। এই শুনছেন! এই আপনি শুনছেন! ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি হিমা ডাকছে আমায়। কি সুন্দর লাগছে তাকে চিন্তিত ভঙ্গিতে, কেমন দিশেহারা হয়ে ডাকছে আমাকে। ওর হাতটা ধরতে যাবো হঠাৎই কাল রাতের কথা মনে পরলে লাফ দিয়ে উঠে গেলাম।

আমিঃ কি হয়েছে আপনার?

হিমাঃ আপনার ভাবিরা হয়তো ডাকছে। জলদি উঠে পরুন।

আমিঃ ওহ দেখছি।

অতঃপর ভাবিদের অত্যাচার শুরু করে হয়ে গেলো, তাদের আসাতে আমি অনেক খুশি হয়েছি। কারণ অল্প সময়ের জন্য হলেও সে এখন আমার স্ত্রীর ভূমিকা পালন করবে। দুজনকে একই সাথে পাঠাতে নিয়েছিলো বাথরুমে হিমা কোনো রকম সামাল দিয়ে বললেন সে আগেই গোসল করেছে। ভাবিরা তাই আমকেই পাঠালেন গোসলের জন্য, এইবার আমার খারাপ লাগা শুরু হয়েছে কারণ এখন আমিও যে মিথ্যে অভিনয় করতে যাচ্ছি। সারাদিন সবার মজার পাত্র হয়েছি, সবাই বলছে আমার উইকেট পরে গেছে আর আমি ভাবছি ৩য় আম্পায়ারের রিভিউ নিয়ে! এখন জীবনটা অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতোই হয়ে গেলো। বাবা-মায়ের ইচ্ছে তে বিয়ে করেছি ভাবছি জীবনের সব চেয়ে বড় সঙ্গী তারাই পছন্দ করবে কিন্তু এমন হবে বুঝিনি।

নিত্যনতুন অভিনয় করতে করতে নিজেকে এখন অনেক বড় অভিনেতা মনে হচ্ছে। আজ বিয়ের নবম দিন, অফিস থেকে ফেরার পথে ভাবলাম কিছু নিয়ে যাই হিমার জন্য। সে বউ না মানলে কি হয়েছে আমিতো তাকে ভালবেসে ফেলেছি তাই গোলাপ ফুল নিয়ে গেলাম পকেটে। বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে বেল দিতেই দরজা খুলে দিলেন হিমা, সাথে মায়াবী মুখের সেই হাসি। আমিও হাসি মুখে ঢুকে রুমে চলে এলাম, ভাবছি আমাকে দেখে বা আমার সামনে তো এরকম ভাবে কখনো হাসেনি সে! রুমে ঢুকে কাপড় বদলে রাখতে যাবো ওমনি গোলাপটা পরে গেলো পকেট থেকে। হিমাও হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলো, সে দৌড়ে এসেই হাতে তুলে নিলো গোলাপটা।

হিমাঃ আমাকে যদি কেউ এই গোলাপটা দিয়ে প্রোপোজ করতো!

আমিঃ মানে কি? না মানে আপনি এই কথা বলছেন কিভাবে?

হিমাঃ কেনো আমার কি ভালবাসা পেতে নেই?

আমিঃ আপনার ভালবাসার মানুষ তো আছেই তাইলে নতুন করে কিভাবে এটা বলতে পারেন?

হিমাঃ হুম আছে কিন্তু সে এখনো আমাকে ভালবাসার প্রস্তাব দেয়নি।

আমিঃ আপনি একটু শুয়ে বিশ্রাম করে নিন। বোধহয় বিয়ে ভাঙার চক্করে আপনার মাথা কাজ করে না।

শুনেই খিলখিল করে হেসে দিলো হিমা, সে হাসির বর্ননা দেয়া সম্ভব নয়। আমার ঘরওয়ালী যে এতো সুন্দর করে হাসতে পারে তা আজ প্রথম দেখলাম আমি।

হিমাঃ আমার মাথা ঠিকি আছে, আপনাকে যা বলি সেটা করেন।

আমিঃ কিহ?

হিমাঃ আমাকে প্রপোজ করুন এখনি?

আমিঃ একটু তাকানতো আমার দিকে! কপালে কি লিখা আমার? আমি গাধা? কোন দুঃখে অন্যের ভালবাসার মানুষকে প্রপোজ করবো আমি?

হিমাঃ (হেসে নিয়ে) যা বলছি করেন নয়তো পরে আফসোস করবেন।

আমিঃ কখনই না। আগে বলুন কাহিনী কি?

হিমাঃ কোনো কাহিনী না আপনি করুন জলদি?

আমিঃ আগে বলেন।

হিমাঃ আসলে আমি কখনো ছেলেদের সামনেই তেমন যাইনি প্রেম তো দূরের কথা। আপনাকে যা বলেছি তার মধ্যে একটা সত্যি বাকি গুলো মিথ্যে, হ্যাঁ আমি ৩বছর ধরে একজনকে ভালবাসি ঠিক আছে কিন্তু সে নিজেও জানেনা সম্পর্ক তো দূরের কথা।

আমিঃ একটু চিমটি কাটেনতো হাতে (হাত বারিয়ে দিয়ে)!আসলে আমার মাথায় না কিছু ঢুকছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি, একটু খুলে বলবেন কি?

হিমাঃ ঘটনা শুরু আজ থেকে ৩বছর আগে ঠিক আজকের দিনটায়। আমি কলেজ থেকে হোস্টেলে ফেরার পথে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পরি, আমার হুস ছিলো কিন্তু গায়ে কোনো শক্তি ছিলো না। আশেপাশে উৎসুক জনতার ভীড় হয়ে গেলো নিমিষেই, খারাপ ভাল মিলিয়ে সবাই আমাকে নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিচ্ছে। কেউ বলছে হাসপাতালে নিবে আবার কেউ বলছে আশেপাশে কোথাও বসাবে কিন্তু কেউ কাছে আসছে না আমার। আমি তখন কান্না করতে শুরু করি লজ্জায়। ঠিক তখনই ভীড় ঠেলে একজন এলো আমাকে দেখলো আবার চলে গেলো আবার এসে কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমাকে তুলে গাড়িতে উঠানোর জন্য কিন্তু কেউ তার কথা কানে নেয়নি দেখে সে নিজেই আমাকে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে এলো। যা যা কর্তব্য ছিলো সব সে করে আমার বন্ধুদের ফোন করে এনে চলে গেলো কিন্তু আমার সাথে একটি কথাও সে বলেনি বন্ধুদের নাম্বার নেয়া ছাড়া আর আমি বোরকা পরায় সে দেখেওনি আমকে।

পরে আমি তাকে খুজতে শুরু করি অনেকদিন পর ঠিক সেই জায়গায় যেখানে আমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম ওইখানেই তাকে দেখি হয়তো অফিস শেষে সে বাসায় যাচ্ছিলো। তারপর থেকে প্রায়ই দেখতাম তাকে ওইখান দিয়ে যেতে আর দিন দিন তাকে দেখা আমার অভ্যাস হয়ে গেলো আমি অপেক্ষাও করতাম তাকে দেখার জন্য। পরে বুঝতে পারি আমি তারে ভালবেসে ফেলি, আর তারপর তার বাসা চিনে আমি নিজেই তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই বাবাকে বলে এখন বিয়ে করে সে মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি এতোক্ষন ওর কথাগুলো শুনছিলাম ওর সামনে দাঁড়িয়ে কিন্তু চলে গিয়েছিলাম ৩বছর আগের ওই দিনটায়। অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় এই ঘটনা ঘটেছিলো পরে ভূলে গিয়েছিলাম আর সেই ঘটনার জন্য আমার জীবন যে এভাবে মোড় নিবে তা কখনো কল্পনাই করিনি আমি। নিরবতা ভেঙ্গে

আমিঃ তাইলে এই মিথ্যে অভিনয় কেন করলেন?

হিমাঃ বিয়ের দিন বলবো ভাবছিলাম কিন্তু আপনার ধৈর্য আর আপনি মানুষটি কেমন তা পরক্ষ করে দেখতে চেয়েছি আর আজকের দিনের অপেক্ষা।

আমিঃ তাইলে এখন আপনিই আমাকে প্রপোজ করুন আমি এতো কিছু সহ্য করেছি আর কিছু করতে পারবো নাহ।

হিমাঃ আগে বলুন এই গোলাপটা আপনার পকেটে কিভাবে এলো এটা কার জন্য?

আমিঃ হায়রে নারী জাতি! সন্দেহ করা ছাড়ে নাহ। আপনার জন্যই

হিমা গোলাপটি আমার পাণে বারিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলছে, “সারাটা জীবন আপনার পাশে থাকতে চাই আপনার হৃদয় মাঝে আপনার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে, একটু ঠাই হবে আমার?” আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি কিছু বলছি নাহ। ওরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি বুকের মাঝে আর বুঝতে পারলাম ৩য় আম্পায়ার ১ম আম্পায়ারের সাথে সহমত পেশ করেছেন।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত