আজ প্রীতির বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব দিয়ে বাড়ি ভরপুর।প্রীতি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছে। তার মা বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। যদি ও বিয়েতে প্রীতির কোন মতামত নেয়া হয় নি। লাল বেনারশি শাড়িতে প্রীতিকে সত্যিই অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
লাল রং টায় প্রীতিকে বরাবরই সুন্দর মানায়। দূরে দাঁড়িয়ে সায়ন মুগ্ধ হয়ে প্রীতিকে দেখছে। সায়ন কল্পনায় যেমনটা দেখেছিল তার থেকে ও একটু বেশীই সুন্দর
লাগছে আজ। সায়ন প্রীতির ক্লাসমেট এবং অনেক ভাল বন্ধু।
যদিও এই বন্ধুত্বের মাঝে কখন যে মনে মনে প্রীতিকে ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজে ও জানে না। কিন্তু কখনো সেই ভাল লাগার কথা প্রীতিকে বলার মত সাহস পায় নি। যদি সে আবার তাকে ভুল বোঝে তাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে সায়ন আসতে চায় নি। প্রীতির অনেক চাপাচাপির কারণেই তার আজ আসা।
সবাই বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু সায়ন চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে প্রীতিকে দেখছে। এরই মাঝে অন্যান্য বন্ধুরা তাকে কয়েকবার করে ডেকে গিয়েছে কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। কেন জানি সায়নের মনে হচ্ছে যে আর কোন দিন
সে প্রীতিকে দেখতে পাবে না।প্রীতি আজকের পরে থেকে অন্য কারো হয়ে যাবে।
আর কখনো হয়ত মন খুলে প্রীতির সাথে কথা বলতে পারবে না, অকারণে ঝগড়া করতে পারবে না। হঠাৎ সব কিছু শূণ্য শূণ্য লাগছে। মনে হচ্ছে জীবন থেকে অনেক মূল্যবান কিছু সে হারিয়ে ফেলছে। তার কল্পনার মনের মানুষটা আজ তার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে তার পাশে এসে প্রীতি দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়ালই করে নি।
কিরে হাবার মত এই খানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান? সায়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কিছুনা, এমনি দাঁড়িয়ে আছি। তুই এই খানে ক্যান? একটু পরে তো বর যাত্রী চলে আসবে।
প্রীতি একটু হেসে বলল, হুম আসবে। তোকে অনেক্ষণ থেকে একা একা চুপ চাপ এই খানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এলাম। তোর কি কোন কারণে মন খারাপ? সায়ন মুচকি হেসে বলল, আরে নাহ।
এমনি দেখতেছিলাম বিয়ের আয়োজন। ভাবতেছিলাম যে কি কি খাব তোর বিয়েতে। এই মূহর্তে সায়নের ইচ্ছে করছে প্রীতির হাত দুটো ধরে বলতে যে তোকে অনেক ভালোবাসি, তুই অন্য কারো হবি এটা মেনে নিতে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।
তোকে ছাড়া বাকিটা জীবন চলতে পারব কিন্তু সেটা হবে অনেক কষ্টের। এই কথা গলো বলার মত সাহস সায়ন এর হয়ত কখনোই হবে না।
আচ্ছা প্রীতি একটা কবিতা শুনবি শেষবারের মতন?? হু বল,প্রীতির কথা শেষ হতেই সায়ন ভরাট কন্ঠে আবৃতি শুরু করে,
“তোমাকেও উঠিয়েছিল, আমাকেও উঠিয়েছিল, পার্থক্য ছিল শুধু এতটুকুই; তোমাকে পালকি তে আর আমাকে খাটিয়ায়।
সুর দুই জায়গাতেই বেজেছিল, পার্থক্য ছিল শুধু এতটুকুই; এক জায়গায় আনন্দের আর অপর দিকে বেদনার।
দোয়া-কালাম দুই জায়গাতেই পড়েছিল, পার্থক্য ছিল শুধু এতটুকুই; তোমার ওখানে কাজি ছিল আর আমার এখানে মৌলভি।
তোমাকেও সাজিয়েছিল, সাজিয়েছিল আমাকেও, পার্থক্য ছিল শুধু এতটুকুই; তোমাকে লাল বেনারশি দিয়ে আমাকে সাদা কাফন দিয়ে।
একটি প্রেমের সম্পর্কের বিয়োগাত্মক যবনিকাপাত, কি নির্মম উপহাস এই নির্দয় পৃথিবীর!!!
একদিকে প্রেমিকের শেষকৃত্য, অন্যদিকে প্রেমিকার বিবাহ উৎসব।”
সায়ন থামতেই প্রীতি বলে এই আজ তোর কি হয়েছে,এটা কেমন কবিতা??
সায়ন হেসে বলে এটা বিয়োগাত্মক কবিতা হা হা হা…ও তুই বুঝবি না।থাক বাপু ওতো বুঝতেও চাই না তুই সত্যি একটা মাথা পাগল।
তুই থাক আমি যাই বলেই প্রীতি চলে যেতে উদ্ধত হয়,তাকে থামিয়ে দিয়ে সায়ন বলে এই শুন এই বিয়েতে কি তুই সত্যি খুশী?
আজব খুশী হব না কেনো! ছেলেটাকে আমার ও পছন্দ তাছাড়া মা-বাবা সবাই রাজি।হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি যে?
প্রীতির জবাবে সায়ান বলে আরে না এমনি,ভাবলাম বাংলা সিনেমার মত তোর অমতে বিয়ে হচ্ছে কিনা।
হেসে প্রীতি বলে না বন্ধু দিন বদলাইছেনা?এখন তাই হচ্ছে সবাই যা চাচ্ছে।প্রীতি চলে যায়…….
সায়ন ভাবে আসলেই তো তাই হচ্ছে যা প্রীতি চাইছে,তবে কেনো শুধু শুধু আশায় থাকা?ভাল থাক প্রীতি,সে না হয় একাই ভালবাসা পুষে যাবে।সব প্রেমের শুরু বন্ধুত্বে হয়,কিন্তু সব বন্ধুত্ব প্রেমে বদল হয়না।তাদের সম্পর্কটাও হয়ত সেরকম।
সবার সব ইচ্ছা কি চাইলেই সম্ভব হয়?আচ্ছা সায়নকে যদি এই মুহূর্তে কেউ বলতো তোমার কোন ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাও বলো?সে কি বলতো?
মানুষের যেনো আর কখনও কোনো ইচ্ছে না হয় এই ইচ্ছেটা।ভালবেসেও না বাসার অভিনয় করাটা যে কি দুঃসহ তা আজ প্রীতির বিয়েতে এসে সায়ন বুঝতে পারছে।নাহ আর এখানে থাকা যাবেনা বরযাত্রীরা হয়ত এসেই গিয়েছে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটেই যাচ্ছে সে প্রীতির বাড়ির কোলাহল ছেড়ে,প্রীতিকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে।
এতক্ষণে হয়ত বিয়ে পড়ানো শেষ হয়ে গেছে,আজ থেকে তাদের চলার গতিপথ আলাদা।ক্লাস শেষে আর বিরামহীনভাবে হাঁটা হবেনা কোনদিন,ক্যাম্পাসে আর
বসবে না আড্ডার আসর।সব ছেড়ে আজ যেন প্রীতি অনেক অনেক দূরের মানুষ।
যে জানবেনা কোনদিন কাছে থেকেও কেউ একজন তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসেছিল।বাসের সিটে বসে একটা ছেলে অঝর ধারায় কাঁদছে,বাসের সবাই কৌতুহলী হয়ে বারবার তাকাচ্ছে।কিন্তু কেউ জানেনা এই
ছেলেটা এভাবে কেন কাঁদছে!
গভীর দু:খ থেকে নিঃসৃত যে কান্না,যে কান্না কষ্ট ব্যথা অপ্রাপ্তির আর যন্ত্রণার।সায়নের প্লে লিস্টে ফুল ভলিউমে তখন বাজছে অহেতুকের গান যে গান অব্যক্ত বেদনার ……….
“বন্ধু আমার চুলগুলো দেখ কেমন এলোমেলো,তুই কাছে নেই শান্ত আমি কোথায় যে পালাবো।তোর ই ঠোঁটের ডান দিকের ঐ ছোট্ট কালো তিল একটু ছুঁতেই মনের মাঝে উষ্ণতার মিছিল।তুই নামের এক রঙে আঁকা আমার এ পৃথিবী বলনা বন্ধু আছিস কোথায় কবে আমার হবি।
স্বপ্নগুলো দিচ্ছে ঝাড়ি রাখছি কেনো দূরে,তোকে ছাড়া স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয় কি করে।সময়টার ও মনটা খারাপ আজ বিচ্ছেদের অনশন,তোর গল্পটা লিখতেই হবে মন চাইবে যখন।চাঁদের আলো জানালাতে রয়েছে দাঁড়িয়ে এই যে বুঝি তুই এসে হাতটা দিল বাড়িয়ে।
তুই নামের এক রঙে আঁকা আমার এ পৃথিবী বলনা বন্ধু আছিস কোথায় কবে আমার হবি।”
সুখে থাকো প্রীতি,ভাল থাক শেষে লেখা ইতি। সায়াণ্হের শূণ্যবিন্দুতে পূর্ণ হোক সব অপ্রাপ্তি।সায়ন বর্তে থাকো এটাই শুধু বলবো,শেষমেশ তোমার বিচ্ছেদ ই দিলাম।অতীতের কষ্ট ভবিষ্যতের আনন্দ হয়ে ছড়াক।
আর উল্লেখিত কবিতাটা অশ্রু ভাইয়ের ‘উপহাসের পৃথিবী’ না বলেই দিয়ে দিলাম,আদরের বোন তো তাই আমার সাত খুন মাফ হাহাহা।