কর্মফল

কর্মফল

বুক থেকে আঁচল সরিয়ে স্তনপান করার জন্য উতলা হয়ে কাঁদতে থাকে আমার সদ্য হামাগুড়ি দিতে শিখতে পারা বাচ্চাটা। আমি মেঝেতে পড়ে আছি, উঠে বাচ্চাটাকে ঠিকভাবে খাবার খাওয়াবো সেই শক্তি টুকু এই মূহুর্তে আমার ভিতরে নেই। থাকবেই বা কিভাবে , নিলয় (আমার স্বামী) আজ প্রথম আমাকে এতো বেশি মারছে। শরীরের বেশ কয়েক স্থান থেকে রক্ত বের হয়ে অণুচক্রিকার কারনে জমাট বেধে আছে।

কিন্তু আমার চোখের পানিতে তো কোনো অণুচক্রিকা নেই, যার ফলে চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। ওয়াশরুম থেকে নিলয় বাইরে বের হয়ে আসলে আমার ভিতরে ভয় কাজ করে এই বুঝি আবার মারতে শুরু করে আমায়। কিন্তু নিলয় আমাকে প্রায় কোলে করে খাটের উপর শোয়ায় আমাদের বাচ্চা (তানহা) কে খাওয়াতে বলে রুম থেকে বের হয়ে বাইরে চলে যায় । আমিও কষ্ট করে উঠে তানহা কে খাওয়ায় ঘুম দিলাম।

ছয়মাস রিলেশনের পর অনেক ঝড় তুফান কে উপেক্ষা করে বিয়েটা হয় আমাদের পারিবারের সম্মতিতে। দেশের দুই প্রান্তে দু’জন এর বাড়ি হওয়াতে এ সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ ছিলো নিলয়ের পরিবার। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আমাদের সুষ্ঠু ভাবেই সম্পন্ন হয়। নিলয় আর আমার চাকরি ঢাকার একই অফিসে হওয়াতে আমরা আগে থেকেই ঢাকায় ছিলাম, আমি ছিলাম ফুপির বাসায় আর নিলয় মেসে। বিয়ের পর একসঙ্গে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি শুরুতে।

প্রথম কয়েকমাস ভালোই স্বপ্নের মতো কেটে যায় দিনগুলো। সকালে উঠে আমি রান্নাঘরে গেলে নিলয় রুম গুছায়, আর নিলয় শখ করে রান্নাঘরে গেলে আমি দ্রুত রুমের কাজ শেষ করে রান্নাঘরে ওকে সাহায্য করি। গোসল শেষে আমি যখন চুল শুকাতে ব্যস্ত নিলয় তখন আমার চুলের স্মেইল নিতে মগ্ন থাকতো বিশেষ করে শ্যাম্পু করার সময় গুলোতে। ছুটির দিনগুলো বাইরে একটু দূরে কোথাও ঘুরতে যেতাম, যেদিন দূরে কোথাও যাওয়া হতো না, সেদিন সন্ধ্যার পর কাছেই হেঁটে আসতাম।

বিয়ের একবছর পর চাকরি টা ছেড়ে দিই আমি, অফিস থেকে বাসায় ফিরে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি আর বাসার কাজ অফিস সামলানো অনেক চাপের হয়ে পড়তো। তবুও আমি ছাড়তে চাইনি, নিলয় জোর করে ছাড়িয়েছে চাকরিটা। চাকরি ছাড়ার কিছুদিন পর নিলয় আমার গায়ে প্রথম হাত উঠায়, যতোটা না কষ্ট পাই তার থেকে অবাক হই বেশি নিলয় এর এই আচরণে। মন থেকে সুখের আলো টা নিভে গিয়েছিল কয়েকঘন্টার জন্য তখন। প্রথম গায়ে হাত তুলে খাবার এ আমার মাথার চুল পাওয়ার কারনে। অথচ এই নিলয় একসময় আমার চুলের ভিতর হারিয়ে যেতো। বড্ড কষ্ট লাগে মনে, কিন্তু পরক্ষণে নিলয় সরি বললে সব ভুলে যাই।

নিজে একলা দুইবার বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম, কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় একাকিত্বকে সঙ্গী করেই ঘুমিয়েছি। নিলয়ও বেশি দিন আমায় ছাড়া থাকতে পারে না , তাই নিজে থেকে খাওয়ার সমস্যা এটা ওটা বাহানা দেখায় নিয়ে আসতো আমায়। আসলে বিয়ের পর থেকে আমায় ছাড়া ঘুমাতে পারে না নিলয় আর আমিও। এরপর আরো কয়েকবার নিলয় ছোট ছোট কারনেই আমার গায়ে হাত তুলতো, নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না নিলয় এখন । আমি তখন থেকে ভুল কম করার চেষ্টা করি। নিলয় এর ভালোবাসাটা অচেনা লাগে আমার কাছে কেমন যেনো বুঝতে পারি না আমি। সন্ধ্যায় মেরে বাইরে বেড়িয়ে যাবে আর রাতে ঔষধ আমার পছন্দের কোনো জিনিস নিয়ে বাসায় ফিরে আমার অভিমান ভাঙ্গাবে।

কোনো রাত যদি আমি অভিমান করে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ি সকালে উঠে দেখি নিলয় আমার পাশে। তখনই আমার সমস্ত রাগ অভিমান কোথায় যেনো পালিয়ে যেতো। নিলয়ের ভালোবাসার কাছে তার অত্যাচার গুলো নগন্য মনে হয় আমার। মাসের তিরিশ দিনের সাতাইশ দিনে স্বাভাবিক থেকে ভালোবেসে বাকি তিনটা দিন মারলে আমার কিছু মনে হয় না। এখন মাইরের পর সারারাত ঘুমাতে পারি না, যদিও তানহা আমার বুকে আর আমি নিলয়ের বুকের পাশে শুই। এতটা কষ্ট লাগে বুকের ভিতরে আমার৷ মাইরের জন্য আবেগি হয়ে কখনো নিলয়কে কিছু বলা হয়নি। কাঁদলেও নিলয় এর থেকে দূরে গিয়ে কাঁদছি।

কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই আর, আজ গায়ে হাত সহ প্যান্টের বেল্ট পর্যন্ত উঠালো নিলয়। বেশকিছু দিন থেকে নিলয়ের এক মেয়ে কলিগ খুব কল দেয় নিলয়ের মোবাইলে। প্রথম কয়েকদিন স্বাভাবিক ভাবেই নিলেও পরে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগে আমার কাছে। সকালে উঠে নাকি নিলয়ের শরীরটা ভালো লাগছে না অফিসে একটু দেরি করেই যাবে বলে বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছে। এমন সময় নিলয়ের মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বাজাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি সেই কলিগের টেক্সট, এখনো আসছেন না কেনো অফিসে আপনি?

দেখে আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না, আমার স্বামী অফিসে দেরি করে যাবে তাতে তার কি। নিলয়ের কাছে গিয়ে টেক্সটটা দেখিয়ে জবাব চাইলাম কি সম্পর্ক এই মেয়ের সাথে তার? নিলয় বলছিলো অফিসের কলিগ, আমি বিশ্বাস না করে আবার বলি সত্যি করো বলো তানহার আব্বু কে এই মেয়ে। হাতে থাকা চায়ের কাপটা সজোরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তখনি মাইর শুরু করে নিলয়।

এখন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুঃখ বিলাস করছি। নিলয় ফিরে আসলো হাত ভর্তি কিসব নিয়ে। এসে আমাকে উঠায় জমাট বাঁধা রক্ত গুলো পরিস্কার করে ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে বললো, আজ আর অফিসে যাবে না সে। আমি চুপ করে আছি, ভাবছি থাকবোনা আর নিলয়ের সাথে, সারাদিন শুয়ে শুয়ে নানা কল্পনা জল্পনা করলাম কিন্তু ফলাফল শূন্য। নিলয়কে ছাড়া বাঁচতে গেলে আমায় পঙ্গু হয়ে বাঁচতে হবে। আমার সন্তানটা বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে, সমাজের দৃষ্টিতে আমি অসহায় হয়ে পড়বো। তার থেকে ভালো মাঝে মধ্যে কষ্ট সহ্য করে নিলয়ের সাথেই থাকি।

কয়েকদিন ভালোই কাটলো নিলয় ভালো হয়ে গেছে অনেকটা, হঠাৎ আজ রাতে ঘুম ভেঙে দেখি নিলয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছে মোবাইলে। রাত দুটা পার হয়ে গেছে এখন কার সাথে কথা বলবে নিলয়, আস্তে আস্তে বেলকনির দরজার কাছে দাড়িয়ে বুঝতে পারি সেই কলিগের সাথে কথা বলছে। বুকের ভিতর সহ পুরো শরীর কাঁপা শুরু করে আমার, তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিলয়ের কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়ায় ধরলাম নিলয়কে আর বললাম, কিগো তুমি এতো রাতে বাইরে আমায় একলা রেখে? নিলয় ফোনটা দ্রুত এমন ভাবে কেটে দিলো যাতে আমি বুঝতে না পারি, নিলয়ও পিছন ফিরে আমাকে জড়িয়ে বললো বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে রুমে চলো।

আমি– না, এই বাতাসে দু’জনে একটু বসে থাকি বলে নিলয় কে চেয়ারে বসায় দিলাম আর আমি নিলয়ের হাঁটুর উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলাম। নিলয় তখন আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলো। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর রুমে ফিরে আসি।

এখন নিলয় অফিসে গেলে নিজে থেকে কখনোই আর নিলয়কে কল দিই না, নিলয়ও দেয়না। বাসায় ফিরার পর যতোসম্ভব নিলয়ের থেকে দূরে থাকি। নিলয়ের সেই কলিগের ফেসবুক আইডি খুঁজে বের করি, অন্যন্যা অপ্সরী নাম মেয়েটার বেশ সুন্দরী। কিন্তু আমিও তো কম নই তার থেকে, তানহা হওয়ার পর থেকে নিজের শরীরের যত্ন নেয়ার সময় পাইনি। আজ বুঝতে পারছি আমি কতটা মুটিয়ে গেছি আর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। এজন্য কি নিলয় আমাকে এ্যাভোয়েড করছে আমায় হাজারো প্রশ্ন জাগছে মনে আমার।

নামাজ, রোজা করে আল্লাহকে সবসময় ডাকতে লাগলাম, আবার আগের নিলয়কে ফেরত চাইলাম আল্লাহর কাছে। কিন্তু কোনো সুফল পাচ্ছি না, এ কোন পরীক্ষায় ফেললো সৃষ্টিকর্তা আমায় নিজের বৈবাহিক সম্পর্কের এতো অধঃপতন সহ্য করতে পারছি না আমি। ফেসবুকে দেখলাম নিলয় আমার সাথে উঠানো সব ছবি ডিলিট করে ওর সিঙ্গেল ছবি রাখছে সব আর প্রতিটা ছবিতেই ওই মেয়েটার লাভ রিয়েক্ট আর কমেন্ট। বুকের ভিতর কষ্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আমার, মেয়েটাকে আমার আইডি থেকে কি মনে করে রিকুয়েষ্ট দিয়ে পরে ক্যান্সেল করলাম।

আজ জেমি’র কথা খুব মনে পড়ছে আমার, কতোই না কাঁদ ছিলো মেয়েটা আমার কাছে এসে, তার নিলয় কে ফেরত চাইতে গ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে আসছিলো ছয় বছরের ভালোবাসার সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে নিলয়কে তাঁর পাশে না পেয়ে । সেদিন আমি কোনো কথা শুনিনি জেমি’র এতটাই নিলয়ের প্রেমে ডুবে ছিলাম। নিলয়কে নিজের বশে এনে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজটাও সম্পন্ন করি, অনেক ঝড় তুফান উপেক্ষা করে। জেমির ভালোবাসা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম স্বার্থপর, লোভীর মতো। বুঝতে চেষ্টা করি নাই একবারো জেমির চোখের পানির ভাষা, মূল্য দেই নাই এতটুকু।

আর আজ আমি ২য় জেমি হতে চলেছি মনে হয়। জেমির কাছে ক্ষমা চাইবো আমি আমার অতীতের পাপের জন্য, যদিও ক্ষমা পাওয়ার আশা করা মূর্খতা হবে তবুও ক্ষমা চাইবো আমি। তানহা কাঁদছে বুকে জড়ায় নিলাম মেয়েকে, আমি যাবো সেই মেয়ের কাছে দরকার পড়ে ওনার পায়ে পড়ে আমার স্বামীকে ভিক্ষা চাইবো।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত