অপয়া

অপয়া

-হায়, আল্লাহ গো আমি এইটা কি অপয়া বউ ঘরে আনলাম গো, আমি বার বার মানা করার পরেও আমার ছেলে এই অপয়ার রুপ দেখে বিয়ে করার জন্য পাগল হইছে গো ।ও রুবেল ,রুবেল রে তোরে বার বার কইছিলাম, যে মাইয়া পেটে আসার সাথে সাথে বাপ মরে, হওয়ার সময় মা মরে , মামীর কাছে আসার পরে মামার ব্যাবসা শেষ করছে । এই মাইয়া আমার সংসারে আসলে আমার সংসারও শেষ করবো ।

তুই আর তোর বাপ আমার কথা শুনছ নাই । এখন দেখ এই মাইয়া ঘরে ঢুকার দুই – তিন ঘণ্টার মধ্য তোর বাপেরে খাইছে ।আমারে বিধবা বানাইছে গো । রুবেল তুই তাড়াতাড়ি এই মাইয়ারে আমার বাড়ি থেকে বাহির কর । আমার সামনে থেকে সরা এই অপয়ারে বলতে বলতেই রুবেলের মা আতিয়া বানু তৃতীয় বারের মতো জ্ঞান হারালেন ।আতিয়া বানুর চিৎকারে বদলকোট গ্রামের আকাশ বাতাস সেই বিকাল থেকে ভারি হয়ে আছে ।আসে-পাশের বাড়ির বউ মেয়েরা দুই একজন করে বিকাল থেকে মুন্সি বাড়ির নতুন বউ দেখার জন্য আসছিল । আর বাকিরা ভেবেছে কাল পরশু হাতের কাজ সামলে নতুন বউ দেখতে যাবে । কিন্তু যখনি রুবেলের বাবা মামুন মুন্সি মারা গেলেন ।

আর রুবেলের মা নিজের ছেলের নতুন বউকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে লাগলো ।সাথে সাথে সকল বউ, মেয়েরা , মা ,চাচীরা সকলে ছুটে আসতে লাগলেন অপয়া বউ দেখার জন্য । যে বউ বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে শ্বশুর মারা গেলেন সেই বউকে তো দেখতেই হবে । মামুন মুন্সির ছোট ভাই বেলাল মুন্সি তার বড় ভাবির নির্দেশে রুবেলের শ্বশুর বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন । যাতে এই বাড়িতে অন্য কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগে এই অপয়াকে তারা নিয়ে যায় ।রুবেলের শ্বশুর বাড়ি ভুল বললাম । আসলে যে বাড়ি থেকে রুবেল বিয়ে করে বউ আনল এইটা ওর মামা শ্বশুর বাড়ি । রুবেলের বউ লতা । এই লতা যখন ওর মায়ের পেটে তিন মাসের সে সময় ওর বাবা মারা যায় । জন্মের সময় লতার মা মারা যায় ।মা মারা যাবার পরেই লতার দাদি ঘোষণা দেন এই মেয়ে অপয়া ।

সে জন্যই দুনিয়াতে আসতে বাবা,মা দুইজনকেই খেয়ে তারপরে আসছে । সুতরাং এই মেয়েকে কোন মতেই নিজেদের কাছে রাখা যাবেনা । ওকে কোন মাজারের বা মসজিদের সামনে ফেলে আসবে । কিন্তু বাধ সাধলেন লতার বড় মামি । উনি দুই দিনের লতাকে কোলে নিয়ে পরম মমতায় নিজের কাছে নিয়ে আসলেন ।লতার বড় মামা –মামীর নিজেদের তিন সন্তান থাকার পরেও কোন এক অজানা কারনে উনারা পরম মমতায় এই লতাকে মানুষ করেছেন । লতার বয়স যখন তিন বছর সে সময় পর্যন্ত ওর বড় মামার অবস্থা খুব ভালো ছিল ।কিন্তু তারপরে আস্তে আস্তে উনার ব্যাবসা খারাপ হতে থাকল । আর গ্রামের সকলে বলাবলি করতে লাগলো এই মেয়ের কারনেই আজ ওদের এই অবস্থা । সেই থেকে এই ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত লতা কয়েক লক্ষ্য বার এই অপয়া শব্দটা শুনেছে ।

যদিও ওর মামা-মামির সামনে কেউ এই কথা বললে উনারা ওদের ছেড়ে দিতেন না । তাই সকলে ওদের সামনে না বল্লেও লতাকে দেখলেই নানা কথা বলতো। কারো বাড়িতে কোন শুভ কাজ হলে সেখানে লতা ছিল নিষিদ্ধ । গ্রামের মেয়েদের সাধারনত ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্য বিয়ে হয়ে যায় । আর যদি মেয়ে সুন্দর হয় তাহলেতো স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই বিয়ে হয়ে যায় । আগুনের মতো লতার রুপ হবার পরেও অপয়া বলে এতদিন লতার জন্য আসা সব বিয়ের সম্বন্ধ ভেস্তে গেছে । ছেলে পক্ষ মেয়ের খবর নিতে আসলেই গ্রামের কতিপয় মানুষ নিজ দায়িত্তে লতার জীবন বিত্তান্ত ওদের বলে দিতো । আর সব শেষে বলতো বুঝেন এমন মেয়ে নিজের দাদিই অপয়া বলে বাড়ি থেকে বাহির করে দিছে । তারপরেই আর কেউ লতাকে নিজের বাড়ির বউ করে নিবার সাহস করতনা ।

এইদিকে বদলকোট গ্রামের মুন্সি বাড়ির ছেলে রুবেল দীর্ঘ ৭ বছর পর কাতার থেকে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসছে বিয়ে করার জন্য । কিন্তু তিন মাস চলে যাবার পরেও কোন মেয়ে পছন্দ না হবার কারনে সে বিয়ে করতে পারছিলনা । এইসময় রুবেলের এক চাচা লতার কথা বলেন । পরের দিনই রুবেল ,তার বাবা আর মা গিয়ে মেয়ে দেখে আসেন । লতাকে দেখেই মামুন মুন্সির মেয়ে পছন্দ হয়ে যায় । রুবেলও রাজি । কিন্তু মেয়ের খবর নিবার পরে আতিয়া বানু কিছুতেই এই মেয়েকে বিয়ে করাতে রাজি ছিলেননা ।ধর্ম-কর্ম করা মামুন মুন্সি এইসব কথায় একদম বিশ্বাস করতো না ।উনার কথা ছিল আল্লাহর দুনিয়ায় কোন মানুষ অপয়া হয়না ।এইগুলা আমরা বানাই । এই মেয়ের বাবা মার হায়াত শেষ হয়ে গেছে তাই উনারা মারা গেছে । এই মেয়ের কি দোষ!! রুবেল রাজি থাকলে বিয়ে এইখানেই হবে ।

রুবেলের সম্মতিতে আজ দুপুর ১-৪৫ মিনিটে রুবেলের সাথে লতার বিয়ে হয়ে যায় । বউ নিয়ে বাড়ি আসার পরে হটাৎ করেই বিকালের দিকে রুবেলের বাবা অসুস্থ হয়ে যান ।আর রুবেল উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে যেতেই রাস্তায় উনি মারা যায় ।যদিও ডাক্তার বলেছেন হাই প্রেশারের রুগি অতিরিক্ত খাবার দাবারের কারনে প্রেশার হাই হয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন । তারপরেও আতিয়া বানু সহ গ্রামের সকলের বিশ্বাস এই অপয়া বউর কারনেই এই ঘটনা ঘটেছে ।লাশ মাটি হবার আগেই লতার মামা আর মামাতো ভাই এসে হাজির হয়েছে । লতার বিয়ে ঠিক হবার পরে, বিয়ে হবার আগ পর্যন্ত ওর বিশ্বাসই হচ্ছিলনা যে ওর বিয়ে হবে । বারবার মনে হয়েছে এই বুঝি কোন বাধা আসবে আর বিয়ে ভেঙ্গে যাবে ।

আসলে ছোট থেকে সবার মুখে নিজেকে অপয়া শুনে শুনে ও নিজেই এখন বিশ্বাস করে ও বুঝি সত্যি অপয়া । কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবার পর ওর মনে হল মামীর কথা মনে হয় ঠিক ।ওর মামি ওকে সবসময় বলতো, কোন মানুষ অপয়া হয়না ।আর মেয়েরা আল্লাহর রহমত । আর আল্লাহর রহমতকে অপয়া বললেও গুনাহ হবে । কিন্তু হায়, ওর শশুরের মৃত্যু সংবাদ শুনার পরে ও বুঝে গেলো ও সত্যি অপয়া । এতক্ষন লতা তার শাশুড়ি আর অন্য সকলের এতো কথা শুনেছে যে ওর মনে হচ্ছে এখনই কেন ওর মরন হয় না!! তিন জন মানুষ ওর জন্য মারা গেছে তার থেকে তো ওকে আল্লাহ নিয়ে গেলেই ভালো হতো ।লাশ কবর দিয়ে লতার মামা যখন লতার কাছে আসলেন লতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা ।ও এক দৌড়ে মামার পায়ের উপরে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ।

লতার মামা পাথরের মতো দাড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন । উনি বুঝতে পারলেন না কি বলে তিনি তার এই চিরদুঃখই ভাগ্নিকে শান্তনা দিবেন?? ঠিক এই সময় বিধস্ত রুবেল ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে মনে মনে বিশাল এক ধাক্কা খেল । রুবেল ঘরে আসার সাথে সাথে ওর চাচা বলল বাবা কাবিনের টাকা কবে দিবা এই কথা বলে এই বেলায় ওদের বিদায় দেও ।রুবেল কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল আমি লতাকে তালাক দিবনা । এইকথা শুনার সাথে সাথে সারা ঘরের সহ উঠানে দাঁড়ানো প্রায় জনা তিরেশেক মানুষের মাঝে গুঞ্জন শুরু হল । আতিয়া বানু ভিতরের রুম থেকে বাহির হয়ে এসে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বললেন তুই যদি এই বউ না ছাড়িস তাহলে আমাকে ছাড়তে হবে । এই অলক্ষ্মী মেয়ের সাথে আমি এক ঘরে থাকবোনা । রুবেল মাকে জড়িয়ে ধরে, ধরা গলায় বলল – মাগো তুমি এইসব কি বল!! তুমি জান আমি তোমাকে আর বাবাকে কতো ভালবাসি ।

-যদি তুই আমার সাথে থাকতে চাস তাহলে তুই এই বউ তালাক দিবি । এই মেয় তোর সাথে থাকলে তুইও বাঁচবিনা বাবা ।

-মা, তুমি বসো বলেই রুবেল তার মাকে একটি চেয়ারে বসালো । তারপরে মার পায়ের কাছে বসে বলল মাগো তোমার মনে আছে তুমি সবসময় আমাকে বলতে তুমি যখন হয়েছিলে সে সময় নানার অনেক উন্নতি হয়েছিল । নানা তোমাকে অন্য ভাইবোনের থেকে বেশি আদর করতো ।কারন উনি মানতেন তোমার কারনে উনার উন্নতি হয় । আর সেই তোমার যখন বিয়ে হল তারপর থেকে এই বাড়িতে কোন অঘটন ঘটলেই দাদি সবসময় তোমাকে দোষ দিতেন । কারন তোমার বিয়ের পরের দিনই বাবা পুকুরের ঘাটলায় পড়ে পা ভাঙ্গে । সেই থেকে দাদির ধারনা হয় এই বাড়ির জন্য তুমি লক্ষি না ।

আর ভালো কিছু হলেই বলতো ফুফুদের ভাগ্য ভালো জিনিস হয়। কিন্তু বাবা সবসময় তোমার পাশে থাকতো । মা, তুমি এতো বছর বাবার সাথে থাকার পরেও বাবার মৃত্যু তুমি মেনে নিতে পারনি ।আর লতার কথা একবার ভাব মা । এই মেয়ে আজকেই প্রথম তার শ্বশুর বাড়িতে আসলো । আসার সময় কতো সপ্ন ছিল তার চোখে । এখন দেখ মা চোখের পানির সাথে সাথে তার সব সপ্ন ঝরে যাচ্ছে । আজকে বিয়ে হয়ে আজকেই ওকে তুমি স্বামী হারা করতে চাইছ মা !! তুমি তো আমার এমন মা না, যে মা এক অসহায় বাবা-মা হারা মেয়ের দুঃখে তার পাশে থাকবে না! তুমি নানার কাছে ছিলে লক্ষি আর দাদির কাছে আসতেই হয়ে গেলে অলক্ষ্মী । তুমি বুঝ মা এই সবই আমাদের সমাজের মানুষ নিজেদের লাভ ক্ষতি ভেবে নিজেদের জন্য বানায় ।আল্লাহর বানানো কোন মানুষ কখনো অপয়া, অলক্ষ্মী হয়না । মানুষ তার নিজ কাজের মাধ্যমে উন্নতি করে ার নিজের ভুলের জন্য অবনতি হয় । আর হায়াত মউত তো আল্লাহর হাতে মা ।

আমি আজকে লতাকে তালাক দিলে আল্লাহ আমাকে মাপ করবেনা । এই মেয়েটির জীবন চিরদিনের জন্য অন্ধকার হয়ে যাবে । রুবেল আর কিছু বলার আগেই আতিয়া বানু উঠে দাঁড়িয়ে লতার মামার সামনে গিয়ে বললেন আপনারা চলে যান । লতা এই কথার সাথে সাথে তার শাশুড়ির পা ধরে সালাম দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল মা আপনি আমাকে মাফ করে দিয়েন ।মাগো আমি যদি জানতাম আমি এই বাড়িতে আসার সাথে সাথে এই রকম কিছু হবে তাহলে আমি কোনদিন বিয়ের কথা চিন্তাই করতাম না ।

আতিয়া বানু এক ধমক দিয়ে লতাকে থামিয়ে দি্যে বললেন – আহ তুমি আমাকে সালাম কেন দিচ্ছ ? চলে যাবেন তোমার মামা উনাকে সালাম দেও । এইকথা বলেই উনি বউকে বুকে জড়িয়ে বললেন তুই এখন থেকে আমার বুকে থাকবি । মায়ের আদর শাসন কিছুইতো কখনো পাসনাই ।আমি কিন্তু শুধু আদর করবনা শাসনও করবো । এই কথায় লতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । বদলকোট গ্রামের কতিপয় মানুষ এইরকম শেষ মেনে নিতে পারে নাই । যেতে যেতে তারা ফিস ফিস করতে করতে গেলো রুবেলের মা বড্ড ভুল করলো । এই অপয়া বউয়ের কারনে রুবেলের কপালে আরও দুঃখ আছে ।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত