-তাহলে কি ফাইনালি আপনারা ডিভোর্স নেবেনই? -রাহাত ও রিধিকার দিকে ভ্রু খুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো উকিল।
-জ্বী, আমরা ডিভোর্স নিব। এবং সেটাও আমাদের দুজনের পরস্পরের আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। -বেশ উঁচু স্বরে জবাব দিলো রাহাত।
-তা, বাচ্চাটার কি করবেন? ও তো এখনো পৃথিবীর ভালোমন্দ কিছুই বুজতে শেখেনি।
-দেখুন, আপনি একজন উকিল। আপনাকে টাকা দেয়া হয়েছে আমাদেরকে ডিভোর্স পাইয়ে দিতে, আমাদের পরিবার বা নিজস্ব ব্যপারে আপনার নাক না গলালেও চলবে বুজলেন! -অনেকটা রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বললো রাহাত।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা আমার অফিসে অপেক্ষা করুন আমি আসছি। উকিল এবার তার অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। রাহাত আর রিধিকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে। এর দু’মিটার দূরেই সোফায় বসে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখছে রাহাত রিধিকা দম্পতির একমাত্র সন্তান রাহুল। রাহুলের বয়স চার বছর। নিজেদের মধ্যে বুঝাপড়ার অভাব, অতিরিক্ত অবহেলা আরো নানাবিধ কারণে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয় এ দম্পতি। রাহাতের দিক থেকে প্রস্তাব ছিল বাচ্চাটাকে যেন রিধিকা তার কাছেই রাখে আর সেজন্য সে মাসে মাসে টাকা দিয়ে যাবে। কিন্তু এতে রাজি নয় রিধিকা। তার এক কথা- আমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করব। রাখতে হয় বাচ্ছা তোমার কাছে রাখো।
আধঘণ্টা পর উকিল আসলো। সবকিছু প্রস্তুত। এখন শুধু দুজনে সই করলেই হবে। ‘দেখুন, আপনারা আমাকে যাই বলুন না কেন, দয়া করে আপনারা বাচ্চাটার কথা আরেকটু ভাবুন! এই বাচ্চাটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে’ -উকিলের মুখে এমন কথা শুনে এবার রিধিকা বললো, ‘আপনি কিন্তু এবার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন’। ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনারা যা ভালো মনে করেন করুন’ -নিচু গলায় রিধিকার প্রতি উকিল। ডিভোর্সের ফরমালিটি সব শেষ। এবার দুজনে রাহুলকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ওদের নিজস্ব গাড়ি। টাকাপয়সা আর ধনদৌলতের কোন অভাব নেই। এসবকিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারী রাহুলো হতো কিন্তু এখন আর হবেনা। তাকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর পরিচয়ে এতিমখানায় রেখে আসার উদ্দেশ্যে দুজনে রওয়ানা হলো এবার। জন্মদাতা পিতা হয়েও নিজ সন্তানকে এতিমখানায় রেখে আসতে যেতে স্টিয়ারিং ধরতে হাত কাঁপলোনা রাহাতের! দশমাস দশদিন পেটে ধারণকারিণী মা রিধিকার মনেও লেশমাত্র দরদ হলোনা! শিশু রাহুল তখনো জানেনা কিছুক্ষণ পরেই তার পরিচয় হতে চলেছে একজন এতিম!
এতিমখানায় রাহুলকে রেখে দুজন চলে গেল দুদিকে। দুদিকে বলতে তারা এখন আলাদা। প্রপার্টি আর ব্যাংক ব্যালেন্সের হিসাব দুজনে আরো আগেই মিটিয়ে রেখেছে। ডিভোর্স নেয়াটা তো ছিল একরকমের ফরমালিটি মেইনটেইন করা, এই যা। ডিভোর্সের সাতদিনের মাথায় অফিসের নিজ সহকর্মীকে বিয়ে করে রিধিকা। রাহাতও পিছিয়ে নেই। সেও দশদিন পর বিয়ে করে তার এক কলেজ লাইফের বান্ধবীকে। কে জানে, হয়ত দুজনেরই আগে থেকে দু’জায়গায় পরকিয়া চলছিল যার বলি হতে হয়েছে ছোট্ট রাহুলকে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু দুজনের কেউই একটি বারের জন্যেও নিজ সন্তানের খবর নিতে এতিমখানায় আসেনি।
এদিকে, শহরের সবচেয়ে বড় নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইকরা স্কুল এন্ড কলেজের টপার স্টুডেন্ট হলো রাহুল। এতিমখানা থেকে প্রতি বছর স্থানীয় এক শিল্পপতির পক্ষ থেকে ‘এতিম শিক্ষা উন্নয়ন ট্রাস্ট’ থেকে সেরা মেধাবী দশজন এতিম শিক্ষার্থীর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। সেই সুবাদেই রাহুল ঐ ইকরা স্কুল এন্ড কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। এখানেই পড়াশোনা করে রাহাতের দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র সিফাত ও রিধিকার পুত্র রাফি। তবে, মাধ্যমিক লেবেল থেকে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা পর্যন্ত কেউই কখনো মেধাবী রাহুলের সাথে টক্কর দিতে পারেনি। তার মেধা এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে, সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে একদিন ক্লাস টিচার তাকে দশম শ্রেণীতে পাঠান ঐ স্যারের কাছে কি যেন একটা কাগজ দিয়ে আসতে। যদিও কাজের লোক ছিল কিন্তু স্যারের খুব প্রিয় ছাত্র হওয়ায় তাকেই স্যার পাঠান। যখন সে দশম শ্রেণীর ক্লাসে গেল তখন দেখলো, ঐ স্যার ছাত্রদেরকে ভূল নিয়মে অংক করাচ্ছেন। তখন সে ঐ স্যারকে অত্যন্ত আদবের সাথে বিষয়টি সম্পর্কে বলে এবং স্যার তার জ্ঞান দেখে বিস্মিত হন আর তাকে বলেন সেই যেন অংকটা করে দেয়। এবং রাহুল সেটা সফলভাবেই করে।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর রাহুলকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অত্যন্ত সুনামের সাথে ভার্সিটি লাইফ শেষ করে স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশে পারি জমায় সে। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরতেই লক্ষ টাকা সেলারির চাকরী পেয়ে যায় রাহুল! কয়েকবছরেই সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষদের একজন হয়ে যায় রাহুল। এতকিছুর পরও রাহুল তার এতিমখানার কথা ভূলে যায়নি। সে মাসে মাসে বেশ মোটা অংকের টাকা ডোনেট করতে থাকে এতিমখানায়। সে জানতো তার কোন বাবা-মা নেই। কারণ, রাহাত আর রিধিকা তাকে এতিমখানায় রেখে গিয়েছিল কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের পরিচয়ে।
শিশুকাল থেকে মা-বাবার আদর, স্নেহ আর মমতা থেকে বঞ্চিত রাহুল এবার প্রতিষ্টা করে ‘মমতা বৃদ্ধাশ্রম’। আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! সময়ের বিচারে একটা সময় পর অবাধ্য, নেশাখোর সন্তানদের আর তাদের স্ত্রীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাহাত আর রিধিকার শেষ ঠিকানা হয় সেই রাহুলের প্রতিষ্ঠিত ‘মমতা বৃদ্ধাশ্রমেই’! রাহুল জানেনা যে, তাকে জন্ম দেয়া মাতা-পিতা এখন তারই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। হয়ত সে কখনো জানবেওনা। তবে, কোন বাবা-মায়ের যেমন অধিকার নেই সন্তানকে তার পিতৃ আর মাতৃ অধিকার, স্নেহ, মায়া, মমতা আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার ঠিক তদ্রুপ বাবা-মায়ের বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানদেরও অধিকার নেই বয়স্ক মা-বাবাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখে আসার।