দরজার ওপারে

দরজার ওপারে

দক্ষিণের জানালা খুলে দেবার পর এক ঝলক মিষ্টি বাতাস এসে মুমুর আর্দ্র শরীর আরেকটু ভিজিয়ে দিলো।

মুমুর চুলের ডগা বেয়ে হীরে কুচির মত জ্বলজ্বল করতে থাকা পানির ফোঁটা একটু করে সিমেন্টের ফ্লোরে নকশা তৈরী করছে।

ফ্রোজেন নামক অ্যানিমেটেড মুভি দেখার পর মুমু প্রথম জানতে পারে,….

আকাশ থেকে পেঁজা তুলোর মত নেমে আসা বরফ কুঁচির মাঝে আসলে জালের মত অনেক অনেক নকশা থাকে।

প্যাটার্ণ গুলো এতো বেশি শৈল্পিক আর জ্যামিতিক…

মুমুর মনে আছে একটা দিন পড়েছিলো ইন্টারনেটের গোঁলকধাঁধার দুনিয়ায় এই বরফের নকশা নিয়ে। এতো সুন্দর হয় সৃষ্টি!

‘ফাবি আয়ি আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ মুমুর খুব পছন্দের আয়াত।

প্রকৃতির অদ্ভূত শৈল্পিকতা আবিষ্কারের পরে মুমু অজান্তেই আওড়ায়… আসলেই তো কোন কোন নিয়ামত কে অস্বীকার করবে মানুষ?

মুমুকে ভীষণভাবে প্রকৃতির মেয়ে বলা যেতে পারে। ভোর, বৃষ্টি, শিশির, পেট্রিচোর, সমুদ্রের নীল আর সাদা রঙ মুমুর খুব ভালো লাগে।

হীম বরফের শহর মানালি যাওয়ার সময় কি ভীষণ উত্তেজিত ছিলো মুমু! সাদাফের সাথে সেই ট্যুরেই তো পরিচয় হলো।

একটা এলোমেলো চুলের ছেলে।

মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল, ভারী চশমার আড়ালে দিশেহারা দৃষ্টি, হাতে একটা ক্যামেরা আর মোমের মত ফ্যাকাসে সাদা গায়ের রঙ।

সাদাফের একটা ককাটেইল ছিলো। হলুদ ঝুঁটি নাচিয়ে মুমুর কাঁধে এসে বসতো। টনি বলে ডাক দিলে ঘাড় ঈষৎ ঘুরিয়ে তাকাতো।

কোল্ডপ্লের প্যারাডাইসের তালে তালে টনির মাথা ঝাকানো সে এক দেখার মত দৃশ্য!

মুমুর শোবার ঘরটা বেশ গুছানো। ওয়ারড্রোবের এক কোণায় একটা মানিপ্ল্যান্ট একটু করে বাড়ছে।

তার পাশেই ছোট্ট জারে দুটো গোল্ডফিশ। আর অনেক অনেক বই। মুমু বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে।

একটা মস্ত জানালার জন্য বাবাকে অনেক বলে বলে রাজিয়ে করেছে মুমু। জানালার ভেতরের দিকটা বেশ চওড়া।

একজন মানুষ অনায়সে বসে বই পড়তে পারার মত। গরাদবিহীন জানালাটা খুলে দিলেই হুহুহু বাতাসে ঘরটা ভেসে যায়।

সাদাফ বলতো তোমার রুমে এসে একদিন সারারাত চিত হয়ে পড়ে থাকবো! ঢাকায় এমন ফ্রেশ বাতাস আর পাওয়াই যায়না!

ওই চার কোণা বাক্সোটা ফেলে দাও দেখি। শুধু শুধু ওজোনস্তর ফুটো করার দরকার টা কি?!

সাদাফ একদিন সত্যি সত্যি সারারাতের জন্য চলে এসেছিলো। মুমুর বাবা তখন ব্যবসার কাজে বাইরে।

সাদাফ মুমুর জন্য উপহার নিয়ে এলো বোতল ভর্তি জোনাকি।

আলো নিভিয়ে দিয়ে বোতলের মুখ খুলতেই এক আকাশ তারা নেমে এলো রুমে।

কি অদ্ভুত সুন্দর! অন্ধকার রুম ভর্তি তখন মাদকতা। সে রাতে মুমুর শরীর জুড়ে জোনাকি নামলো।

নাকি বরফ কুচির সেই জ্যামিতিক নকশা হলো তৈরি?

জানালা থেকে আরেক পশলা বাতাস এসে মুমুকে ছুঁয়ে দেয়। মুমুর গা থেকে ভেসে আসে বেলীফুলের ঘ্রাণ।

রাতের স্নানের পর এক আরামদায়ক আবেশে শরীর ছেয়ে থাকে। আজকের রাতটা খুব বেশি সুন্দর।

খুব বেশি রাত না হলেও বৃষ্টির দিনে শহর খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। মুমু মগ্ন হয়ে রাত দেখছিলো।

বাতাসের তোড়েই বোধহয় একটু করে মেঘ কেটে গেলে অরিয়ন্স উঁকি দিয়ে যায় আকাশে। তিনটা জ্বলজ্বলে তারা।

তার মধ্যে একটা সাদাফ, একটা টনি, আর সর্বশেষটা মুমু নিজে। সাদাফ আর টনি খুব বেশি জ্বলজ্বল করছে।

তাদের অনেকদিনের প্রতীক্ষার আগুনই বোধহয় এর কারণ।

মুমুও জানে তাদের খুব বেশি অপেক্ষা আর করতে হবে না একদমই!

জানালার একদম কাছে এসে বুক ভরে তাজা শ্বাস নেয় মুমু। কালকের সকালটা একটু অন্যরকম হবে।

প্রতিটি ব্যস্ত চ্যানেলের নীচে স্ক্রল হতে থাকবে ব্রেকিং নিউজ! জনপ্রিয় তরুনী অভিনেত্রী মুমু ইসলাম সুইসাইড করেছেন!

নিজেকে নিয়ে সব সংবাদ খুব ভালো লাগে মুমুর। খুব কম সময়ে মুমু অনেক বেশি জনপ্রিয়, অনেক বেশি হৃদয়ের কাছে ভক্তদের।

অনেক পাড় ভক্তরা ভেঙ্গে পড়বে, অনেকে করবে সমালোচনা। মুমু সবকিছুর ঊর্ধে চলে যাবার অপেক্ষা করছে।

সবকিছু পেরিয়ে, সাদাফের কাছে চলে যাবার অপেক্ষা!

কারণ মুমু জানে, জানালার ওপারে তার জন্য অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখাঁদ টান।

দরজাটা ঠিক রাত একটা বেজে পঞ্চাশে মুমু বন্ধ করে দিলো।

জানালার ওপারে আকাশ আর সোঁদামাটির গন্ধে একটু পরেই মুমু মিলিয়ে যাবে।

ঝাঁপ দেয়ার একটু আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মুমু বুঝতে পারলো না,তার ঘরের শ্যাওলা ধরা দরজাটার ওপারে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো ….

আলো, অন্ধকার, দুঃখ, মায়া, ভালোবাসা, আর জীবন।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত