তুলি

তুলি

– স্যার আপনি যেই আহত মেয়েটাকে কাল রাতে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন সেই মেয়েটা একজন পতিতা। সিস্টারের কথা গুলো শুনে কিছুটা অবাকই হলাম। তাও স্বাভাবিক ভাবে বললাম

– তো কি হয়েছে, সেও তো মানুষ।

প্রপার ট্রিটমেন্ট দাও, সুস্থ হলে ছেড়ে দিও। কাল ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরার পথে এক মেয়েকে দেখলাম আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে, মনে হলো এক্সিডেন্ট করেছে, দ্রুত হাসপাতালে এডমিট করলাম। মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে ১৯-২০ হবে। অসম্ভব রুপবতী। কেনো সে এই পেশায় আসলো, নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো গল্প আছে। কেউ নিশ্চয়ই শখ করে এই পেশায় আসে না। ভাবতেই মেয়েটার কেবিনে ঢুকলাম।

– এখন আপনি সুস্থ চায়লে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। মেয়েটি অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টা নামিয়ে নিয়ে বললো
– ঠিকাছে

এরপর অনেক দিন কেটে গেলো।। রাতে শিফট ডিউটি করে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় জ্যাম হঠাতই এক মেয়ে গাড়ির জানালায় এসে নক করলো, বললো কি স্যার লাগবে নাকি। আমি রীতিমতো অবাক হলাম সেদিনের সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে।গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বললাম

– কেমন আছো
– মেয়েটা হেসে বললো স্যার আপনি চাইলে আপনাকে ডিস্কাউন্ট দিবো।

আমি হাসলাম বললাম উঠে এসো। মেয়েটা রাজ্য জয় করা হাসি দিয়ে উঠে বসতে বসতে বললো স্যার আপনার মতো ভালো মানুষরাও আসলে এক একটা খবিশ, দিনে ভদ্র আর রাতে বলেই হাসতে লাগলো। আমি বললাম,

– তোমার নাম কি?
– নাম দিয়ে কি করবেন যার যেইটা ইচ্ছা সে সেইটায় ডাকে,এই ধরেন জরিনা সখিনা।
– আমি তোমার আসল নাম জানতে চাই
– তুলি এই নামে এখন আর কেউ ডাকে না।
– তুলি তোমার বাবা মা বেচে আছেন?
– এত প্রশ্ন না করে কই যাইবেন তাই বলেন
– কোথায় যাবোনা তোমার সম্পকে জানার আগ্রহ বোধ করছি
– নামায় দেন সময় নষ্ট করতেছেন।
– আগে প্রশ্নের উত্তর দাও নামিয়ে দিবো
– স্যার আপনি কি আইনের লোক
– না আমি একজন ডাক্তার
– তাহলে এতো জানতে চান কেন
– তোমার সাথে কথা বলে তোমার ব্যাপারে জানতে চাই।
– বললামই তো তুলি
– এই পেশায় কেনো এসেছো
– আমার মা নাই, বাবা আরেক বিয়ে করছে সেই সৎ মা ই আমাকে বিদেশ পাঠানোর নাম করে এই লাইনের এক আন্টির কাছে আমাকে বিক্রি করে দিছে

– তখন তোমার বয়স কত ছিলো?
– ১৩
– এখন?
-১৮
– বের হওয়ার চেস্টা করোনি
– করছিলাম, লাভ হয়নাই। নতুন এলাকা কিছুই চিনিনা, মরার চেস্টাও করছিলাম আপনি বাচায়ছেন।
– তুমি কি নরমাল জীবনে ফিরতে চাও।
– চাই কিন্তু সম্ভব না
– কেনো সম্ভব না।
– সত্য কখনোই চাপা থাকে না একদিন সবাই জানবে আর উপহাস করবে।

– তুমি পড়ালেখা করেছো
– না ক্লাস ৭ এ উঠেই স্কুল ছাড়ছি।
– পড়তে চাও
– আপনি কি চান, নামান তো আমারে।
– তুমি কি রোজ এখানেই থাকো
– হ্যা, কিন্তু অযথা আইসা সময় নস্ট করবেন না, মালিকরে টাকা দিতে না পারলে ঝামেলা করে।
– মালিক কে
– আমার মহাজন, উনাকে রোজ টাকা দিতে, আমার সৎ মা অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছিলো সেই টাকা শোধ ও করতে পারছিনা, ছুটতেও না।

– কত টাকা
– ২০ হাজার
– দৈনিক কত টাকা দাও?
-৫০০/১০০০ যা পারি
– এতো দিনেও শোধ হয়নি?
– জানিনা গাড়ি রাখেন।
– এই টাকাটা নাও তোমার সময় নস্ট করার জন্য আমি সরি আসলে সমাজের সবাই তোমাদের নোংরা চোখে দেখে তাই আগ্রহ বোধ করছিলাম, জানো তো নিষিদ্ধ জিনিষে আগ্রহ থাকে মানুষের। সবার পিছনেই একটা গল্প
থাকে।

– এই টাকা দিতেছেন কেন?
– তোমার মালিক কে দিও আজকের টাকা
– নামান দয়া দেখাইতে আইসেন না, এমন দয়া বহুত দেখছি, পরে ভালো মানুষি বাইর হয়।

এভাবে প্রায়ই তুলির সাথে আমার কথা হতো। মেয়েটার জীবনের অত্যাচার অতীতের সব কথাই ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, মেয়েটারো অধিকার ছিলো ভালো ভাবে বাচার।অনেক ভেবে মেয়েটার জন্য কিছু করার ইচ্ছে হলো-

– তুলি তোমার মালিককে দিও টাকাটা, বলো তুমি আজ থেকে মুক্ত। আর এসব কাজ করবে না।
– টাকাটা কি ধার হিসাবে দিলেন
– না বন্ধু হিসেবে
– হাস্যকর আমার আবার বন্ধু
– দয়া দেখায়তেছেন, বিয়া করবেন আমারে? মুক্তি দিয়া লাভ কি তায়লে কে বিয়া করবো আমারে!
– তুমি দূরে অন্য কোথায় চলে যাও যেখানে কেউ তোমাকে চিনবে না। নরমাল জীবন যাপন করবে।
– আপনার টাকা আপনি রাখেন আর কখনোই আসবেন না।

তুলির সাথে এর পর আর কখনোই দেখা হয়নি। হয়ত সে দূরে কোথাও চলে গেছে। এভাবেই সময় কাটতে লাগলো, নিজের কর্ম জীবনে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। অনেক দিন পর একটা ফোন এলো হাসপাতাল থেকে,

– স্যার একটা বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে খুন হয়েছে। পুলিশ নিয়ে এসেছে ময়না তদন্ত করতে হবে।
– ঠিকাছে আসছি।

লাশটা ছিলো তুলির লাশ। খুন না আত্মহত্যা করেছিল। মেয়েটা এজীবন ঐজীবন দুইটাই নষ্ট করলো। এক সিস্টার এসে বললো স্যার ২০৩ নাম্বার কেবিনের রুগীর জন্য আমরা কিন্তু চায়লে সেই বেওয়ারিশ লাশটার কর্নিয়া ডোনেট করতে পারি।

– মেয়েটা পতিতা ছিলো জানো?
– সমস্যা নাই স্যার কর্নিয়া দিলে রুগী আবার দেখতে পাবে।
– মনে মনে হাসলাম, হয়তো এইটাই নিয়তি।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত