ভোর থেকেই আকাশটা অন্ধকার। হয়তো শেষ রাতেই বৃষ্টি নেমেছে। টিপ টিপ এই বৃষ্টিটা আবীরের খুব অসহ্য মনে হয়। তবুও বৃষ্টি দেখছিল আবীর। একবার ঘুম ভেঙে গেলে সবার ঘুম আসেনা। আবীর জানেনা, কখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। বাইরে শুধু মেঘ জমেছে কিছুটা, বৃষ্টি বাড়েনি। টলতে টলতে রাস্তায় নেমে আসে আবীর। ওর সামনের রাস্তাটা হঠাৎ সমুদ্র হয়ে যায়। সমুদ্রে ঢেউ বাড়ে, তুমুল ঢেউ আবীরকে ভাসিয়ে নিতে চায়। তবু ও সামনে হেঁটে যায়। মোড়ের দোকান পর্যন্ত ওকে যেতেই হবে।
বৃষ্টি বাড়ছে। ঘোলাটে চোখে আকাশটা অন্যরকম লাগে। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার দিকে তাকিয়ে তুশির কথা বড্ড মনে পড়ে আবীরের। ঠাণ্ডা লাগলেও ওকে বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে। সাথে আবীর না ভিজলে খুব মেজাজ খারাপ হতো তুশির। তুশির খুব অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়। রাগলেও ওকে সুন্দর লাগতো। আবীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিত তুশিকে। তুশি প্রাণপণ চেষ্টা করতো না রাগার, শেষ পর্যন্ত পারতো না। কিন্তু, সেসব যেন আরেক জন্মের কথা। যেন এই জন্মে তুশি নামে কেউ ছিল না কখনো। আবীর আজকাল প্রায়ই তুশির মুখ মনে করতে পারেনা। এক আকাশ মেঘের নিচে দাঁড়িয়ে আজ হঠাৎ তুশিকে দেখতে খুব ইচ্ছে হয় আবীরের।
শাখীর খুব ক্লান্ত লাগছে হঠাৎ। তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দেয়ার পর ভর দুপুরের এই টিপ টিপ বৃষ্টিটা আরো মেজাজ খারাপ করছে ওর। কলেজ থেকে রিকশা পেতেও আজ এত দেরী হল! মোড়ের দোকানটা পার হয়ে গলিতে ঢুকতেই শাখী দেখলো আবীর মাতালের মতো টলতে টলতে আসছে। হঠাৎ বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো শাখীর। আবীর যেন দুই হাত তুলে ওকে ডাকছে। কোন কিছু বোঝার আগেই আবীর রাস্তায় আছড়ে পড়ে। শাখী দৌড়ে আবীরের কাছে গিয়ে দেখে জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছে আবীর। শাখীর খুব কান্না পাচ্ছে। ও অল্পতেই কেঁদে ফেলে। কেন যে কাঁদছে, ও নিজেও জানেনা। আবীরকে অনেক কষ্ট করে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করায় শাখী। ওর হাত ধরে টেনে বাসার দিকে নিতে নিতে শাখী বুঝতে পারে এইজন্যেই এই কয়দিন আবীরকে দেখেনি ও। নিশ্চয়ই জ্বর নিয়ে বাসায় বসে ছিল। আঙ্কেল আন্টিও খাগড়াছড়িতে। ওর যে জ্বর এসেছে, ও একবারও বলতে পারেনি? পাশের ফ্ল্যাটের একটা বেল টিপতেই এত কষ্ট ওর? আবীরের উপর খুব রাগ হয় শাখীর। রাগলে শাখীর খুব কান্না পায়।
আবীরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পুরো ঘরটা দেখে শাখী। উফফ! ছেলেগুলো এত অগোছালো হয়! থাক। ঘর পরে গোছানো যাবে। রান্না ঘরে দেখে এসেছে, নুডুলস আছে এক প্যাকেট। নিশ্চয়ই খাবার কিনতে দোকানে যাচ্ছিল! না খেয়ে আছে, তবু কাউকে ডাকবে না। এই ছেলেগুলোকে মাঝে মাঝে থাপ্পর দিতে ইচ্ছে হয় শাখীর। নুডুলস চুলায় দিয়ে বালতিতে পানি নিয়ে আসে ও। মাথায় এখনি পানি না দিলে মনে হয় ওর মাথাতেই নুডুলস রান্না করে ফেলা যাবে। জানালা দিয়ে খানিকটা আলো এসে আবীরের মুখে পড়ছে। আধো অন্ধকারে ওর মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে শাখীর। কি যেন বলছে আবীর। শাখী ওর মুখের কাছে কান নিয়ে যায়। কেমন মিষ্টি একটা গন্ধ আবীরের গায়ে। শাখীর খুব ভালো লাগে। আবীরের আরও কাছে আসে শাখী। ও শুনতে পায়,
“তুশি… শোন… তুশি…”
শাখীর বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। ও কাঁদবে না। আজ কিছুতেই কাঁদবে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ও। রাজকন্যার মতো বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ জুড়ে। আজ বৃষ্টিতে ভিজবে ও। বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি দেখা যায় না। অন্ধকার ঘরে রাজকন্যার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।