ছটকু নাকি সামসুল চাচাকে গত রাতে খাট থেকে তুলে আছাড় দিয়েছে। যে ছটকু মারা গেছে আজ চারদিন হলো। গতকাল আমার সাথে দেখা হবার পর সামসুল চাচা আমাকে ডেকে বললেন, “এই শ্রাবণ, তোর ভাই তো আমাকে মেরেই ফেলবে। বাজার থেকে গত রাতে ফেরার পথে তোর ভাই দা নিয়ে আমাকে দৌড়ানি দিল। এটাই কি উপকারের প্রতিদানরে বাবা?”
আমার চাচাতো ভাই ছোটন। তিন ভাই বোনের মধ্যে ছোটন সবার ছোট। তাকে আমরা ছটকু বলেই ডাকতাম। পাঁচ বছর বয়স হলেও ছটকুর ওজন পনেরো কেজির বেশি হবে না। হাড় কঙ্গাল সারা শরীর। বুকের হাড়গুলো এক এক করে গুনতে পারা যায়। যে কেউ দেখলে বলবে তার বাবা মা নিশ্চয় তাকে খেতে দেয় না। তাকে খেতে দেয়া হতো না এটা ঠিক না, ঘরে যা থাকত সে নিজ হাতে নিয়েই সব খেয়ে ফেলত। সকাল থেকে রাত অবধি সে খাওয়ার উপরই থাকত। কত ডাক্তার দেখানো হলো। সদর হাসপাতাল ছেড়ে ভেলানগরের এ্যাপোলো প্রাইভেট হাসপাতালে এক সপ্তাহ রেখে চিকিৎসাও করানো হলো। ডাক্তার বললেন ছোটন সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। হরমোন জনিত কারণে তার পাকস্থলী হজম পক্রিয়া অনেক দ্রুত করে সাধারণ মানুষের তুলনায়। ছোটনকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। এলাকার মোটামোটি সবাই চিনে ছোটনকে। তাকে প্রাইমারী স্কুলের ছোট ওয়ানে ভর্তি করানো হলো। স্কুলের বারান্দায় চলে ছোট ওয়ানের ক্লাস। ক্ষিধা লাগার কারণে ছোটন বাড়ি চলে আসতে চেয়েছিল। মাস্টার মশাই তাকে আসতে দেয়নি। ছটকু আদর্শ লিপীর বই ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করল।
পরদিন থেকে ছোটন আর স্কুলে যায় না। আমি মাঝে মধ্যে উঠানে বসিয়ে একটু পড়াই। সত্য বলতে মাঝে মধ্যে ছোটনের দিকে তাকালে আমারই ভয় করে। এক দেড় বছরের ছোট বাচ্চার একটি হাফপ্যান্ট পরনে পাঁচ বছর বয়সী ছোটনের। খালি গায়ে বসে আছে আমার সামনে। হাড়গুলোর সাথে চামড়া লেগে আছে। মনে হবে তার চোখ দুটো সারা শরীরের তুলনায় বড়।
আমি যদিও যুবক, তবে অবিবাহিত। গভীর বিষয়ে আমার কথা বার্তা না বলাই উত্তম। তবুও মাসুদ ভাইকে কিছুদিন আগে একটি কথা বলতে শুনেছি। তিনি দুষ্টুমির স্বরে হলেও রাগান্বিত স্বরে বলছেন, “যেসব ব্যাটারা মাসের ত্রিশদিনই বউকে জ্বালায়, একটা দিনও ছাড় দেয় না। তাদের সন্তানই প্রতিবন্দী, বিকলাঙ্গ আর অস্বাভাবিক হয়ে জন্মায়। আরে মাসে পাঁচ সাতটা দিন বেছে চলতে না পারলে কিসের পুরুষ মানুষ?”
আমি ঐ বিষয়ে আর ভাবতে না চাইলেও মনের অজান্তে একটি কথা ভাবনায় চলে আসত। ছোটনও হয়তো সুস্থভাবে জন্ম নিতে পারত। আমি ডাক্তার নই, স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক হয়ে জন্ম নেবার মূলমন্ত্র জানি না। তবুও মনে হয় সুস্থ থাকার জন্য সুস্থ সন্তান জন্মদানের জন্য মানুষেরও অনেক করণীয় রয়েছে।
ছোটন আমাকে ডাকত শ্রাবু’দা বলে। প্রায়ই বায়না ধরত, বিস্কুট খাব, চিপস খাব। সবসময় পকেটে টাকা থাকত না। যখন থাকত তখন কিনে দিতাম। ছোট ছোট দাঁতে কুড়মুড় করে খেত আর বলত, শ্রাবু’দা অনেক মজা। আমার চাচী প্রায় সময় রাগ হয়ে যেতেন। একটি বাচ্চা দিনরাত শুধু খাওয়া খাওয়া করে, এটা তিনি মানতেই পারেন না। অথচ আবার নিজেই ডেকে মুখে তুলে খাওয়ায়। শত হলেও মায়ের মন তো। তবুও মাঝে মধ্যে কঠোর হতেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মে সারাদিন খেতে চাইলেই খাওয়াটা আসবে কোথা থেকে। প্রতিবেশী গফুর দাদা আমার চাচীকে বলতেন, মা’রে যতটুকু পারিস খাইয়ে দে। ওর রিজিক যতটুকু আছে ততটুকু খাওয়া হলেই সে বিদায় নিবে। চাচী রাগের স্বরে বলত, বিদায় নিলেও তো শান্তি পেতাম।
পাঁচদিন আগে ছোটন সত্যি সত্যি বিদায় নিল। সন্ধ্যারাতে খাবার শেষেই ছোটন মারা গেল। শীতের রাতে গ্রামের সন্ধ্যা রাতই অনেক রাত। মানুষ কাঁথা, লেপ মুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাত এগারোটায় মহল্লার ছোট ছাপড়া মসজিদের ইমামকে ডাকতে গেলেন চাচা। গিয়ে দেখে ইমাম সাহেব জ্বরে কাত হয়ে শুয়ে আছেন। ইমাম সাহেবের সেবার জন্যই আরেকজন লোক দরকার। চাচা ফিরে এলেন, ছোটনের লাশ গোসল দিতে হবে। কবর দিতে হবে।
সামসুল চাচা আর উত্তর পাড়ার রহিম বাবুর্চী এই এলাকার কবর খুঁড়ে দেন। বিনিময়ে টাকা পয়সা কিছুই নেন না। সামসুল চাচাকে বলা মাত্রই এই শীতের রাতে কবর খুঁড়লেন। ছোট্ট একটি কবর। কিন্তু এখন জানাজা দিবে কে? শেষ অবদি সামসুল চাচাই বললেন আমিই জানাজার নামাজ পড়াব। জানাজার নামাজে আমরা মানুষ মাত্র নয়জন। শীতের রাতে এলাকার দুই চার ঘরের মানুষ একবার চোখের দেখা দেখে গেল। কয়েকজন বলল, আগেই ভেবে রেখেছি ছোটন বেশিদিন বাঁচবে না।
সামসুল চাচা সেদিন চার তাকবির দিয়ে জানাজার নামাজ শেষ করলেন। রাতেই ছোটনের লাশ কবর দিয়ে এলাম। সমস্যা হলো এর পরেরদিন রাত থেকে। ছোটন নাকি প্রতি রাতেই সামসুল চাচা’কে মারতে চায়। এমন আশ্চর্য কথা শুনে কেউ সেই কথার গুরুত্ব দেইনি। সামসুল চাচা ভয় পাবার মানুষ নন। তিনি কত নিশী রাতে কবর খুঁড়েন। কত লাশ তিনি কবরে নামিয়েছেন। আর ছোটন নাকি সামসুল চাচাকে খাট থেকে তুলে আছাড় মেরেছেন।
রাত দুইটায় ওয়াজের পোগ্রামের মাইক খুলে দোকানে রেখে বাড়ি ফিরছিলাম। সামসুল চাচার বাড়ির পাশ দিয়েই আসতে হয় আমাদের বাড়ি। নারকেল গাছের আড়ালে ছোট একটি ছায়া দেখে আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম। ছায়াটা আমাকে দেখে গাছের আড়ালে চলে গেল। ছায়া কারো পরিচিত হয়? আমার পরিচিত লাগছে। ছোটনের হাড় কঙ্গাল শরীরের ছায়ার মত। ভাবছি দৌঁড় দেব। আর একটু এগিয়ে যেতেই চাপা স্বরে ছোটনের কন্ঠে কেউ বলছে, “শ্রাবু’দা জানাজা দে। শ্রাবু’দা জানাজা দে।”
আমি দৌঁড়ে কোনোমতে পালিয়ে এলাম। যতরাতেই বাড়ি আসি, পাশের ঘরে মা’কে সবসময় ডেকে বলি মা আমি এসেছি। আজ ডেকে বলছি মা একটু বাইরে আসবে? শীতের রাতে মা’কে কষ্ট দেয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি। মা’কে ঘটনাটুকু বলার পর মা বটি নিয়ে এলেন। হারিকেনের ছোট চিমড়ি উঁচু করে মা বটির আগায় লবন নিয়ে গরম করলেন। আমাকে এনে দিয়ে বললেন, তিনবারে খেয়ে নে। আর সকালে গোসল না করে ভাত খাবি না।
ছাপড়া মসজিদের ইমাম সাহেবকে ঘটনা বলার সময় সামসুল চাচা আমার সাথে ছিলেন। সামসুল চাচা এবার কাতর স্বরে বললেন, ইমাম সাহেব আমারে বাঁচান। আমারে রোজ রাতে ছোটন মারতে আসে। ইমাম সাহেব বললেন, তাহলে নিশ্চয় জানাজার নামাজ ভুল হয়েছে। সত্যি করে বলেন তো সামসুল ভাই, জানাজার নামাজ ঠিকভাবে পড়ছেন? সামসুল চাচা আমতা আমতা করে বললেন, আসলে আমি চার তাকবির দিয়ে নামাজ পড়েছি। প্রথম তাকবিরে যে ‘সানা’ পড়তে হয় আমার ‘সানা’ পুরোটা মুখস্ত নেই। দ্বিতীয় তাকবিরে দুরুদ শরীফ ঠিকই পড়েছি। ইমাম সাহেব আপনি আমারে বাঁচান।
এক চাঁদনি প্রসর রাতে আমরা কবর খুঁড়ে ছোটনের লাশ তুললাম। ইমাম সাহেব আবারো সেই লাশের জানাজার নামাজ পড়লেন। এবারের নামাজে আমরা ছয়জন ছিলাম। এক সপ্তাহেও ছোটনের লাশ একটুও পঁচেনি। মনে হচ্ছে যেন ঘুমিয়ে আছে। যেন এই জানাজার নামাজটুকুর জন্য অধির আগ্রহে ছিল ছোটন।