একদিন ভালবেসেছিলাম….

একদিন ভালবেসেছিলাম….

এক.

আমি প্রেমিক, বখাটে নই…

তোমার চোখে আমি ভালবাসা খুঁজেছি ।
কিন্তু কি দেখেছি জানো ?
করুণা-ধিক্কার-ঘৃণা সবই ছিল সেখানে ।
শুধু ভালবাসাটার লেশ ছিল না ।

সেদিন আমি খুব বিষণ্ন ছিলাম ।
আমার বিষণ্নতা কাটাতেই বোধহয়
ঈশ্বর নিজে তোমাকে পাঠিয়েছিলেন ।
গলির মুখে দাঁড়িয়ে তুমি রিকসা দেখছিলে ।
নীল কামিজে সেদিন অদ্ভুত সৌন্দর্য ধরা দিয়েছিল ।

বিশ্বাস করো তুমি…..
প্রেমে আমার কোনদিনও বিশ্বাস ছিল না ।
কিন্তু তোমাকে দেখার পর সেদিন যে কি হল !?
এ ঠিক প্রেম নয়, অন্যরকম অনুভূতি ।
খোঁজ নিয়ে জানলাম এলাকায় নতুন এসেছ ।

তারপর থেকে গলির মোড়টায়
আমাকে প্রায়ই দেখা যেত ।
জ্বলন্ত বেনসন আর চায়ের কাপের ধোঁয়া
মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত ।
এ রাস্তাটা দিয়ে তুমি রোজ কলেজ থেকে ফিরতে ।

কোনদিন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাই নি ।
শুধু তাকিয়েই থাকতাম ।
একদিন তুমি নিজেই এগিয়ে এলে ।
হয়ত দেখতে চেয়েছিলে- কে সে বীরপুরুষ
যে প্রতিদিন তোমার ফেরার পথ চেয়ে থাকে ।

আমাকে বুঝতে কোন চেষ্টাই করনি তুমি ।
কখনো প্রেমিক ভাবো নি,
ভেবেছিলে বখাটেদেরই একজন ।
শব্দের সহস্র বুলেটে ছিন্ন করেছ আমায় ।
কোন কথা বলিনি আমি, দেইনি কোন জবাব ।
শুধু তাকিয়ে ছিলাম তোমার চোখে চোখ রেখে…
সে চোখে ভালবাসার লেশ ছিল না ।
ছিল করুণা, ছিল অবজ্ঞার পরিহাস আর ঘৃণা ।

আমি চাইলেই পারতাম- তোমার ভুল ভেঙ্গে দিতে ।
কিন্তু কিছুই করিনি আমি ।
আমি তো প্রেমিক, উকিল নই ।
কেন যাব নিজেকে প্রমাণ করতে ?
পাওয়ার আশা নিয়েতো তোমাকে ভালবাসিনি ।
ভালবাসার জন্যই শুধু ভালবেসেছি ।
তোমাকে ভালবাসতে পেরেই আমি সুখী ।
আমি তৃপ্ত ।
কারণ আমি প্রেমিক, বখাটে নই ।

দুই.

পত্রিকাটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল রূপা ।

এবারের বইমেলায় বেস্ট সেলারের তকমা গায়ে লাগিয়েছে কবি আহমদ নীলের “আমি প্রেমিক, বখাটে নয়” কাব্যগ্রন্থটি । বই মেলার ইতিহাসে এই প্রথম কোন কবিতার বই এই খেতাব অর্জন করল । রগরগে থ্রিলার আর রোমান্টিক উপন্যাসের এই যুগে যেখানে মানুষ কবিতা পড়াও ভুলতে বসেছে সেখানে কোন এক অখ্যাত কবির কোন কবিতার বই বেস্ট সেলার খেতাব অর্জন অবিশ্বাস্য নয়, রীতিমত অসম্ভবই বটে । আর সেই অসম্ভব কাজটিই ঘটে গেছে এইবারের বইমেলায় !

আজকের সাহিত্য সাময়িকীতে কবির সাক্ষাতকার বেরিয়েছে । সেই সাথে নাম ভূমিকার কবিতাটিও তুলে ধরা হয়েছে । সেটাই পড়ছিল রূপা । স্বামী অফিসে, বাচ্চা স্কুলে- মধ্যাহ্নের এই সময়টাতে নিজকে ভীষণ একা লাগে তার । তাই এই সময়টাতে বসে বসে সে পত্রিকা পড়ে ।

কবিতা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেছে তার । বুক চিরে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ।
তবে দীর্ঘশ্বাসের কারণ এই লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি ।

পত্রিকা ছেড়ে রুমে গিয়ে সিডি প্লেয়ারটা ছেড়ে দিল সে । তারপর রিভলিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে দুলতে থাকল । বোঝাই যাচ্ছে কোন এক অজানা কারণে তার মনটা ভীষণ খারাপ ।

রুমে তখন হালকা স্বরে বাজতে শুরু করেছে-

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে আয়….
ও সে চোখের দেখা, প্রাণের দেখা-
সেকি ভোলা যায়…….?

তিন.

সময়টা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে নীলের । গ্র্যাজুয়েশান শেষ হয়েছে আজ চার বছর, চাকরির দেখা নেই । বাবা রিটায়ারর্ড প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন, অসুস্থ মা- নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাব অনটনের সেই চিরায়ত কাহিনী । টিউশনি করে আর কতদিন চলা যায় ?

ভার্সিটিতে থাকতে টুকটাক লেখালেখি করত । অনেকেই বলেছিল যদি চালিয়ে যেতে পারে তবে অনেক নাম কামাতে পারবে । কিন্তু বাস্তবতার নির্মমতায় শব্দেরা আজ তার থেকে সহস্র মাইল দূরে । তার বন্ধুরা এখন সবাই চাকরি নিয়ে ব্যস্ত । কেউ কেউ তো বিয়েও করে ফেলেছে । কিন্তু সে এখনো বেকারই রয়ে গেছে ।
এখন তার প্রায়ই আফসোস হয় ফেলে আসা সেই দিনগুলির জন্য । অর্থহীন কোন আবেগী কবিতার একটি লাইন মেলানোর জন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উদাসী ভঙ্গিতে বসে থাকা- কি দরকার ছিল সেসবের ? কবিতা বড়লোকের বিলাসীতা- এই সহজ সত্যটা বুঝতে কেন এত দেরি করে দিল সে ? যদি সে সময়টাকে কাজে লাগাত, মন দিয়ে লেখাপড়াটা করত তাহলে আজ হয়ত এই দিন দেখতে হত না ।

বাসায় যতক্ষণ থাকে, চুপচাপ থাকে । ভয়ে ভয়ে থাকে কখন যে আবার বাবা জিজ্ঞাসা করে বসেন- কি রে ? কিছু হল ?
বাইরে যে খুব ভাল সময় কাটে তা ও না । ওর ব্যাচের কেউ তো নেই । আর জুনিয়রদের চোখেও কেমন যেন একটা অবজ্ঞার ছায়া লেগেই থাকে । কিন্তু তারপরও বাবার অসহায় দৃষ্টি থেকে তার কাছে সেটাই ভাল মনে হয় । তাই দিনের বেশীর ভাগ সময় বাইরেই কাটে ।

এমনই এক দিনে সে মোড়ের দোকানটাতে বসে ছিল । সেদিনই প্রথম রূপাকে দেখে সে । এবং দেখতেই থাকে । এ যেন কোন মত্যের মানুষ নয় । হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে উঠে আসা কোন রূপকথার রাজকন্যা !

নীলের মুগ্ধ দৃষ্টি খেয়াল করেই হয়ত একজন পাশ থেকে জানিয়ে দিল- মেয়েটির নাম রূপা, এলাকায় নতুন এসেছে । পুরো এলাকা তার পিছনে লেগেছে ।
অবশ্য এ জানিয়ে দেয়ার মাঝে সাহায্যের কোন আভাস ছিল না । ছিল মৌনঃ সতর্কবার্তা- ছেলে, দূর থেকে তাকিয়েই তুষ্ট থাকো । তোমার মত চালচুলো হীনের পক্ষে এরচেয়ে কাছে যাওয়া সম্ভব না !
নীল সবই বুঝতে পারে । কিন্তু কিছু বলে না । শুধুই হাসে ।

সেদিনের পর থেকেই রূপা দেখত উষ্কোখুষ্কো চুলের এক ছেলে প্রায়ই মোড়ের এক দোকানে বসে তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে । কিছুদিন যাওয়ার পর দেখল ছেলেটা আসলে প্রায় নয়, প্রতিদিনই আসে । বাসা থেকে বেরুতে, বাসায় ফিরতে । একই স্থান, একই ভঙ্গিমা !

রূপা ছেলেটির চোখে তাকিয়ে দেখেছে- অন্য পুরুষদের মত সেখানে কোন লালসা নেই, আছে স্নিগ্ধতা । এই বিষয়টাই তাকে ভাবায় বেশী । কোন নড়ছড় নেই, শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ! কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে সে ।

একদিন বান্ধবীদের সাথে কি একটা তুচ্ছ কারণে ঝগড়া বাঁধিয়ে এসেছিল । রিক্সা থেকে নামতেই দেখে প্রতিদিনের সেই একই জায়গায় নীল বসা, চোখে তার অদ্ভুত ভাবালুতা । হঠাত্ করেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার । সোজা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ঝাড়তে শুরু করে । নীল প্রথমে খানিকটা হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর নিজেকে ঠিকই সামলে নেয় । কিন্তু কিছু বলে না । শুধুই হাসে ।
নীলের হাসি দেখে রূপার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায় । বলেই বসে- বখাটেগিরি দেখানোর আর জায়গা পান না, না ? কাল থেকে যেন আপনাকে আর এখানে না দেখা যায় ।
বলেই রূপা গড়গড় করে সেখান থেকে চলে যায় ।

সেদিন রূপা আগে থেকেই যথেষ্ট রেগে ছিল । কারো উপর তার ঝাল মেটানোর দরকার ছিল । তারই শিকার হল বেচারা নীল ।
আচ্ছা, সে কি আসার সময় নীলের চোখে চোখ রেখেছিল ? রাখেনি বোধহয় ।
রাখলে দেখত, সেখানে আগের সেই ভাবালুতা আর নেই । অদ্ভুত এক বিষণ্নতা এসে ভর করেছে ।

বিনাদোষে নীলকে এভাবে অপমান করে রূপা নিজেও খানিকটা অনুতপ্ত হয়েছিল । স্যরি বলার জন্য পরে তাকে অনেক খুঁজেছিলও । কিন্তু আত্মাভিমানী নীলকে আর কখনো সে স্থানটিতে দেখা যায় নি । রূপারও আর তাকে স্যরি বলা হয়ে উঠে নি ।

সেদিন রূপার ঝাড়ি শুনে আসার পর নীলের মন যথেষ্ট খারাপ ছিল । বাসায় এসে চুপ করে শুয়েছিল । ভেবেছিল আর বাসা থেকে বের ই হবে না । কিন্তু সন্ধ্যার দিকে কলেজ জীবনের বন্ধু পাভেলের জরুরি ফোন পেয়ে বাসা থেকে বের হয় । পাভেল যা বলে তার সারমর্ম হচ্ছে- নীলের ছোট বোন নিঝুমকে সে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে । কিন্তু নীলের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে তার ভাল লাগা কখনো প্রকাশ করে নি । কিছুদিন পর সে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে । যাওয়ার আগে নিঝুমকে বউ করে ঘরে তুলতে চায় ।
নীল আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায় নি । খুশী মনেই বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ।

দ্রুতই নিঝুম আর পাভেলের বিয়েটা হয়ে যায় । বোনের বিয়েতে নীল কোন কমতি রাখতে চায়নি । বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার বড় একটা অংশ এখানে খরচ হয়ে যায় ।

নিঝুমের বিয়ে সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটা ধাক্কা আসে তার উপর । বাবার হার্টে মেজর ব্লক ধরা পড়ে । অপারেশান করাতে হবে । হাতে ক্যাশ যা ছিল সবই শেষ হয়ে যায় অপারেশানের পিছনে । কিন্তু তেমন একটা লাভ হয়নি । মাষ্টার সাহেব সারাজীবন শুধু পরিশ্রমই করে গেছেন । কখনো শরীরের যত্ন নেন নি ।
তাই শেষ বয়সে অপারেশানের ধাক্কা শরীর আর সামলে উঠতে পারে নি ।

মা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন । বাবার মৃত্যুর পর সেটা আরো বেড়ে যায় । মায়ের চিকিত্সার জন্য বাড়িটাও বিক্রয় করে দিতে হয় । কিন্তু ফলাফল এবারও শূন্য ।

সব হারানোর মাধ্যমে সর্বহারাদের দলে প্রবেশ করে নীল । জীবনই তাকে জীবন নিয়ে এক্সেপেরিমেন্ট করার সুযোগ করে দেয় । কোন সহায়-সম্বল নেই, কোন চাওয়া-পাওয়ার বেদনা, কোন অতৃপ্তি-হাহাকার নেই, নেই ঘরে ফেরার পিছুটান ।
ছন্নছাড়া জীবন পায় অফুরন্ত স্বাধীনতা । জীবন নিয়ে এক্সেপেরিমেন্টের জন্য এরচেয়ে বেটার চান্স আর কি হতে পারে ?
আবার কলম ধরে নীল ।

চার.

বাসার সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা ছোট্ট একটি লন । একপাশে বেতের চেয়ার টেবিলে বসার ব্যবস্থা আছে । লনে বসে আছি । সঙ্গে আছে এক বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক আর তার ক্যামেরাম্যান । তারা আমার একটি সাক্ষাতকার নিতে এসেছে ।
একটু আগে পরিচায়িকা এসে কফি দিয়ে গেছে । ধোঁয়া উঠা গরম কপে চুমুক দিচ্ছি আর মাঝে মাঝে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছি । কত বয়স হবে আর ? ২৩-২৪ ? এই বয়সেই সাংবাদিক হিসেবে যথেষ্ট নাম কামিয়েছে ।

কফি শেষ হতেই মেয়েটি বলে উঠল- তো স্যার, শুরু করা যাক ।
আমি মুচকি হেসে সম্মতি দিলাম ।

আমি সচারাচর কারো সাথে দেখা সাক্ষাত করি না । টিভিতে সাক্ষাতকার দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না । শহর থেকে খানিকটা দূরে মাঝারি ধরনের একটা ডুপ্লেক্স বাড়িতে একা একা থাকি । রান্না-বান্না করার জন্য একজন পরিচায়িকা আর বাজার-টাজার করার জন্য একটা ছেলে আছে । এদের নিয়েই আমার পরিবার, এদের নিয়েই আমার বসবাস । বছর দুয়েক পরপর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসে । সেই সময়টা ছাড়া অন্য যে কোন সময় বাড়িটাকে মৃত্যুপুরী বললে খানিকটাও বাড়িয়ে বলা হবে না ।
কারণ, সবসময়ই এখানে শশ্মান ঘাটের নিস্তব্দতা বিরাজ করে । কোলাহল আমি একদমই সহ্য করতে পারি না । তাই সবকিছু ছেড়ে নির্জনে একাকী বসবাস ।

আমি আহমদ নীল, দেশের অন্যতম প্রধান কবি । জনপ্রিয়তায় আমার ধারে কাছেও কেউ নেই । প্রতি বইমেলাতেই আমার চার-পাঁচটা করে বই বের হয় আর পাঠক তা বুভুক্ষের মত পড়ে । আমার বই বাজারে আসার আগেই নাই হয়ে যায় । ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন ধরে মানুষ আমার বই কেনে । এজন্য আমার পেছনেও প্রকাশকদের একটি লম্বা লাইন সবসময়ই থাকে ।

হাইস্কুলের শিক্ষাক্রমে আমার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । বেশ কয়েকটি ক্লাসে আমার কবিতাও পড়ানো হয় । বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, রাষ্ট্রপতির বিশেষ সম্মাননা সহ অনেক পদক যুক্ত হয়েছে প্রাপ্তির খাতায় ।
কিছুদিন আগে BBC কর্তৃক আমাকে “দ্য লিভিং লিজেন্ড” ঘোষণা করা হয়েছে ।
সব দেখি আমি । কিছু বলি না । শুধু দেখি আর হাসি ।

কবিতা আমাকে সব দিয়েছে । অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি, ভালবাসা সব । আজ আমার এতকিছু, অথচ একসময় আমার কিছুই ছিল না । হুট করেই আমি বিখ্যাত হয়ে যাই নি । আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে কন্টকময় দীর্ঘপথ ।

যখন কলম ধরেছিলাম তখন আমার কিছুই ছিল না, কেউই ছিল না । দিনের পর দিন লিখে গেছি । দিস্তার পর দিস্তা ভরিয়েছি । কিন্তু কেউ পড়ে দেখেনি ।
তবে নিরাশ হইনি, সাহস হারাই নি । কোন পিছুটান ছিল না, হারানোর মত কিছু ছিল না, নিজের জন্যে বাঁচা, নিজের জন্যে লেখা ।

আমি লিখে গেছি । অনবরত লিখে গেছি জীবনের কথা, ভালবাসার কথা, সব হারানোর কথা । আমি লিখেছি মধ্যবিত্তের জীবনগাঁথা, বেকার যুবকের হাহাকারের কথা, ব্যর্থ প্রেমিকের মনোযাতনা ।
আমি জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখের কথা লিখেছি যা মানুষ আমার কাছে শুনতে চাইত ।
নিজের সত্য কাহিনী অবলম্বনে লেখা “আমি প্রেমিক, বখাটে নই” বাজারে আসার পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি । হয়ত লাখো যুবকের সাথে মিলে গিয়েছিল বলেই বইটি এতটা পাঠক প্রিয়তা পেয়েছিল ।
ধীরে ধীরে আমার লেখার কাটতি বাড়তে থাকে আর আমিও লিখতে থাকি ।
আমার লেখায় ফুটে উঠে মধ্যবিত্তের প্রেম এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা, বন্ধুত্ব এবং ভালবাসা, তারুণ্যের জয়গান, ধনী গরিবের বৈষম্য । শাসক শ্রেণীর দূর্নীতি আর শোষণের বিরুদ্ধে আমি কলম ধরি, কলম ধরি আমলা নিয়ন্ত্রিন জরাগ্রস্ত প্রশাসনের বিরুদ্ধে । ধীরে ধীরে আমি হয়ে উঠি জনমানুষের কবি ।

খ্যাতির মোহ যে আমার ছিল না, তা কিন্তু না । কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে বেশী খ্যাতি পেয়ে গেলে তা বিড়ম্বনার রূপ ধারণ করে । আমার ক্ষেত্রেও তা হয় । বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে ধীরে ধীরে নিজেকে গুঁটিয়ে নিই, লোকালয় থেকে দূরে, নির্জনে….

আমি সাধারণত কাউকেই সাক্ষাতকার দিই না । কিন্তু মেয়েটাকে দিতেই হল । সপ্তাহখানেক আগে সে যখন টেলিফোনে সময় চাইল, ওর স্বরটা আমাকে থমকে দিয়েছিল । ২৭ বছর আগে শোনা সেই একই স্বর ! না, আমার শুনতে ভুল হয়নি । একই টিউন, একই উচ্চারণ । মেয়েটাকে না করতে পারিনি । তাই আজকে সে এসেছে । ওকে দেখার পর সন্দেহটা সত্যে পরিণত হয় । এই তো সেই মেয়ে, এক সময় যাকে দেখতে গলির মোড়টায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম !

ইন্টারভ্যুর পর্বটা ছিল খুব সাদামাটা । লেখালেখি নিয়ে যেসব প্রশ্ন ছিল তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি । ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলো আমার সেই চিরচারিত ভঙ্গিতে হেসে এড়িয়ে গেছি । মেয়েটা আরো খানিকটা টুইস্ট চেয়েছিল আমার কাছে । কিন্তু তাকে নিরাশই হতে হল ।

কাজ শেষে মেয়েটা চলে যাওয়ার আগ মূহুর্তে তাকে জিজ্ঞাসা করি- তোমার মা কেমন আছে ?
সে খানিকটা অবাক হলে বলে- আপনি আমার মা কে চেনেন ?
এ প্রশ্নের কোন জবাব আমি দেই নি । শুধুই হেসেছি ।
তারপর উঠে চলে এসেছি ।

শেষ.

গভীর রাত । আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ । বাতাস প্রবাহের শিনশিন শব্দ ছাড়া চারদিকে আর কোন শব্দ নেই । আমি ছাদে একা ।

আজ সাক্ষাতকার পর্বে একটা প্রশ্ন ছিল- আমি বিয়ে করি নি কেন ?
জবাবে বলেছিলাম- কাউকে পছন্দ হয়নি, তাই ।
কিন্তু আসলেই কি তাই ?
লোকের কাছে হয়ত মিথ্যা বলা যায় । কিন্তু নিজের কাছে…..??

কেন বিয়ে করিনি আমি ?
কারণ, একজনকে চেয়েছিলাম, তাকে পাইনি । তাই….

বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ।
একদিন ভালবেসেছিলাম আমি….
একদিন ভালবেসেছিলাম……

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত