প্রবাস থেকে চার বছর পর দেশে ফিরলাম । আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক আপ করার জন্য আমার বোন, বোনের জামাই আর আমার ছোট ভাই এসেছে । আগে থেকেই একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে রেখেছে । কিছুক্ষণ পরে মাইক্রোবাসটা ছেড়ে দেয় ।
কিছুদূর যাওয়ার পরে বাস থেমে যায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে । বাংলাদেশে এই একটা সমস্যা কোনদিনও শেষ হওয়ার না । কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমার নজর পড়লো রাস্তার পাশে । একটা মেয়ে দেখছি নিজে নিজে কথা বলছে । কিন্তু মেয়েটা কে কেমন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে । আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে মেয়েটা এমন করছে কেন । ড্রাইভার বলে ” মেয়েটা পাগল আমি প্রায়ই দেখি এই রাস্তার পাশে বসে থাকে , একা একা কথা বলে ” । আমি আবার মেয়েটার দিকে তাকালাম ।
আমি খুব ভাল করে দেখতে লাগলাম । কিন্তু তাকে কেমন জানি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে । আরে এতো দেখছি ঝুমুর । তা কি করে সম্ভব , না এটা হতে পারে না , হয়তো আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে । নিজের মনকে কোনোভাবে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না । আমার যে সত্যটা জানতে হবে । আমার ভাই বোনদের বললাম ” তোরা বাস নিয়ে বাসায় চলে যা । আমার কিছু কাজ আছে আমি সেটা মিটিয়ে তারপর বাসায় যাবো ।
বাবা মাকে বলিস চিন্তা না করার জন্য আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় থাকবো । এই বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম । ফিরে গেলাম আমি সেই চার বছর আগে । চার বছর আগে আমি চট্টগ্রামে ছিলাম । আমার এক চাচার বাসায় থেকে এখানে পড়াশোনা করতাম । তখন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল আবির । আমি আর আবির সবসময় একসাথে থাকতাম একসাথে আড্ডা দিতাম । ঝুমুর ও তখন আমাদের সাথে একি ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো । আমাদের এক বছরের জুনিয়র ছিল । ঝুমুর কে প্রথম দেখায় আমার খুব ভালো লেগে যায় । তাই আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করি । তারপর ভাবলাম একদিন সময় বুঝে প্রপোজ করবো ।
তারপর একদিন সাহস করে তাকে ভালবাসার কথা বলে দিলাম । কিন্তু তখন জানতে পারলাম সে শুধু আমাকে বন্ধু হিসেবে জানে । তার নাকি রিলেশন আছে । আমি যখন জানতে চাইলাম কার সাথে । তখন সে যার কথা বলছে তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না । ঝুমুর বলছিল” তোমার বন্ধু আবিরের সাথে দুই বছর ধরে সম্পর্ক । আমাদের সম্পর্কের কথা আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না । আমি আবির কে বারণ করছিলাম যাতে কাউকে না বলে তোমাকেও না । সেদিন রুমে ফিরে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম । চাচা চাচি আমার কি হয়েছে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন কেন হঠাৎ করে এভাবে বাসায় চলে যাচ্ছি জানতে চাইছিলেন । আমি শুধু বললাম” এমনি ভালো লাগছে না এই শহর ।
কিন্তু বাসায় চলে যাওয়ার দুইটা কারণ ছিল । একতো আমি আবির এর সামনে কিভাবে দাঁড়াবো , আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করতে চেয়েছি তাকে ভালোবেসেছি । আবির যখন জানতে পারবে তখন কি অবস্থা হবে আমার । দ্বিতীয় কারণ ” জীবনে প্রথম কাউকে ভালো লেগেছে কাউকে ভালোবেসেছি । কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষ এখন অন্যের । আর সব সময় নিজের চোখে দেখতে হবে সে অন্যের সাথে কথা বলছে অন্যের সাথে আড্ডা দিচ্ছে অন্যের সাথে ঘুরছে । তা আমি কি করে মেনে নিব, কি করে সহ্য করবো ,কি করে দেখতে পারবো । তারচে’ বরং গ্রামের বাড়ি চলে যাই সেটাই আমার জন্য সবচেয়ে বেটার ।
আমি আমাদের গ্রাম লক্ষ্মীপুরে চলে আসি । কিন্তু আসার পরও আমি ভালো থাকতে পারছিলাম না । বারবার ঝুমুরের কথা মনে পড়ছিল । আবিরের সাথে আড্ডা দেওয়া দুষ্টামি করার ,ঘুরে ফেরানোর দিন গুলোর কথা বার বার মনে হচ্ছিলো । দু’জনকেই অনেক মিস করছিলাম । কয়েকবার ভাবছিলাম আবার চট্টগ্রাম চলে যাই তাদের কাছে । পর ভাবলাম কি দরকার তারা দুজন সুখে থাকুক তাদের মাঝে আমি এসে কাবাবে হাড্ডি হতে চাই না । অনেক ভেবে দেখলাম তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে যাতে মন চাইলো তাদের সাথে দেখা করতে না পারি যোগাযোগ করতে না পারি । তাই বাবা মাকে বললাম আমি আর পড়াশোনা করবোনা আমি বিদেশ যাবো । তার কিছুদিন পরেই আমি বিদেশ চলে যাই ।
এই চার বছরে আমি তাদের সাথে কখনোই কোনো যোগাযোগ রাখেনি । কিন্তু চার বছর পর দেশে এসে আমি ঝুমুরের এই অবস্থা দেখবো । আমি তা কখনো কল্পনায় ও ভাবিনি । পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে আবিদের বাসায় চলে এলাম । আবিরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার মা কান্না শুরু দেন । কিন্তু আবিরের বাবা নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন ” আবির তো বেঁচে নেই ।এক বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে মারা যায় । আমার মনে এখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে । আবিরের কারণে কি ঝুমুরের আজকে এই অবস্থা। বিষয়টা আমাকে জানতে হবে, আমি চলে যাওয়ার পর তাদের জীবনে কি হয়েছে ।
ভার্সিটিতে আমাদের আরেক কাছের বন্ধু ছিল রুদ্র । এরপর আমি তার কাছে গেলাম । রুদ্র তখন আমাকে বললো ” দেখ দোস্ত সঠিক কী হয়েছে আমার জানা নেই । আর কিভাবে জানবো বল, একজন মারা গিয়েছেন অন্যজন পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন । সত্যিটা তো অজানাই রয়ে গেল ।তবে আমি যতটুকু জানি সেটাই তোকে বলছি । ঝুমুরের বাসা থেকে যখন বিয়ের জন্য তাকে চাপ দিচ্ছিলো , তখন ঝুমুর তাদের সম্পর্কের কথা তাদেরকে জানায় । কিন্তু সম্পর্কটা তাঁদের পরিবারের কেউ মেনে নিতে চাইনি । এলাকার এক নেতার সাথে ঝুমুরের বিয়ের কথা বার্তা ফাইনাল করে ফেলে । কিন্তু ঝুমুর কোনরকমে রাজি হচ্ছিল না । যার সাথে ঝুমুরের বিয়ে ঠিক হয়েছে সে কয়েক বার আবিরকে হুমকি দিয়েছে ।ঝুমুর কে ভুলে যেতে তার থেকে দূরে থাকতে । কিন্তু আবির তার কথা শুনেনি ।
তারপর আবির ঝুমুর দুজনে ঠিক করে তারা কাজি অফিসে বিয়ে করে নেবে । এরপর একদিন সু্যোগ বুঝে আমরা সকল বন্ধু বান্ধব মিলে বিয়ের ব্যবস্থা করি । সবাই মিলে কাজী অফিসে বসে বসে আবিরের জন্য অপেক্ষা করি । কিন্তু সেদিন আবির এখানে আর উপস্থিত হয়নি । আসার পথেই বাইক এক্সিডেন্ট করে মারা যায় । অনেকের ধারণা এটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো না ,এটা মার্ডার ছিল । কিন্তু সত্যিটা সবারই অজানা । আবিরের মৃত্যু খবর শুনার পর থেকে ঝুমুরের এই অবস্থা ।
চট্টগ্রাম টু লক্ষীপুর একটা টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলাম । বাস ছুটে চলছে , আমার দু চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে । যে ভালোবাসা দুজনের বন্ধুত্ব নষ্ট করে , যে ভালোবাসা দুজন বন্ধুকে আলাদা করে । যে ভালোবাসার জন্য কেউ তার প্রাণ হারায় । যে ভালোবাসার জন্য কেউ তার সন্তান হারায় । যে ভালোবাসার জন্য মানুষ পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে । যে ভালোবাসার জন্য আজকে দুইটা পরিবারে নেমে আসে কষ্টের সাগর । সেই ভালবাসা কি করে ভাল হয় । না না তা হতে পারে না, ভালোবাসা ভালো নয় ।