এসি রুমে বসেও ঘামছে শফিক সাহেব। সবকিছু তার কাছে ঘোরের মতো লাগছে! এ মুহূর্তে উনার সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে হসপিটালের বেডে বসে থাকার কথা হাসি মুখে আর চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে কিন্তু উনি বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করে নিজের বাসার বেডরুমে বসে আছেন।
এইতো কিছু সময় আগে যখন কর্তব্যরত নার্স তার সদ্য জন্মানো মেয়েকে কেবিনে দিয়ে গেলো সবার সেকি আনন্দ মেয়েটাকে ঘিরে। সবাইতো একনজর দেখেই বলে দিলো মেয়েটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে। দেখতে বাবার মতো হওয়া মেয়েরা খুবই ভাগ্যবতী হয় আরো কত কথা সবার। সব শুনে কেমন যেনো মেয়ের প্রতি মায়াটা আরো বেড়ে গেলো তার। মায়ের কোল থেকে মেয়েকে কোলে নিতেই চমকে উঠলো নিজেই! সবাই কি সব বলছে মেয়ের চেহারা কোনো ভাবেই তার নিজের সাথে মিলছে না।
ঠিক এমন কাউকে সে আগে কখনো দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে কেমন যেনো পিচ্ছি মেয়েটাকে খুব ভয়ংকর মনে হচ্ছে তার। অথচ সবাই বলাবলি করছে মেয়েটার কি মিষ্টি চেহারা। মাথাটা কেমন যেনো করে উঠলো তার,মেয়েটার দিকে তাকানোর পর মনে হলো তার মস্তিষ্ক কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। আর তাইতো সবাইকে লুকিয়ে দ্রুত বাসায় এসে বসে বসে ভাবছে। কিন্তু কোথায় দেখলো এমন কাউকে তা ভেবেই পাচ্ছে না।
টুংটাং শব্দে পাশে রাখা ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। কোনো দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই তার। ভাবনার জগতে ঘুরতে গিয়ে কখন যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো তাও বুঝতে পারলো না সে। মোবাইলটা হাতে নিতেই সময়টা দেখলো আর মায়ের মোবাইল থেকে আসা অনেকগুলো কল দেখতে পেল। এক্ষুনি হসপিটালে যাওয়াটা খুবই দরকার তার আর তাইতো দ্রুত বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। হসপিটালে পৌঁছাতেই সবাই যেনো তাকে দেখে অবাক হলো একদম ঘেমে জুবুথুবু হয়ে আছে,আর চেহারাটাও কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে আছে। আর এসব দেখে ই মা বললেনঃ
– কিরে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কি হলো তোর আর কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলি?
– কি হবে আমার কিছুই হয়নি একটা কাজ ছিলো তাই বাহিরে গিয়েছি।
-আচ্ছা। বড় ডাক্তার এসেছিলো আর বললো কাল সকালেই বৌমা আর পরীটাকে বাসায় নিতে পারবো।
সময়গুলো খুবদ্রুতই কেটে যাচ্ছে। ছোট্ট পরীটার বয়স এখন চার বছর পার হয়ে গেলো। এতদিনেও মেয়েটার কাছে সহজ হতে পারছে না শফিক সাহেব। মেয়েটার দিকে তাকালেই কেমন যেনো এক অজানা ভয়ে গা শিউরে উঠে আর তাই মেয়ের থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
রাতে ঘুমাতে গেলেই একরাশ চিন্তা মাথায় ভর করে। এপাশ ওপাশ করে ঘুম আসছে না বার বার একটা অস্পষ্ট চেহারা ভেসে আসছে মনের কোণে। পাশের রুমে মা-মেয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। শোয়া থেকে উঠে একটা ঘুমের অসুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে আবার তিনি। আজকাল ঘুমের জন্য এই অসুধটাই একমাত্র ভরসা। একমাত্র মেয়ে তার কত স্বপ্ন ছিলো তার মেয়ে জন্মানোর আগে। খুব পছন্দের নাম মিতুল আর এই নামটাই রাখবে ঠিক করেছিল তখন। বাবা-মেয়ে একসাথে খেলবে,খাবে,ঘুমাবে কত স্বপ্ন ছিল মনে আর এখন মেয়ের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই একটা কারনেই সংসারে মাঝেমধ্যে অশান্তির শুরু হয়।
নিশি কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না মেয়ের প্রতি তার এই আচরণটা। মাঝেমধ্যে তো বলেই বসে হয়ত অন্য কোথাও তার আরো একটা পরিবার আছে সন্তানসহ, আর তাই মেয়েকে এমন অবহেলা করে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই অফিসে চলে আসেন শফিক সাহেব। এই কয়টা দিন দম ফেলার সময় নেই অফিসে কাজের চাপ বেশি থাকে এই সময়ে। কাজের মাঝে এতোটাই ডুবে আছে যে, পাশে ফোনটা বেজেই চলছে তা শুন্তেই পারছে না। কাজ শেষ করে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে নিশির অনেকগুলো কল। নিশিকে কল দিতেই অপাশ থেকে ভেসে আসছে চিৎকার করে কান্নার শব্দ। যার জন্য কিছুই বুঝতে পারছে না আর তাই খুব দ্রুত বাসায় রওনা দিলো।
বাসায় এসেই থমকে গেল তার পৃথিবী ছোট্ট মিতুল এর শরীরটা ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। নিশি চিৎকার করে কাঁদছে আর পাশের বাসার মানুষগুলো নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম দেখলো শফিক সাহেব যে নিজের চেহারর সাথে পুরো মিল। দুহাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগলো হসপিটালের দিকে।
হসপিটালে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত ডাক্তাররা জানিয়ে দিলো এ ধর্ষন কেইস। আর আগে পুলিশ কেইস করতে হবে নয়তো তারা চিকিৎসা শুরু করতে পারবে না। রক্তাক্ত দেহে হসপিটালের বারান্দায় শুয়ে আছে ছোট্ট মিতুল তার পাশেই নিশি জবানবন্দি দিচ্ছে পুলিশকে। শফিক সাহেব অফিসে যাবার পর মিতুল ঘুমে ছিলো আর তাই নিশি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পাশের মার্কেটে যায়। কাজ শেষে ফিরে এসেই দেখতে পায় বাসার দরজা খোলা আর রক্তাক্ত দেহে মেঝেতে পড়ে আছে মিতুল।
শফিক সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তার মেয়ের দিকে। মেয়ের চেহারা আবারো অস্পষ্ট লাগছে তার কাছে। অস্পষ্ট কিছু শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। ডাক্তাররা স্ট্রেচারে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাচ্ছে মিতুলকে। আর আস্তে আস্তে তার কাছে চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে এ যেনো বিন্তির মুখাবয়ব। চিৎকার গুলো ক্রমশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বিন্তির চিৎকার ‘ ছাড়ুন আমায় , আমাকে ছেড়ে দিন ‘।
মেয়েকে হসপিটালে রেখে আবারো বাসায় পালিয়ে আসলো শফিক সাহেব। এতো দিনের অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো যেনো জীবন্ত মনে হচ্ছে। কত বছর আগের কথা বাসায় একা পেয়ে ছোট্ট কাজের মেয়েটার উপর শকুনের মতো হামলে পড়েছিলো নিজের লালসা মিটাতে। ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো ছোট্ট বিন্তিকে। বিন্তির চিৎকার যেনো তাকে আরো বেশি পশুতে পরিনত করছিল। ছোট্ট বিন্তির পুরো শরীর খুবলে খুবলে খেয়েছে নরপশুটা। নিজের লালসা মিটাতে গিয়ে মেরেই ফেলছিলো বিন্তিকে। লাশটাও গুম করে ফেলেছিল তখন। কেউ কখনো জানতেও পারেনি। সবার ধারনা ছিলো পালিয়ে গেছে বিন্তি।
কিন্তু আজ বুঝতে পারছে কেউ না দেখলেও না জানলেও উপরে একজন আছে যিনি সব দেখছেন আর জানেন আর তাইতো তার ছোট্ট মিতুলও আজ ধর্ষনের স্বীকার হলো। মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করে দিলো শফিক সাহেব, খাটের উপরই পড়ে আছে মেয়ের বউ সাজার লাল টুকটুকে কাপড়টা। কাপড়টা হাতে তুলে নিয়ে ফ্যানের দিকে ছুঁড়ে মারলো মেয়ের পড়ার টেবিলটা নিয়ে আসলো ফ্যানের নিছে আর উঠে দাঁড়ালো তাতে ঝুলন্ত কাপড়টা জড়িয়ে নিলো নিজের গলায়।