তিন মেয়ে বাড়িতে বিচার দিয়ে গেছে, আজ আমার মজা বুঝাবে অামার বাপজান। সারাদিন বাসায় ঢুকিনি ভয়ে। মেেয়গুলোও সামান্য বিষয় নিয়ে বিচার দিয়ে গেল। আমাদের এদিকে ছোট ছোট গাছে এক ধরনের ফল হয়, এটা খাওয়া যায়না। অাকারে ছোট ও ওজনে হালকা হয়। এই ফলটার চতুর্দিকে কাটার মত দেখা যায়। পিছন থেকে কারো চুলে ঢিল ছুড়লে বুঝাই যায়না, অথচ চুলে একবার প্যাঁচ লাগলে দশ মিনিট লাগবে ছুটাতে। অামিও দুষ্টুমি করে চুলে দিয়ে দিছি, কিছুুক্ষন রাগ দেখিয়ে বাড়িতে বিচার দিয়ে গেল। রাত সােড় আটটার দিকে বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখি আপু জানালা দিয়ে ডাকতেছে, কাছে এগিয়ে গেলাম। আপু ফিসফিস করে বলতেছে..
— বাবা মা ঘুমায়নি, তোর জন্য খাবার রাখছি, আমি জানালা দিয়ে দেই তুই খা। সারাদিন মনে হয় কিছু খাসনি।
আপু ঘরের ভিতরে বসে ভাত মেখে জানালা দিয়ে আমার মুখে তুলে দিচ্ছে আর আমি খাচ্ছি। আপু আবার রাগ দেখিয়ে ফিস ফিস করতেছে। তোরে কতদিন বলছি দুষ্টুমি কম করে কর, এখন বড় হইছিস। কে শোনে অামার কথা? যেদিন থাকবনা সেদিন বুঝবি। খাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
— কিরে খাচ্ছিসনা কেন?
— তুই কোথায় যাবি অামাকে রেখে?
— হা হা, অামার বিয়ে হলে শশুরবাড়ি চলে যাব, তখন তুই দুষ্টুমি করলে এভাবে জানালা দিয়ে কে খাওয়াবে?
— অাচ্ছা আর দুষ্টুমি করবনা
— এটাতো প্রতিদিনই বলিস। নতুন কিছু থাকলে বল। এমন কোন দিন বাদ যায়না যে তুই একটা কিছু করিসনা। কয়দিন বাঁচাব বাবা মার কাছ থেকে?
— পানি দাও, খাওয়া শেষ।
— খাওয়া শেষ, এখানেই বসে থাক। বাবা মা ঘুমালে আমি দরজা খুলে দেব।
দুপুরে খেতে বসেছি, বাবা মা, আপু আর আমি। আপু সবসময় আমার পাশেই বসে। ওড়নার জন্য, ওড়নার মধ্যে জাদু আছে। হা হা। আমি আর আপু প্রচুর ঝাল পছন্দ করি। কাঁচা মরিচের ভর্তা সবচেয়ে বেশী ভাল লাগে। তবে বাবা অার মার জন্য খেতে পারিনা। তাদের কথা হল প্রতিদিন গোস্ত, মাছ শাকসবজি রান্না করে তবুও মরিচ ভর্তা খেতে হবে কেন? তাই নিষেধ। তবে আপু কাচা মরিচের ভর্তা বানিয়ে বাটিতে করে ওড়নার নীচে দিয়ে নিয়ে আসত। আপু বসে মাটিতে বাটি রেখে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখত, আমি আর আপু লুকিয়ে ভর্তা নিয়ে তরকারীর সাথে মিক্স করে খেতাম। আর যেদিন বাড়িতে দুষ্টুমির বিচার দুই তিনটা যেত সেদিন আর আমার স্কুলে যাওয়ার সময় টাকা দিতনা। আপু আমাকে খোঁচা দিত, আমিতো জানি আরেকটা জাদু আছে। ওড়নার মাথার এক কোণে আপু টাকা গিট্টু দিয়ে বেঁধে রাখত। আমি সেখান থেকে টাকা খোলে নিতাম।
এই ফলটার শুদ্ধ ভাষা কি অামি জানিনা। আমাদের এলাকায় ঢেউয়া ফল বলে। বাড়ির উঠোনের এক পাশে ছোট একটি গাছে ফলগুলো হয়েছে। আমি দুষ্টুমি করতে করতে আসতেছি, হাতে অস্ত্র। অস্ত্রটা বানিয়েছি পুরাতন ছাতা থেকে লোহার কাঠি নিয়ে রাস্তায় ঘষে অনেক সূচালো করেছি, এখন শুধু পাখিনা যা পাই ওটাকেই মারি। গতকাল একজনের মুরগীর বাচ্চাকে মেরে দিছি। বাড়িতে বিচার দিছে, আমি বলছি অমিতো ভাবছি কোয়েল পাখি। কোয়েল পাখিওতো মুরগীর বাচ্চার মত। আমাকে আসতে দেখে আপু একটি ফলে ধরে বলতেছে,
— শ্রাবইন্না, বড় ঢেউয়াটা পাকছে, আমি খেয়ে ফেলি। (দুষ্টুমি করে)
— না, আমার গাছের ঢেউয়া আমি খাইনাই, বড়টা তুই খেতে পারবিনা। (জীবনেও গাছ লাগাইনি, অথচ অামার গাছ)
আপু আমাকে দেখিয়ে ফল ধরার চেষ্টা করতেছে, আমি রাগে দূর থেকে সেই সূচালো কাঠি মারছি, এটাতো সত্যি সত্যি আপুর পায়ে বিধে গেছে। হাটুর নীচে বিধে একদম আরেকপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার দৌড় আর দেখে কে? এটা কি করলাম আমি? এটা বিধল কিভাবে? সারাদিনতো একটা পাখির গায়েও লাগাতে পারিনা। আমাকে খুঁজতে দশ পনেরো জন বেরিয়ে পড়ছে, আমি গাছের ঝোপে লুকিয়ে থেকে ভাবতেছি, কখনো তো এভাবে খুঁজেনি আমাকে। আপুর কি হইছে, আজকে আমাকে মেরেই ফেলবে। ভাবতে ভাবতে পিছন থেকে বাবা আমাকে ধরে ফেলছে। আমি ভয়ে শেষ, ভাবতেছি আজ আমার রক্ষা নাই। বাবা বলতেছে তারাতারি হাসপাতাল আয়। কিছুই বুঝতেছিনা আমি। হাসপাতাল যাওয়ার পর আপু ডাকতেছে। মাথা নীচু করে পা টিপে টিপে কাছে গেছি।
— ভাই, ঐ শ্রাবণ। বাবা মারছে তোকে?
— না আপু মারেনি।
— আমি না করছি মারতে। এজন্যইতো ঔষধ খাইনি এখনো। বলছি আমার ভাই এনে দিবা তারপর খাব।
আমি আপুরে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেছি,
— আপু আমাকে মাফ করে দে
— ধুর পাগল, আমার কাছে তোর কোন দোষই নাই। ঢেওয়া ঐটা তুই খাবি। তুই খাইলেইতো অামার খাওয়া হবে।
— না আপু, দুইজনে মিলেই খাব। বাবা মা চুপ করে আছে, মনে হয়না আমার প্রতি আর কোন রাগ আছে, রাগ দেখালে অাপু ঔষধ খাবেনা।
— এই আপু এবার ঔষধ খেয়ে নে
— তুই আগে কাছে আয়
কাছে যাওয়ার পর কানে কানে বলতেছে, আমি ঔষধ খাওয়ার সময় বাবা মা আমার দিকে তাকিয়ে থাকব। তোরে কিন্তু দুই তিন দিন টাকা দিবেনা। আমি ঔষধ খাওয়ার সময় ওড়নার মাথা থেকে টাকা খুলে নিস।
— আমার লাগবেনা আপু
— তাহলে আর ঔষধ খাবনা
— আচ্ছা নিব
আমি ওড়না থেকে টাকা নিয়ে গেছি। স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতেছে। অনেক বছর আগের কথা এগুলো। এখন আমি বড় হয়ে গেছি, আপুর ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। আজ যখন ফোনে জানতে পারলাম আমার সেই আপুটা অসুস্থ, মনে হচ্ছে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। আমি আপুর সেই পিচ্চি ভাইটা আপুর কাছে যেতে পারছিনা। আপুর কাছে বসলেই আপু অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে। আমার যখন অসুখ হত, আপু কপালে হাত বুলিয়ে দিলেই মনে হত আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি। খুব কষ্ট লাগতেছে, আজ আমি ইচ্ছে করলেই সেই আপুর কাছে ছুটে যেতে পারছিনা। কারন আমি যে প্রবাস নামক জেলখানায়।