ছোট বেলায় গ্রামের এক ভদ্রলোক আমাকে যেখানে দেখতেন সেখান থেকে জোর করে হলেও কোলে নিয়ে উনাদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন।তখন আমার বয়স ছয়-সাত হবে।ভদ্রলোক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উনার স্ত্রীর কোলে দিয়ে বলতেন, তোমার জন্য মেয়ে নিয়ে এসেছি,রেখে দাও। কেউ দেখেনি।খোঁজ করলে বলে দেবো, আমি জানিনা কোথায় হারিয়ে গেছে হয়তো।
উনার স্ত্রী হাসতে হাসতে এদিক ওদিক গড়াগড়ি খেতেন।এখানে হাসার কি আছে আমি বুঝতামনা।কিন্তু আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। মহিলা আমাকে কোলে নিয়ে যতোসব আহ্লাদী আদুরে শব্দে আদর করতেন,আহারে লক্ষীসোনা কাদিস কেন?তোরে আমি দিয়ে আসবো।লোকটা ভীষণ খারাপ,শুধু শুধু আমার মেয়েটারে কাঁদায়।ওরে আমি মেরেই ফেলব।দেখিস তুই।এসব কথায় আমি বিশ্বাস করতামনা।ভাবতাম উনারা সত্যি আমায় যে কোন একদিন রেখে দিবে। গায়েব করে ফেলবে।
ভদ্রলোক ছিলেন গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক।বিয়ের দশ বছর পরেও তখন বাচ্চা হয়নি।কিন্তু বাবার কাছে নাকি আমাকে দত্তক চাইতেন। বাবার বন্ধু হিসেবে বাবা দিতে রাজি হলেও মা কখনো দিতে রাজি হয়নি।
ভদ্রলোকের বাবা হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আর উনার স্ত্রীর মা হওয়ার তীব্র ইচ্ছে তখন প্রকৃতির সব অভাবের উর্ধ্বে।যেভাবেই হোক সন্তান চায় উনারা।মাসে দুই তিনবার হলেও উনারা শহরে আসা-যাওয়া করতেন।প্রত্যেকবার আসার সময় আমার জন্য নতুন ড্রেস,নতুন ব্যাগ,কানের দোল কিছুনা কিছু একটা হাতে করে নিয়ে আসতেন। এসব পেয়ে আমি খুশি হলেও উনাদের কেমন জানি ভয় ভয় লাগতো আমার।যদি কোন একদিন আমাকে উনারা সত্যি উনাদের ঘরে রেখে দেয়। ভয়টা যতো বড়ো হচ্ছিলাম ততো কমছিল।কুড়ি বছর বয়সে এসে সেই ভয়টা একদম দূর হয়ে গেলো।আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন।ভদ্রলোক এবং উনার স্ত্রী তখনও একেবারে সন্তান হবেনা সে আশা ছাড়েনি।
ভদ্রলোক অসুখে ভোগা শুরু করলেন।তখন বয়সের ভারটাও ষাটের কোটায়।উনারা আমাকে মেয়ের মতোই দেখে।আর আমি আঙ্কেল-আন্টি বলে ডাকি।উনারা আমার ভরসায় শহরে এসে বাসা ভাড়ায় থাকা শুরু করলেন।আর আফসোসের সাথে আমাকে বলেন, জানিস মেয়ে,তোর আঙ্কেলকে কতো করে বলতাম আরেকটা বিয়ে কর তাহলে কিন্তু তুমি বাচ্চার বাবা হলেও হতে পারো।কিন্তু করেননি,এখন দেখ কতো দরকার একটা সন্তানের। জানিস আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনো একই কথা বলতেন। কথায় কথায় আমাকে বন্ধ্যা বলে খোটা দিতেন।আর তোর আঙ্কেল আমার চোখের জল মুছে দিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন, আর রাস্তা থেকে হোক ভাবির কোল থেকে হোক জোর করে তোকে কোলে তুলে নিয়ে আসতেন।আমরা তোকে রেখে দিব বলে তুই ভয় পেয়ে যেতি।বড্ড বোকা ছিলি তুই।তুই কত বোকা ছিলি তোর হয়তো এতো মনে নেই,যতোটা আমার আছে। তোর বোকাসোকা কাজগুলোর কথা আমাদের মনে পড়লে তোর আঙ্কেল হাসতে হাসতে কাঁদতে শুরু করে।তুই আমাদের থেকে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করতি,আর আমরা তোর কাছে কাছে থাকতে পছন্দ করতাম। তাই কিছু না কিছু দিয়ে তোর কাছে কাছে থাকতাম।
আন্টি অতীতের কথাগুলো বলে আর হাসে।আর একটা সন্তানের জন্য আফসোস করে বলে, জানিস আমাদের সংসারে যতোটা না সংসারের কথা হতো তার চেয়ে বেশি কথা হতো তোকে নিয়ে,আর আমাদের একটা তোর মতো একটা মেয়ে হবে সেই আশাটাকে নিয়ে। তোকে নিয়ে এখনো আমাদের গল্প করতে ভালোলাগে বুঝলি,তুই আসলে অনেক ভালো।দোয়া করি, তুই যেন সব ধরনের বিপদ আপদ থেকে বেঁচে থাকিস। আমিও আজকাল উনাদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।আঙ্কেল মাঝেমধ্যে আমার হাত ধরে বলে,মারে আমি ছাড়া তোর মায়ের কেউ নাই তাতো জানিস।আমি মারা গেলে ওর প্রতি একটু খেয়াল রাখিস।গ্রামের দু একরের জমিটা তোর নামে করে দিতে বলিস। বুঝতাম, জ্বরের ঘোরে আঙ্কেল আন্টিকে আমার মা ভাবছেন।আমার কোন প্রত্যাশা ছিলোনা, আমারো উনাদের ভালোলাগে বলে এভাবে কাছে থাকার চেষ্টা করছি।
আঙ্কেলের ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার পর উনি একদম আমার হাত ধরে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে থাকেন।আন্টি স্বামীর পায়ের নিচে মাথা টুকে দিয়ে বসে থাকেন।আর কাঁদেন।আঙ্কেল প্রকৃতির হাতে বন্ধি হলে আন্টিও যেন ধীরে ধীরে তাদের কাছে হার মানছিলেন। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি আঙ্কেলের হাত ধরে স্কুলে আসা যাওয়া করেছিলাম।প্রায় সময় উনাদের ঘরে থাকতাম। আন্টির সুখ-দুঃখের কথা শুনতাম,আঙ্কেলের কাছে পড়তাম।আঙ্কেল উনার সাথে আমার তুলনা দিতে ভালোবাসতেন।বলতেন,আমি আঙ্কেলের মতো মেধাবী হয়েছি। আন্টিকে উনার শ্বশুর বাড়ির লোকজন মোটেও দেখতে পারতেননা।
তবে আঙ্কেল-আন্টিদের সন্তান হয়নি বলে কোনদিন আমি তাদের মধ্যে একটু মনোমালিন্য হতেও দেখিনি সংসারের দায়িত্বগুলো আন্টি ভালোভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন আর আঙ্কেল শুধু এই দুঃখিনীকে ভালোবাসা দিয়েছেন।আঙ্কেলের মৃত্যুর দিন যতোই ঘনিয়ে এসেছিলেন আন্টির চিন্তাও ততো বেশি হচ্ছিল। উনি আমার হাত ধরে বলে,তোর আঙ্কেল মারা গেলে আমার কি হবে রে। বুড়ো বয়সে বাপেরবাড়ি কোথায় যাবো বল। সন্তানহীনদের সান্তনা কি করে দেয় জানা নেই আমার,তবে যিনি এরকম দুঃখিনীদের সৃষ্টি করেছেন তিনিই ভালো জানেন।তাই আমি সৃষ্টিকর্তার আশ্বাস দিয়ে বলতাম, আন্টি যার কেউ নাই,তারতো সৃষ্টিকর্তা আছেন।উনি যেমন সৃষ্টি করেছেন,তেমন আপনাকে দেখাশোনার দায়িত্বটাও তিনি নিয়েছেন।আর আমিতো আছি আপনাদের পাশে সবসময়।
আন্টি আমার দিকে অনিশ্চিতভাবে তাকায়।বুঝতে পারি,আন্টি আমার উপর উনার যতোটুকু ভরসার দরকার ঠিক ততোটুকু ভরসা করতে পারছেন না। কিন্তু আমি সত্যি উনাদের ভরসা হতে চাচ্ছিলাম।এক ধরনের মায়া জন্মেছিল উনাদের উপর।।তাই যখন উনার হাতটা শক্ত করে ধরে বলি, বারে ছোট বেলায় মেয়ে ভাবতে, বড় হয়েছি বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছ তাইনা।আপন ভাবোনা আমাকে।আর ভালোবাসোনা আমাকে বুঝতে পারছি।
আন্টি তখন আমার কাঁধে মাথা রেখে বলে,জানিস মেয়ে,বৃদ্ধ বয়সে এসে সন্তানের ভরসায় মাথা গুজে শান্তিতে মৃত্যুর জন্য হলেও সন্তানের দরকার হয়।যার সন্তান আছে মাটি দেওয়ার পরো প্রতিটি মোনাজাতে তাঁকে স্বরণ করার কেউ তাকে,যার নেই সেই যেন মাটি চাপা পড়ার সাথে সাথে চাপা পড়ে গেলো সমাজের মানুষগুলোর মন থেকে। তার হয়ে খোদার কাছে ক্ষমা চাওয়ার যেমন কেউ থাকেনা।তেমন তাঁকে কথায় কথায় কেউ মনে রাখেনা। মনে মনে বললাম, এই বুঝি তোমরা সন্তানহীনা দের দুঃখ।মৃত্যুর আগেও অসুখ বিসুখে হাত ধরার কেউ,আর মৃত্যুর পর মনে রাখবেনা কেউ এই ভয় নিয়ে বাঁচো।এ রকম একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা বুকে চেপে রাখতে রাখতে একদিন সেই যন্ত্রণাটা নিয়ে সত্যিই একদিন মাটির নিচে তারা সহ দুঃখটাও চাপা পড়ে যায়।