পাশের টেপরেকর্ডার থেকে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের কন্ঠ ভেসে আসছে।
এর আগেও অনেকবার শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কানে এসেছে কথাগুলো। ছারপোকার ওষুধের বিজ্ঞাপন।
কিন্তু আজ ভালো করে শুনতে গিয়ে দেখি ক্যানভাসার বেশ একটা ছন্দ,
বিদ্রোহ আর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে একটা দুপুরের গল্পের মতো পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন নিজের পণ্যকে।
‘মাইরা ফালান, মাইরা ফালান। ছারপোকাগুলা মাইরা ফালান। ছারপোকা। ছারপোকা। ছারপোকা।
এই ছারপোকা যার ঘরে সেই বোঝে ছারপোকার কি জ্বালা।
এই যে দশ হাজার, বিশ হাজার টাকা খরচা কইরা দামী দামী খাট বানাইসেন আপনে। এই খাটে বংশবিস্তার করে ছারপোকা।
আর আপনে ঘুমান মাটিতে। অনেকেই বলে, ‘ছারপোকার নির্যাতনে চইলা যাইতে হবে বনে’।
কথায় আছে- মনের দুঃখে গেলাম বনে, বান্দরে কয়- পিঠ চুলকাইয়া দেই। এই মনের দুঃখে আর যাইতে হবে না বনে।
এখনই চলে আসেন আমাদের প্রচার গাড়ী লক্ষ্য করে। …’
ভ্রাম্যমাণ হকারের কথাগুলো কী সুন্দর। যেন একটা কবিতা। অদ্ভুত, শান্ত আর টলটলে।
চৈত্রের দুপুর। আকাশ থেকে মুষলধারে রোদ পড়ছে।
কুকুর-বিড়াল রোদে পিচগলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি শুনতে কেমন জানি নেশা লাগে।
এই খুব গরমেও চোখ ঢুলুঢুলু হয়। গরমে আর ধূলায় বাতাস ভারী হয়ে আছে।
সেই বাতাসে মানুষের মগজপোড়া গন্ধ। কেমন এক মাদকতা।
কাপে শেষ চুমুটা দিয়ে একজন প্রতারক প্রেমিকের মত হাতের সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেললাম।
যে প্রেমিক নিজের প্রয়োজন শেষে কেটে পড়ে। পড়ে থাকে সাদা ছাঁই।
অবশ্য বাস্তব জীবনেও কি আমি তেমনই একজন না? হয়ত। না, হয়ত না; আসলেই।
না হলে সেই বিকেলে রোদেলাকে ঐভাবে চলে যেতে দিতে পারতাম না। স্পষ্ট দেখেছি- ওর চোখ চিকচিক করছিলো।
কিন্তু কাঁদেনি। আমি অবশ্য আশাও করিনি। রোদেলা শক্ত মেয়ে। আধুনিক যুগের প্রচণ্ড ন্যাকা ধরণের মেয়ে নয় মোটেই।
মধ্যবিত্ততার সবগুলো সূত্র ওর জানা।
লেখাপড়া শেষ। মাঝারি ঘরের মেয়েদের জন্য এই সময়টা খুব খারাপ। চারিদিকে দূর সম্পর্কের আত্নীয়রা চারিদিকে কিলবিল করে।
এবং কেমন করে জানি সবার কাছেই বিশাল ভালো ভালো পাত্রের লিস্ট থাকে।
সেই দুঃসময়ে আরো দু’টো ছোট বোন আছে, এমন কোন মেয়েকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া যায় না। আমিও দিতে পারি নি।
তাই রোদেলারও আর বেলাবোস হয়ে ওঠা হয়নি।
তাই চাকরি পাবার কোনো খবর না থাকা সত্ত্বেও, আমি এক দুপুরে রোদেলাকে ফোন করেছিলাম।
‘বিকেলে এসো। জরুরি কথা আছে।’
ঠিক ধরেছেন। চাকরিটা আমার হয়নি।
অচিরে হবে সেই সম্ভবনাও কম ছিল। মামা-চাচার জোর নেই। রেজাল্টও আহামরি কিছু না।
এমনকি ইন্টারভিউতে গিয়ে ঠিক মতো গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না। রোদেলা যে কী দেখেছিল, সে-ই জানে।
অবশ্য ও সবসময়ই বোকাদের দলে।
শেষ বিকেলের অপরিচিত আলোয় দাঁড়িয়ে বোকা মেয়েটাকে শেষবারের মত বলেছিলাম ‘ভালো থেকো।’
রোদেলা কিছু বলে নি। একটু হাসার চেষ্টা করেছিলো শুধু। খুব একটা সুবিধা হয়নি।
আমি জানি বোকা মেয়েটা জীবনে হয়ত আর কখনোই ভালো থাকবে না।
তবু মাঝে মাঝে এই তুচ্ছ,অনর্থক শব্দটাই আমাদের নতুনভাবে বাঁচিয়ে রাখে- ‘হয়ত’।
দুপুরের রোদটা পড়ে এসেছে।
নিজের ঠোঁটের কোণে একটা আক্ষেপের বোকা হাসি আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখি সামনেই একটা কৃষ্ণচূড়া দাঁড়িয়ে আছে।
গাছের নিচে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। আরাম করে বসা যায়।
অথচ আমারও কিছু স্বপ্ন ছিল। একটা চাকরির খবর শুনবো।
সেদিন সবাইকে উপেক্ষা করে রোদেলা আর আমি হাত ধরে হেঁটে যাবো ক্লান্ত সন্ধ্যায়।
রাতে ফেরার সময় বাসার জন্য চিকেন-টিকেন কিছু একটা কিনে নিয়ে যাবো। সবার মুখে তখন চাপা আনন্দ।
হাজার চেষ্টা করেও কেউ লুকাতে পারছে না। মা একটু পর পর পর রঞ্জুকে চাপা গলায় ধমকাচ্ছেন।
তবে সেটা যে কৃত্রিম সেটা রঞ্জুও বুঝতে পারছে এবং আগের চেয়ে জোরে খিলখিল করছে।
কল্পনায় দেখতাম প্রথম মাসের টাকাটা দিয়ে বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছি।
মায়ের মুখে একটা কপট বিরক্তি, বাবার মুখে বোকা-চাপা হাসি।
‘কী দরকার ছিল এতগুলো টাকা নষ্ট করার।’ অথচ টাকাগুলো এরচেয়ে সুন্দর করে নষ্ট করা যেত না।
রঞ্জুটার একটা সাইকেলের খুব শখ। অনেক আগে যখন সে আরো ছোট ছিলো,
একদিন আমার কাছে এসে অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাইলো ছোটদের একটা সাইকেলের দাম কত।
ওর বন্ধুদের অনেকের সাইকেল আছে। কিন্তু ও কাউকে জিজ্ঞেস করেনি।
এরপরে একদিন রঞ্জুর টেবিলে কী একটা খুঁজতে গিয়ে দেখি ওর ছবি আঁকার খাতাটা পড়ে আছে।
হাতে নিয়ে দেখি কি কি সব এঁকে রেখেছে।
আম দেখলে কাঁঠাল মনে হয়, বেগুনী রঙ না থাকলে বেগুনটাকে নিশ্চিত কলসি ভেবে ভুল করতাম। নিজ মনেই হাসছিলাম।
কিন্তু একটা পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেলো। একটা সাইকেলের ছবি আঁকা। তার গায়ের নীল রঙটা যেন চকচক করছে।
এটাও যে খুব ভালো হয়েছে তা বলা যায় না। কিন্তু বোঝা যায়, বেশ যত্ন করে আর সময় নিয়ে পেন্সিল চলেছে এর উপর দিয়ে।
সেদিনই ঠিক করেছিলাম হাতে কিছু টাকা আসলে ওকে একটা সাইকেল কিনে দিবো।
কিন্তু টিউশনি করিয়ে যা পেতাম তাতে নিজেরই নানান কায়দা করে চলতে হয়।
ভেবেছিলাম চাকরিটা হয়ে গেলে একদিন ওকে গিয়ে বলবো- ‘নিচে তোর কোন এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে, দেখে আয়।’
রঞ্জু নিচে গিয়ে অবাক হয়ে যাবে। কোথায় কে? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না।
তার বদলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা অপরিচিত নতুন নীল রঙের সাইকেল।
ওর মুখের বোকা বোকা হাসিটা একটুও পাত্তা না দিয়ে বলবো, ‘দেখিস, গাড়ির নিচে পড়িস না আবার।’
ভাবতেই আমার হাসি পেয়ে যায়। আমাদের জীবনের অপূর্ণ নাটকগুলোই বোধহয় আমরা কল্পনায় সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চস্থ করি।
মনে মনে বারবার রিহার্সেল করি। সবগুলো ডায়লগ একেবারে মুখস্ত। কিন্তু নাটকগুলো কেন জানি শেষমেশ আর জমে না।
তবে এই নাটকটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার। হলো না। চাকরিটা হতে না হয় একটু দেরিই হচ্ছিল।
আর তো ক’টা দিন। কিন্তু রঞ্জুটা এমন করতে পারলো? অবশ্য ও সবসময়ই একটু অস্থির ধরণের।
মা বলতেন, তার ছোট ছেলেটার একটুও ধৈর্য্য নেই। আমাদের রঞ্জু একদিন হুট করে কোথায় চলে গেলো।
যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না আর।
বাবা প্রথমে কাঁদতে পারেননি। তারচেয়ে অবাক হয়েছিলেন বেশি। রঞ্জুর কি হয়েছিলো, আমরা সঠিকভাবে জানি না।
ডাক্তার অবশ্য অনেকগুলো টেস্ট দিয়ে জানার চেষ্টা করেছিলেন। সাথে সাথেই সেগুলো করানো যায়নি।
অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। দেরি করতে করতে কী ভীষণ দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
মনে আছে রঞ্জুটার মরে যাবার খবর শুনে আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এসেছিল তা হলো-
বাসা থেকে হাসপাতালে যাবার ভাড়াটাও নেই পকেটে। ইদানিংকালে মৃত্যুর খবর শুনে দুঃখ পেতেও টাকা লাগে। আহা জীবন।
সেদিন বুঝেছিলাম পৃথিবীর সেরা জীব বলতে যদিও আমরা মানুষ বুঝি, আসলে তা না,
সেরা জীব কখনো কিছু চারকোণা কাগজের হাতে বন্দী থাকে না।
দুপুরের রোদে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি অবশ্য। ঘরের কথা ভাবলে ইদানিং আমার বেশ অস্বস্তি হয়।
রঞ্জুর চলে যাবার পর আমাদের ঘরটা কেমন থমকে গেছে।
সেখানে আর কোনো আনন্দ নেই, হাসি নেই; মৃত কথারা নামতা পড়ার মতো গুনগুন করে সারাদিন।
মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখীতম জায়গার তালিকা করলে তাতে আমাদের তিন কামরার ঘরটার ঠিকই জায়গা হবে,
উপরের দিকেই হবে।
মা-টা অন্যরকম হয়ে গেছে। ইদানিং ঘরের ভেতর কেমন রোবটের মতো চলাফেরা করেন।
খেতে হয় বলে খান, খাওয়াতে হয় বলে খেতে ডাকেন। সেই ডাকে কোন প্রাণ নেই।
বাবার শুধু চোখে না, মনেও ছানি পড়েছে। রঞ্জুটা বাবার খুব নেওটা ছিল। বাবাটাও।
দুইজনে মিলে নিজেদের মাঝে নিচু গলায় ইঁদুরের মতো কিচকিচ করতো আর রঞ্জুটা হেসে গড়িয়ে পড়তো।
এইসব কথা এখন কোন সুদূর অতীতের মতো লাগে। মনে হয় স্মৃতিগুলো এই জন্মের না।
আমরা একদিন ভালো ছিলাম- ভাবতে এখন নিজের কাছেই কেমন যেন রূপকথার মতো লাগে।
যেন অনেক অনেক দিন আগের কথা। ‘এক যে ছিল রাজা’র মতো।
সামনের দরজাটা খুলে যেতেই চমক ভাঙ্গলো। মা-ই দরজা খুলে দিয়েছেন। সেই পুরনো ক্লান্ত চেহারা।
কে এসেছে দেখার কোন আগ্রহও নেই যেন। আমি জুতাজোড়া তুলে রেখে দরজা আটকে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাবা চশমার ওপর দিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন।
তার গায়ে একটা সুপ্রাচীন শার্ট যার মলিনতা যেকোন রিকশাচালককেও লজ্জা পাইয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
আমি বাবার দিকে সরাসরি না তাকিয়েও এসব বুঝতে পারি।
চোখের কোণ দিয়ে এভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখতে পারার মত কিছু ব্যাপার আমি বেকার হওয়ার পর থেকে কিভাবে জানি শিখে গেছি।
পাখাটা ছেড়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম। খুব গরম পড়ছে।
ভাত খাবো কিনা? মা দরজায় এসে কেমন যান্ত্রিক গলায় জানতে চান। বললাম, পরে।
ইদানিং মা আমার ঘরের দরজার এ পাশে খুব কমই আসেন। কথাবার্তাও শুধুই খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত।
আগে হলে মা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতেন। কোথায় গিয়েছিলাম। চাকরির কোন নতুন খবর আছে কিনা। এখন আর করেন না।
নতুন খবর শোনার আশায় থাকতে থাকতে তিনি আরো অনেক খবর শুনে ফেলেছেন।
আজ অবশ্য জিজ্ঞেস করলে মাকে নতুন কিছু বলতে পারতাম। বলতে পারতাম, একটা খবর আছে।
অনেকদিন আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম।
তারাই আজকে ডেকে হাতে এপয়ন্টমেন্ট লেটারটা ধরিয়ে দিয়েছে। বেশ ভালো চাকরি। মাস শেষে মোটা বেতন।
বছরে একবার কোম্পানীর খরচে পরিবারসহ ট্যুরের ব্যবস্থা। লোকটা যখন ট্যুরের কথাটা বলছিলো, হাসি চলে এসেছিলো আমার।
বোকা লোকটা ভেবেছে- ওটা বুঝি আনন্দের হাসি। হাসির গায়ে নাম লেখা থাকলে ভালো হতো।
আনন্দের হাসি, দুঃখের হাসি, আক্ষেপের হাসি।
কিন্তু ওসব কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না। শরীর ভরা ক্লান্তি আমার।
বালিশে মাথা রাখতেই দু’চোখ ভেঙে আসতে চাইছে জমাট অন্ধকার। আর আমি যেন ডুবে যাচ্ছি। নিচে, আরো নিচে।
পকেট থেকে দামী কাগজের এপয়ন্টমেন্ট লেটারটা বের করে পাশে শুইয়ে দিলাম। একটু ঘুমাক। সেও নিশ্চয়ই আমার মতো ক্লান্ত।
চোখ বন্ধ করতেই একচুমুক বাসি অন্ধকার চেপে ধরে। পরিচিত সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে কালো পর্দায়।
একটা নীল সাইকেল যেন আমাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দূরে, ক্ষীণ হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে শূন্যতায়।
সেদিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ রঞ্জুর চেহারাটা মনে পড়ে যায়। ও কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে।
ওর টলটলে দিঘীর মতো স্পষ্ট চোখে কী এক ভীষণ দুষ্টুমি উঁকি দেয়। তা দেখে সবকিছু ভীষণ হালকা লাগে। পাখির মতো।
যেন অনন্ত শূন্যতা নিয়ে ইচ্ছা করলেই উড়ে যেতে পারবো যেখানে খুশি। টের পাই কিছু একটা চেপে বসছে গলার উপর।
তাকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। কখনোই যায় না। চোখদু’টোর অসহায় আত্মসমর্পণ। নিরিবিলি।
বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে নামা দু’টো ঝাপসা বৃষ্টি নিয়ে আমি অপেক্ষা করি।
কিসের অপেক্ষা কে জানে। হয়ত একটা ভীষণ দুঃস্বপ্ন ভাঙার অপেক্ষা।