অবন্তীর মৃত্যু

অবন্তীর মৃত্যু

ছোট বোনটার লাশ রহমত চাচাদের বাড়ির পাশের নর্দমায় পাওয়া গেলো।সবেমাত্র ক্লাস ফোর এ পড়ে।পরের বছর ফাইভে উঠার কথা।মৃত দেহটিকে কয়েকটি কুকুর কামড়ে সেই দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তার আশে পাশে ছড়িয়ে রেখেছে।সেই থেকেই আজ দুর্গন্ধে মহল্লা মম করছিলো।সকালে এলাকার লোকজন নর্দমায় পরে থাকা আমার বোনের মৃত দেহটি আবিষ্কার করলো।অথচ কাল দুপুরের দিকে অবন্তীর হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপার ঘটার পর থেকে এইটাই ভাবতাম যে ওকে ফিরে পাবোই।মরে যাওয়ার ব্যাপারটা ভুল করেও মাথায় আনি নি।এক রাতেই এমন একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে তা তো মাথাতেও আসে নি।অবন্তীর দেহটা নর্দমার ময়লা গন্ধময় পানিতে মাখামাখি হয়ে পরে আছে।এইতো কাল সকালে আমি নিজেই তো ওকে গোসল করিয়ে দিয়েছিলাম।দুইবোন এক সাথে গোসল খানায় গিয়েছি।

সাবানের ফেনায় আচ্ছাদিত করে ধোয়া ওই শরীরটায় আজ এক গাদা ময়লা পঁচার আবরণ জড়িয়ে আছে।লাশটা দেখা মাত্রই আমার ছোট ভাইটা চিৎকার করে উঠলো।অথচ আমার পিচ্চি ভাইটা আমার চেয়ে আমার এই ছোট বোনটাকেই বেশী পছন্দ করতো।অবন্তী ওকে খুব আদর করতো বলেই হয়তো ওর পিছু পিছু থাকতো সবসময়।আর আজ অবন্তীর মৃত মুখটা ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে বলে ছোট ভাইটা চিৎকার করে উঠলো।আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।এতোক্ষণ পুলিশ এসে লাশটা নর্দমা থেকে উদ্ধার করলো।চারিদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।আমি এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছি না।এক মুহূর্তের জন্য এমনটা ভাবতে পারছি না যে অবন্তী আর আমাদের সাথে কখনো থাকবে না।আর এই দুনিয়ায় আসবেও না।

আমাদের পরিবারের সাথে কারো কোনো শত্রুতাও নেই যে কেউ আমার বোনটিকে মেরে ফেলা পর্যন্ত সাহস করতে পারে।সবকিছু খুব ঘোলাটে।পরিষ্কার করতে পারছি না এই জটলা। মা বাবা চিৎকার করে কান্নাকাটি করছেন।আমি শুধু দাঁড়িয়ে আছি মূর্তির মতো।এমন ঘটনায় এতোটা স্থির হয়ে কোনো মানুষ থাকতে পারবে বলে মনে হয় না।তবে আমি কিভাবে পারছি তাও জানি না।চারিদিকের ভীড় কমানোর চেষ্টা করছে পুলিশ।লোকজন নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে।

এই ঘটনার প্রায় দুইদিন কেটে গেলো।পুলিশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টের কথা শোনা মাত্রই আমাদের সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মতো অবস্থা হলো।অবন্তীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিলো।এইটুকু মেয়ের প্রতি কারা এতোটা নোংরা কাজ করতে পারে তা ভেবেই মানুষ নামক শব্দটার প্রতি ঘৃণা হচ্ছিলো।মানুষ কতোটা হিংস্র হতে পারলে এই পশুত্বের রূপ ধারণ করে আমার জানা নেই।পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমাদের সবাইকে জিজ্ঞেসবাদ করা শুরু করলেন ঘটনা ঘটারদিন থেকে শুরু করে সবকিছু।কিন্তু আমাদের কারো কথায় এমন কোনো তথ্য তারা খুঁজে পেলো না যাতে করে ইনভেস্টিগেশনে তাদের সুবিধা হয়।

আমাদের জীবন কিন্তু থেমে নেই।আমরা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে কাজ করছি,খাচ্ছি এবং চলছি।সারাদিনের কাজ শেষে বোনটার কথা যখন হঠাৎ মনে পরে তখন একেকজনের কলিজা ছিড়ে কান্না আসে আবার সবাই ভেঙে একাকার হয়ে যাই।

সেদিন আমি কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি আমার সাথে একটি কান্ড ঘটে গেলো।এলাকা কিছু বখাটে আমাকে আগের থেকেই অনুসরণ করতো।পাশ দিয়ে হেটে গেলে নানান মন্তব্য করতো।কয়েক সপ্তাহ আগে ওদের মধ্যে একজন আমার গায়ের ওড়না টেনেছিলো বলে আমি ওদের মুখে থুথু ছিটকেছিলাম।এরপর থেকে ওদেরকে আর এই মহল্লায় দেখি নি।শুধু একজন বিড়বিড় করে বলেছিলো প্রতিশোধ নিবে।এতোদিন পর আজ এই বখাটেগুলোকে রাস্তায় দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে।তবুও পাত্তা না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চলে আসছি ঠিক এমন সময় কেউ একজন বললো-

-দেখলি তোর পাপের শাস্তি কি দিলাম? আমি কিছু না বুঝেই চলতে লাগলাম।আরেকজন চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
-ছোট মালটা শেষ হইসে।এখন বড়টা বাকি। আমি থমকে দাঁড়ালাম।ওদের কথাগুলোতে আমার কেমন যেন সন্দেহ জন্মালো।আমি ফিরে তাকিয়ে বললাম-

-কি বললেন?
-ছোট ময়দানে প্র্যাক্টিকেল করে পাঠাইয়া দিলাম আর এখন তুই নিজেই আসলি ফাইনাল খেলার জন্য আমাদের উস্কাইতে!

আমার হাত পা কাঁপাকাঁপির পর্যায়ে চলে গেলো।এরা এসব বলছেটা কি!অবন্তীর মায়াময় চেহারাটা দুই চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠলো।আমি চিৎকার দিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে এলাম।কোথাও আর তাকালাম না।বাসায় এসেও হাত পা প্রচন্ড কাঁপতে লাগলো।সারা শরীরে জ্বর এসে গেলো।কাউকে কিছু বলার আগেই আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পরলো।কেন যেন মনে হচ্ছে আমার জন্য অবন্তীর সর্বনাশ হয়েছে।আমার জন্য ও শাস্তি পেয়েছে।জ্বরের মধ্যে কপালে হঠাৎ ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে ঝাপ্সা চোখে দেখলাম অবন্তী আমার কপালে হাত বুলিয়ে বলছে-

-আপু,আমি কিন্তু তোমার প্রতি রাগ করি নি।তোমার তো দোষ নেই।তুমি কেন নিজেকে এতোটা দোষী ভাবছো!যারা আমাকে ব্যাথা দিয়ে মেরে ফেলেছে ওদের শাস্তি দিও। হঠাৎ যেন আমার ঘুমের রেশ কেটে গেলো।পাশে তাকিয়ে দেখি সবাই আমার পাশে বসে আছে।আমি চেঁচিয়ে মাকে বলে উঠলাম-

-মা,অবন্তীকে ধর্ষন করা ওই জানোয়ারগুলো কে আমি চিনি।ওই জানোয়ারগুলো ওকে মেরে ফেলেছে মা।

মা আঁচল দিয়ে মুখ চেপে বসে আছেন।পাশে কয়েকজন লোক দেখতে পেলাম।এরা তদন্ত কমিটির যারা প্রতিদিনই তদন্ত করতে আসে।আমি তাদের দিকে তাকিয়ে একই ভঙ্গিতে কথাটা বললাম আর চিৎকার করতে লাগলাম।

ঠিক তখনই হঠাৎ আবার অবন্তীকে দেখতে পেলাম।আমার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে যেন মায়ার তীব্রতা।মায়াগুলো গলিত ধাতুর মতো ওর চোখ বেয়ে পরছে।।কি যে মিষ্টি লাগছে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত