সন্তানহারা

সন্তানহারা

—বাজান ও বাজান আমার খুব কষ্ট হইতাছে , আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না। আমার গা হাতপা খুব ব্যথা করতেছে। মা ও মা আমার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হইতাছে।

— আর একটু ধৈর্য ধর বাপ, এই তুমি গিয়া একটু ডাক্তার সাহেবরে ডাইকা আনো না পোলাডা আমার যন্ত্রণায় ছটফট ছটফট করতেছে।

— আইচ্ছা আমি দেখতাছি, পোলাডার কষ্ট যে আমার ও সহ্য হইতাছে না। কি যে করি আমি।

অয়ন গরীব বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, কিন্তু আজ সে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালের একটা মেঝেতে যন্ত্রণায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আর অয়নের বাবা মিন্টু মিয়া ডাক্তার এর জন্য পুরো হাসপাতালে চেম্বারে চেম্বারে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন ডাক্তার অয়নকে দেখার জন্য রাজি হচ্ছে না। যে ডাক্তারের কাছেই গিয়েই বলে ডাক্তার অজুহাত দিয়ে মিন্টু মিয়াকে ফিরিয়ে দেয়। একটা সময় মিন্টু মিয়া হাসপাতালের সবচেয়ে বড় ডাক্তার এর চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। চেম্বারে ঢুকেই মিন্টু মিয়া ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল;

— ডাক্তার সাহেব আমার পোলাডার খুব জ্বর দয়া করে আমার সাথে একটু চলেন? কথাটা বলেই মিন্টু মিয়া ডাক্তার এর হাত ধরে আকুতি মিনতি করতে থাকে।

— আরে আরে করছেন কি হাত ছাড়ুন।
— ডাক্তার সাহেব আপনি না গেলে আমার পোলাডা বাচবো না। একটাই মাত্র পোলা আমার ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না স্যার। আপনার পায়ে ধরি স্যার একটা বারের জন্য আমার সাথে একটু চলেন। কথাটা বলেই মিন্টু মিয়া ডাক্তারের পাটা জড়িয়ে ধরল।

— এই পা ছাড়ুন বলছি, কোথা থেকে যে এইসব থার্ডক্লাস মানুষ আসে বুঝতে পারি না, রহিম,,,, রহিম
— জে,,,জে, জে, জে, স্যার?
— এই লোকটা কিভাবে আমার চেম্বারে প্রবেশ করল।
— না মানে স্যার।
— কি মানে মানে করছ, তুমি চেম্বারের বাইরে থাকা শর্তেও এই লোকটা কিভাবে আমার চেম্বারে প্রবেশ করল।
— আসলে স্যার আমি একটু বাথরুমে গিছিলাম।

মিন্টু মিয়া অসহায় দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কি সত্যি ডাক্তার, একটা অসহায় পিতাকে বলছে থার্ডক্লাস মানুষ। ডাক্তারের আচরণ তো এমন হতে পারে না। ডাক্তার তো জনগণের বন্ধু। তার কাছে তো গরীব বড়লোকের কোন ভেদাভেদ থাকার কথা না।

— স্যার আপনি না গেলে আমার পোলাডা বাচবো না। ডাক্তারের পাটা জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে মিন্টু মিয়া।
— এই আপনি আমার পা ছাড়ুন। আমার এখন সময় নেই,
— আরে মিয়া চলেন বলছি স্যারের এখন সময় নাই। আর তাছাড়া স্যার যেনতেন রোগী দেখেন না বাইর হন বলছি। কথাটা বলেই রহিম মিন্টু মিয়াকে চেম্বার থেকে বের করে নিয়ে আসে।
রহিম তখন মিন্টু মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল;

—ভাই কিছু মনে কইরেন না। এই যে এই ডাক্তার ইনি একজন মস্তবড় ডাক্তার। কিন্তু এরা অনেক বড় ডাক্তার হইছে ঠিকই। কিন্তু এদের কাছে আপনার মতো গরীব মানুষের কোন দাম নাই এরা চেনে শুধু টাকা। এদিকে অয়ন এর অবস্থা খুব আসঙ্কাজনক, রাহেলা বেগম ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়াদুরুদ পড়ছে।

— মা গো আমি আর পারতাছি না, খুব ব্যথা করতেছে। আব্বায়া আহে না কেন, সেই কখন গেল ডাক্তার আনতে এখনো আহে না কেন।

— এই তো তর বাজানে এহনি ডাক্তার নিয়া আইব। আল্লাহ্ আল্লাহ্ কর বাপ সব ঠিক হয়ে যাইব। কিছুক্ষণ পর; ডাক্তার না পেয়ে এক প্রকার হতাশা নিয়ে ছেলের পাশে এসে বসলেন মিন্টু মিয়া। রাহেলা বেগম তখন জিজ্ঞেস করল;

— কি গো এতো দেরি হইলো কেন, আর ডাক্তার কৈ। মিন্টু মিয়া তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:
— ডাক্তার আইল না, অনেক হাতে পায়ে ধরছি, পা জড়াই ধইরা কইছি। স্যার আমার পোলাডারে বাচান। কিন্তু ডাক্তার আমারে তাড়াই দিল। কথাটা বলতেই মিন্টু মিয়ার চোখে পানি টলমল করছিল। মিন্টু মিয়া তখন অয়নের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল;

— বাজান ও বাজান ঘুমাই পড়ছোস। তুই চিন্তা করিস না তুই ঠিক হইয়া যাইবি। ডাক্তার আহে নাই তো কি হইছে। আমাগো আল্লাহ্ আছে, আল্লাহ্ তোর সব অসুখ ঠিক কইরা দিব। বাজান ও বাজান আমার দিকে একটু তাকা। খুব কষ্ট হইতাছে তোর তাই না। কিন্তু কি করমু বল তোর এই অসহায় বাবা যে ডাক্তার নিয়ে আসতে পারল না।
কিন্তু অয়নের কোন সারাশব্দ নেই, অয়নের কোন সারা শব্দ না পেয়ে মিন্টু মিয়া রাহেলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল;

— কি গো অয়ন এমন চুপ কইরা আছে কেন, কথা বলে না কেন?
— কি জানি একটু আগেও তো ও আমার লগে কথা কইল।
— অয়ন বাপ আমার বাজানের লগে কথা কইবি না।

ডাক্তার নিয়ে আসতে পারি নাই বইলা। বাজানের উপর খুব রাগ হইছে তাই না। অয়ন এই অয়ন চোখ খোল। কিন্তু অয়নের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মিন্টু মিয়া তখন অয়নের শরীরে হাত দিয়ে দেখে অয়নের শরীরটা শীতল হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় মিন্টু মিয়া খুব বিচলিত হয়ে পড়ল। তখন পাশ দিয়ে একজন নার্স যাচ্ছিল। মন্টু মিয়া দৌড়ে নার্সের কাছে গিয়ে বলল;

— আফা আমার পোলাডা কোন কথা বলতেছে না। এতো ডাকতেছি কিন্তু সারা শব্দও করতেছে না। শরীরটাও কেমন জানি ঠান্ডা হইয়া গেছে। একটু দেহেন না আমার পোলাডারে। কান্না করতে করতে বলল মিন্টু মিয়া। নার্স তখন অয়নের কাছে এসে ওর পাল্স চেক করে দেখে পাল্স চলছে না। নার্স তখন মিন্টু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল;

— আপনার ছেলে আর বেঁচে নেই। কথাটা শোনার পর মিন্টু মিয়ার যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মিন্টু মিয়া কপা গলায় বলল;

— কি কন আফা আপনি আমার লগে মস্করা করতেছেন তাই না, ও অয়নের মা দেখ এই নার্স আফায় আমাগো সাথে মজা করতেছে। আমাগো অয়ন না কি বাইচা নাই। আমি জানি এইডা মিছা কথা বলতেছেন আমারে তাই না আফা।
আমার অয়ন ঠিক আছে ওর কিছুই হয় নাই।

— যেটা সত্যি সেটাই বললাম কিছুক্ষণ আগেই আপনার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। কথাটা বলেই নার্স চলে গেলে। কথাটা মিন্টু মিয়া কিছুতেই মানতে পারছে না। মিন্টু মিয়া তখন অয়নের মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে আর বলতে থাকে;

— সবাই আমাগো লগে মজা করে, তুই না কি বাইচা নাই, বললেই হল; আমি তো জানি তুই মরস নাই। তুই তো ঘুমাই আছোস। আচ্ছা বাজান তুই না সেদিন বিরিয়ানি খাইতে চাইছিলি, আমি তোর জন্য বিরিয়ানি কিনে আনমুনে, তার পর বাপবেটা মিইল্লা বিরিয়ানি খামু, খুব মজা হইবো তাই না বাজান। কি রে অয়ন কথা বল। এই রাহেলা রাহেলা অয়নকে বল আমার লগে কথা কইতে। পাগলের মতো কথা গুলো বলতে থাকে মিন্টু মিয়া। আর রাহেলা বেগম যেন একটা পাথর হয়ে গিয়েছে, মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না তার। মিন্টু মিয়া তখন অয়নের নিথর দেহটা বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে আর বলতে থাকে।

— বাজান একটা বার চোখ খুইলা আমাগো দিয়ে তাকায় দেখ। তুই এমন চুপ কইরা থাকলে যে আমাগো ভালো লাগে না। একটা বার বাজান বইলা ডাক দে। একটা বার বল বাজান তুমি কান্না কইরো না এই দেখ আমি ভালা হইয়া গেছি। অয়ন অয়নরে আল্লাহ্ তোরে আমাগো কাছ থেইকা এভাবে কাইড়া নিতে পারে না।

কথাগুলো বলেই মিন্টু মিয়া চুপ হয়ে গেল। পলকহীন নজরে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে মিন্টু মিয়া। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মিন্টু মিয়া আবার বলতে থাকল; এই নামি দামি ডাক্তার গুলা খুব পাসান। এদের মাঝে মায়া মমতা নাইরে বাজান। এদের মাঝে মনুষ্যত্ব নাই। এদের অবহেলার কারণে আজ তোরে বিনা চিকিত্সায় জীবন দিতে হইল।এদের অবহেলার কারণে আজ আমাদের হতে হইল সন্তানহারা।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত