অক্ষম

অক্ষম

বিয়ের ছয় বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন শ্বাশুড়িমা নাতী-নাতনী মুখ দেখার কোনো সম্ভাবনা দেখলেন না তখন কথার ছলে বলেই বসলেন, “ও বউ, আমার বড় সাধ মরার আগে অন্তত নিজের ছেলের ঘরের নাতিপুতি দেখে মন শান্তি করার। তুমি কি সাধটা পূরণ করবে আদৌ! না পারলে বলো দাও, আমার ছেলেটার বয়স তো আর বসে থাকবেনা।” কথাটা শুনে হাতের কাজ থামিয়ে উনার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। পান মুখে দিয়ে শ্বাশুড়িমা আবার বলতে লাগলেন, “ভনিতা করবনা, সোজাভাবেই বলি আমি আর তোমার শ্বশুড় চাচ্ছি রাসেলের আবার বিয়ে দিতে। এতে তোমার আপত্তি থাকুক আর না থাকুক।”

নিশ্চুপে বুকের ভিতরটায় তুমুল তোলপাড় চলছে। টলমল করা চোখের পানি যখন আর আড়াল করা সম্ভব হচ্ছিলনা, উঠে এসে ঘরের দোর বন্ধ করে মুখ চেপে কাদতে লাগলাম। প্রিয় মানুষটার ভাগাভাগি কে ই বা মেনে নিবে? আর নিজের অক্ষমতার জন্য কতদিন দাতে দাত চেপে উঠতে বসতে কথা শুনবে? রাতে রাসেল ফিরতেই হাত দুটো বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বললাম, “তোমার আরেকটা ভাগীদার আমি মানতে পারবনা। তুমি মাকে একটু বুঝিয়ে বলোনা। আমরা একটা ছোট বাচ্চা না হয় দত্তক নিব, বাচ্চাটাকে নিয়ে সুখেশান্তিতে বাকীটা জীবনটা কাটিয়ে নিব।”

রাসেল হতবাক হয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। এই প্রথম তার কন্ঠে রুক্ষতার আভাস পেলাম। উচ্চস্বরে বলে উঠল, “দেখো শিশির, নিজের বাচ্চার বাবা হওয়ার সুখ দত্তক নেওয়া বাচ্চার মধ্যে পাওয়া যায়না। তুমি এত স্বার্থপর হচ্ছো কেন? একবারো ভাবছোনা, মা-বাবার বয়স হয়েছে। তাদের শেষ ইচ্ছে আমার একটা বাচ্চা দেখে কবরে যাওয়ার। তুমি তাদের ইচ্ছেটা যখন এতদিনেও পূরণ করতে পারোনি, তাদেরটা তাদেরকেই করতে দাও।” বলেই শার্ট টা গায়ে ছাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। প্রণয়ে থাকাকালীন যে রাসেল বলেছিল, আমি পুরোটাই তোমার। সারাজীবন সুখে-দুঃখে তোমার ছায়া হয়ে পাশে থাকব। অন্য কারো চিন্তা কখনোই মনে আনবনা।

জড়বস্তুর মত ঘরের মেঝেতে বসে রইলাম। শ্বাশুড়িমা এসে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, এত দুঃখ পাচ্ছো কেন? তোমাকে তো অক্ষম বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিনা। তুমি তোমার স্বামীর বাড়িতে তার বউ হয়েই থাকবে। তোমার কি ইচ্ছে হয়না পুরো বাড়িটা জমজমাট হোক? একজোড়া ছোট পা বাড়ির এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াক?” উত্তরে কিছু বলতে পারলামনা। চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। হ্যা, আমারো মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে। আমারো ইচ্ছে হয়, কারো মুখ থেকে আধো আধো স্বরে মা ডাক শোনার। রাসেলের পা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমার এই কথাটা রাখো। তারপর তুমি আর মা যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতে রাজি হব। অন্তত আমাকে একটু শান্তি দেওয়ার জন্য হলেও একবার ডাক্তারের কাছে চল। রাসেল একটু চুপ থেকে বলল, “আমাদের পরিবারে এসবের নিয়ম নেই। মা শুনলে রাগ করবেন। তুমি তো জানোই মা এসব ব্যাপারে ধাত্রী-কবিরাজ ছাড়া কাউকে ভরসা করেনা। আচ্ছা তাও আমি মাকে বলে দেখব।”

সব টেস্ট করা শেষে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে করিডোরে এসে বসলাম। খেয়াল করলাম করিডোরের শেষ মাথায় একজন নার্স একটা ছোট্ট বাচ্চা কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। বাচ্চাটার কান্না শুনে ভীষণ লোভ হল তাকে একবার কোলে নেওয়ার। ছুটে গিয়ে নার্সকে অনুরোধ করলাম, দয়া করে ওকে একবার আমার কোলে দিবেন?” নার্স অবাক হয়ে আমার কোলে তুলে দিল বাচ্চাটাকে।

আদর করে বাচ্চাটার কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ পর ই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে ঘুমিয়ে গেল। কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম, মাশা আল্লাহ, ভীষণ মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটা। বাচ্চাটার মা কোথায়?” নার্স দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পালিয়ে গেছেন।” হকচকিয়ে উঠলাম শুনে। নার্স বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “অবৈধ কিনা! লোকলজ্জা থেকে বাচার জন্য তার কাছে এর থেকে ভালো উপায় হয়ত ছিলনা।” টলমল চোখে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালাম। ছোট্ট নিষ্পাপ চেহারার মায়া কেউ কাটাতে পারে? কেউ চেয়েও পায়না, কেউ পেয়েও চায়না।

শ্বাশুড়ীমা রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “শুনো বউ, নাম-পরিচয়হীন কোনো বাচ্চাকে আমি এই বাড়ীতে থাকতে দিবনা। এতই যখন তোমার ওকে পালার ইচ্ছে নিজের বাপেরবাড়ীতে গিয়ে পালো। কে জানে কার পাপের ফসল?” আঁতকে উঠে বললাম, “মা, এভাবে বলবেননা। ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন কত নিষ্পাপ একটা চেহারা। সদ্য পৃথিবীতে এসেছে। আপনার কি মায়া লাগছেনা?”

শ্বাশুড়িমা মুখ বেকিয়ে বলল, “জারজদের জন্য মায়া আসেনা, ঘৃণা আসে। তোমাকে শেষবারের মত বলছি হয় তুমি বাচ্চাটাকে যেখান থেকে সেখানে রেখে আসবে নাহলে আমার ছেলেকে তালাক দিয়ে এই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবে। আর কখনোও এই বাড়ীমুখো হবেনা। আমি একদৃষ্টিতে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ” এই মূহুর্তে আমার কাছে বাচ্চাটা ছাড়া পুরো পৃথিবী তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আমি ওকে কিছুতেই ফেলে দিতে পারবনা।” রাসেল এতক্ষণ চুপ করে সবটা শুনছিল। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?” আমি উচ্চস্বরে বললাম, শেষ ও একমাত্র সিদ্ধান্ত।

শ্বাশুড়ীমার কথায় সেই মূহুর্তে রাসেল তালাক শব্দটা তিনবার উচ্চারণ করে ফেলল। কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু অবাক হইনি। আগে থেকে প্রস্তুত ছিলাম এমন মূহুর্তের জন্য। চোখের পানি মুছে যখন বাবুইটাকে শক্ত করে উঠে দাড়ালাম, ডাক্তারের ফোন এল। জানিয়ে দিল, অক্ষম আমি নই, অক্ষম আমার পুরুষ। শ্বাশুড়িমা আর রাসেলের হতাশামাখা কালো মুখ আমার দিকেই চেয়েছিল। আমি আর পিছু ফিরলামনা। অক্ষমতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন যে আমার আর ছোট বাবুইটার পরিচয় তৈরীর পালা।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত