কোথায় কি যেন একটা ভাঙছে । ভাঙনের শব্দে মন পাতা দায় ।
নিজের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে সেই ভাঙনের গান অনুভব করছে অবনী ।
হঠাৎ করে চেনা পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে অচেনা আলোয় এলে বুঝি এমন অনুভূতি হয় !!
অবনীর বিবাহিত জীবনের বয়স মাত্র আঠারো দিন ।
কিন্তু গত আঠারো বছরের জীবনটার সাথে এই আঠারো দিনের অদ্ভুত বৈপরিত্য খুঁজে পাচ্ছে সে ।
মা-বাবার অতি আদরে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা কখনো তার আশে পাশে ঘেষতে পারেনি । সেজন্যই বোধহয় পিচ্চি থেকে বড় হয়ে ওঠা হয়নি মেয়েটার ।
মধ্যবিত্তের গন্ডির ভেতরে থেকেই কোনো এক অদৃশ্য জাদু কাঠির ছোঁয়ায় তার সব চাওয়া পূরনের দায়িত্ব নিয়েছিল বাবা ।
মায়ের চোখে তাকিয়ে পুরো পৃথিবীর স্নেহ ভালোবাসায় ডুব সাঁতার কেটেছে প্রতিদিন ।
ছোট্ট ভাইটার মুখের আধো বুলিতে তার রোজনামচা শুনে শুনে শুনে পৃথিবীটাকে দেখত অবনী ।
কিন্তু ওই যে, একটা ভূল হয়ে গিয়েছিল হিসেবে । ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটা অবনীর জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ।
দ্বিতীয় অপরাধটা হয়েছে সম্ভবত অনিচ্ছাকৃত ভাবে বাড়তি সৌন্দর্য্য নিয়ে জন্ম নেয়ায় ।
ছোটবেলা থেকেই সবার মুখে ‘তুমি সুন্দর’ কথাটুকু শুনে অভ্যস্ত অবনী । বন্ধুদের আড্ডায় অনেকেই যে ঈর্ষা করে, তাও জানা আছে তার ।
মনে মনে কি ব্যাপারটা ভেবে সামান্য আনন্দিতও হতো না সে ??
বড় আপুটা পৃথিবীর সব মায়া তার দুচোখে নিয়ে এসেছিল ।
কিন্তু শ্যামল বর্ণের আপুটার রাত জাগা কান্না, পরিচিতদের উপহাস আর বাবা-মার অসহায়ত্ব দেখে দেখে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী ভেবে নিয়েছিল অবনী।
আপু দূর্দান্ত মেধাবী ছিল । গান কবিতা গল্পের আড্ডায় আপুর উপস্থিতির মুগ্ধতা সবাইকে ছুঁয়ে যেত।
তবু কেন এই মায়াবতী কোন রাজপুত্তুরের চোখের স্বপ্ন হতে পারেনি, সে প্রশ্নের জবাব অনেক খুঁজেও পায়নি অবনী।
আপু তার তার শেষ বাক্য গুলোতে অবনীকে বলেছিল “তোর জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে গেলাম আপুনী।
ভালোবাসা গুলো সাবধানে জমিয়ে রাখিস। এই পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভাবে কাছে টানার মানুষের বড় অভাব।
আমি মেয়ে মানুষের গন্ডি পেরিয়ে মানুষ হতে চেয়েছিলাম, পারিনি। আমার শেষ প্রার্থনা, তুই যেন পারিস।”
না, অবনী পারেনি। আপু চলে যাওয়ার পর গত দু’বছরে অনেক কিছু বদলেছে, শুধু বদলায়নি মানুষ।
বড় মেয়ের মত অবনীকে নিয়ে কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে চায়নি তার বাবা-মা।
তাই একটা ভালো ছেলের হাতে অবনীর ভবিষ্যতের ভার সঁপে দিয়েছেন। অবনীও মেনে নিয়েছে খুশী মনে।
বাবা মাকে দায়ী করার কোন কারন পায়নি সে। ভালো লাগার কোন মানুষ ছিলো না, যার কথা ভেবে অশ্রুজলে বালিশ ভেজানো যায়।
তাই সুখী মনেই নতুন পৃথিবীতে পা বাড়িয়ে ছিল।
কিন্তু গত আঠারোটা দিন অবনীর দুঃস্বপ্নের মত কেটেছে।
অচেনা একটা মানুষ, যে নাকি অবনীর অস্তিত্বের সীমানা, তার ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিয়েছে।
নিজের চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় এই মানুষটার কথাবার্তা, মানসিকতা, ইচ্ছা অনিচ্ছা কিছুই অবনী বুঝে উঠতে পারছে না।
আজ অবনী কলেজ যাবে ভেবেছিল। কিন্তু মানুষটা কি অবলীলায় বলে দিল, “মেয়ে মানুষের বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই।”
অবনী তর্ক করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে এমনভাবে ধমকে উঠলো, যেন অবনী তার স্ত্রী নয়, একটা পুতুল মাত্র।
যাকে নিয়ে যখন খুশী খেলা যায়, অথবা চাইলেই শোকেসের তাকে সাজিয়ে রেখে বাইরে থেকে আটকে দেওয়া সম্ভব।
অবনী তার বাবাকে না দেখে একটা দিনও থাকেনি কখনো।
অথচ গত আঠারো দিনে দেখা করাতো দূরের কথা, দূরালাপনে বাবার কন্ঠ শোনার অনুমতি সে পায়নি।
বাবা এসেছিল তাকে দেখতে। কিন্তু অবনীর না থাকার দোহাই দিয়ে বসার ঘর থেকেই তাকে বিদায় দেয়া হয়েছে।
দেয়ালের ওপাশ থেকে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি অবনী।
খুব ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বাবা বলে একটু ডাকে।
কিন্তু নিয়মের যে বেড়ি সবাই মিলে ওর পায়ে পড়িয়ে দিয়েছিল, বোকা মেয়েটা সেটা ডিঙোতে পারেনি।
অবনীর স্বামীর অনেক অর্থ। কোন কিছুর অভাব নেই। একটা সুন্দরী বউ এর বড় শুধু অভাব ছিল।
অবনীকে দিয়ে সে অভাব দূর করা গেছে। কিন্তু অবনীর পরিবার তাদের কাছে উটকো ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই না।
তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। অবনীর স্বপ্নগুলো তাই অধরাই রয়ে যায়।
একগাদা গয়না আর দামী কাপড় গায়ে চড়িয়ে এই বাচ্চা মেয়েটা যখন হাসি হাসি মুখ করে আত্বীয় স্বজনের সামনে বসে থাকে,
কান্নারা নিজেরাই বুঝি লজ্জ্বা পেয়ে গলা অবধি আটকে থাকে।
অবনী তার জেগে থাকা রাত গুলোতে জানালার পাশে বসে আকাশ দেখে।
তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে “পারিনি রে আপুনী, মানুষ হতে পারিনি।”
এই বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যে একটা মাত্র মানুষকে অবনীর সত্যিকারের আপনজন মনে হয়েছে। সেই মানুষটা হল অবনীর শাশুড়ি।
এই মানুষটা অবনীর মায়ের মতই মমতাময়ী। তার নীরব কান্নাগুলোর সাক্ষী তিনি।
আর বাকি সবার কাছে বাড়ির বউ হয়ে থাকলেও একমাত্র এই মানুষটা যখন অবনীর মাথায় হাত রাখেন, অবনী তখন মায়ের পিচ্চি মেয়েটি হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
তিনি এই কান্নার সাক্ষী হতে পারেন, কিন্তু একে রুখে দেয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। তিনিও যে ভিন্ন চেহারায় আরেকজন অবনী. . . .
গল্পটা আরো বহুদূর এগিয়ে গেছে। গল্পের অবনীরা সুখ-দুঃখের চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে জীবনের রূঢ় বাস্তবগুলোর কাছে মাথা নুইয়ে গেছে প্রতিনিয়ত।
….আমরা বরং নতুনের কিছু গল্প শুনি।
আজ অবনীর একমাত্র মেয়ে নীতুর বিয়ে। মেয়েটা সকাল থেকে বন্ধুদের মধ্যমনি হয়ে আছে। নানা ঠাট্টা মশকরায় লাল নীল বেগুনী হচ্ছে লজ্জ্বায়।
আর তাকে দেখে অবনীর বার বার শুধু তার বড় বোনটার কথা মনে পড়ছে। নীতু সেই একই মায়াকাড়া চোখ নিয়ে তার সামনে বসে আছে।
কিন্তু এই চোখে কোন না পাওয়ার বেদনা বা মন ভাঙার কষ্ট নেই। নীতু তার ভালোবাসার রাজপুত্তুরকে খুঁজে পেয়েছে।
ভীষন ভালোবাসায় সে নীতুর দিকে তার হাতটা বাড়িয়েছে। সেই ভালোবাসায় নীতুর প্রতি সম্মান আর নির্ভরতা দেখতে পেয়েছে অবনী।
বহুদিন পর আজ তাই অবনীর আকাশের সাথে কানাকানি করতে ইচ্ছে করছে।
মন খুঁলে বলতে ইচ্ছে করছে “আপুনী আমি পারিনি, তবে আমার মেয়েটা আজ মানুষ হয়েছে। মেয়ে হয়ে থেমে যায়নি, মানুষ হয়েছে।