অভিশাপ

অভিশাপ

দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে প্রায় পনেরো বছর পর প্রাক্তনের সাথে দেখা হওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর। আমি যে হোটেলে উঠছি, সে আর তার স্বামীও সেখানেই উঠেছে। দেখা হলো কাউন্টারে। তারা চাবির জন্য দাঁড়িয়ে আছে, আমি হোটেল থেকে বের হচ্ছি। আমায় দেখে প্রভা চমকে উঠল। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ওর বর অবশ্য খেয়াল করল না, তার আগেই আমি বেরিয়ে গেলাম।

আমি একা মানুষ, বিয়ে-থা করিনি। বয়স চল্লিশের কোঠায়। চেহারা এখন যা আছে, তাতে বিয়ে করাই যায়। কখনো ইচ্ছেও করে, তবে ভেতর থেকে পাকাপোক্ত সাহস হয়ে ওঠে না। সুখী ভাবে থাকলেও ভেতরে ভেতরে অসুখী মানুষটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে প্রায়ই। জীবনটা অর্থহীন মনে হয়। অস্থিরতা কাটাতে বেশিরভাগ সময় ঘুরতে বেরিয়ে যাই। বছরে একবার লম্বা সফরে বের হওয়া হয়।

প্রভাদের সাথে দু’দিনে অনেকবার দেখা হয়েছে। খেতে গিয়ে, ঘুরতে বের হয়ে। একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করলাম, তারা দুজন ভালো নেই। অথচ ভালো থাকা উচিত ছিল। প্রভার স্বামী দেখতে আমার চেয়ে ভালো। অনেক লম্বা, চওড়া কাঁধ, টকটকে গায়ের রঙ, মুখশ্রী বেশ! কথাবার্তায় ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। প্রভাও এখনো দারুণ সুন্দরী আছে। বিয়ের এত বছর হয়ে গেলেও ফিগার আগের মতোই চমৎকার। শরীরের কোথাও ভাঁজ পড়েনি। চর্বির চিহ্নও নেই। মুখে হালকা বয়সের ছাপ শুধু।

এরকম আকর্ষনীয় জুটির মধ্যে প্রকাশ্যেও কোনো ভাব ভালোবাসা নেই। দুজনের মাঝে একটা ঠান্ডা সম্পর্ক। ঘুরে বেড়ানোর সময়ও তাদের খুব একটা কথাবার্তা বা খুশি প্রকাশ করতে দেখিনি। কোথায় যেন সমস্যা চোখেই পড়ে। আমি প্রভার জন্য উদ্বিগ্ন না হলেও বেশ কৌতুহল বোধ করলাম। কথা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম।

আজ দার্জিলিং এ শেষদিন। বিকেলের দিকে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, গলায়, মাথায় মাফলার জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। চড়াই বেয়ে ওঠার সময় কষ্ট হলেও উপভোগ করছি। কুয়াশা ঝুলে আছে প্রকৃতিতে, চারপাশের ব্যস্ত মানুষজন, ঠান্ডা বাতাস আর বুনোফুলের ঘ্রাণে ভালোগালা আচ্ছন্ন করে রাখছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই পেয়ে গেলাম প্রভাকে। আজ সে একা। সূর্যের দিকে মুখ করে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে গলা খাঁকারি দিলাম। সে যেন প্রথমদিনের মতোই চমকে উঠল। আমি দেখলাম তার মুখে একরাশ বিষন্নতা। জিজ্ঞেস করলাম, ভালো আছ?

সে বলল, হ্যাঁ। তুমি? বললাম, শুধু বলার জন্য বললে? তুমি ভালো নেই সে তোমাকে দেখেই বোঝা যায়। ও কথা বলল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি সুখী নেই প্রভা? যে সুখের জন্য আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? এত অর্থ-বিত্ত, সুদর্শন স্বামী পেয়েও কী পাওনি তুমি? চোখদুটোতে চাপা কষ্ট কেন দেখা যায়? প্রভা মাথা আরও নিচু করে বলল, জানো শোভন, আমার কোনোদিন বাচ্চা হবে না। আমি কখনো মা হতে পারব না।

কথাটা শুনে মনে হলো আমার বিদ্যুতের ঝটকা লাগল। মাথার ভেতর সুক্ষ্ণ একটা ছুরি যেন এপাশ থেকে ওপাশ ভেদ করে দিল। প্রভা আমার দিকে একবার তাকিয়েই ছুটে চলে গেল সেখান থেকে। ওর গমনপথের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম একটা ঘাসফুল দেখে। বেগুনী আর লালের মিশেলে মাঝারি সাইজের ঘাসফুল। ঠিক এই ফুলটাই সেদিন ব্রিজের কিনারায় দেখেছিলাম…

প্রভার গর্ভের সন্তানকে এবরশন করালাম যেদিন..সবসময় আমরা সতর্ক থাকলেও সেবার কেমন করে যেন প্রভা প্রেগনেন্ট হয়ে গেছিলো। বুঝতেও পারেনি প্রথমে। যখন বুঝল, তখন চার মাস চলছে। নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। বাচ্চাটাকে খুন করার জন্য। প্রভাও অস্থির হয়ে উঠেছিল। ছোট্ট অপরিণত একটা দেহকে নার্স পলিথিনে মুড়ে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। প্রভা ফিসফিস করে বলেছিল, ফেলে দিয়ে এসো এটাকে। যেন কোনো চিহ্ন না থাকে।

আমিও ফেলে দিয়েছিলাম উঁচু ব্রিজ থেকে নিচে। সেদিনও এই ঘাসফুলটার দেখা পেয়েছিলাম। সেদিন ওর গা ভেজা ছিল শিশিরে। কাঁদছিলো যেন। কেঁদে কেঁদে অভিশাপ দিচ্ছিলো। আজ ফুলটা কাঁদছে না। খিলখিল করে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি!

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত