আবেগ

আবেগ

একমাত্র ছোট বোনের বিয়ের পরের দিন কাঁদছিলাম। সবার সামনে কান্না করা যায় না। কেউ যদি দেখে এত বড় ছেলে কান্না করছে তাহলে লজ্জাকর ব্যাপার। কান্নার জন্য একটি মাঠের কোণকে বেছে নিয়েছি যেন কেউ না দেখে।
বিয়ের দিনতো অনুষ্ঠান ছিল তাই কাঁদতে পারিনি। একমাত্র বোনটি পরের বাড়ি চলে গেল। দুই চোখ বেয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে।

হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পিছনে সাত আট বছরের একটি ছেলে কান্না করছে। মেজাজটা একটু চড়ে গেল।
জিজ্ঞেস করলাম, এই ছেলে কাঁদছিস কেন? প্রতিউত্তরে বলল, “আম্নের ভাই আমারে মারছে। মা কইছে আম্নের কাছে বিচার দিতাম।” ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম আচ্ছা আমি ওকে আচ্ছা করে মেরে দেব।
ছেলেটি যাওয়ার পর আমি অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ার অবস্থা।

আমার ছোট বা বড় কোন ভাই নেই। তাহলে ওকে মারল কে আর আমি বিচার করব কার? আমি দেশের বাইরে থেকে কাঁদতে দেখেছি বহু বাঙ্গালি ভাইকে। আগে ভাবতাম, মানুষ শুধু ছোটবেলা কাঁদে। বড় হয়ে শত কষ্টেও মানুষ নিজেকে শক্ত রাখে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল আবেগ। অনেকে বলে আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমি বলি আবেগ ছাড়াও জীবন চলে না। একটি ছেলেকে অনেক কাঁদতে দেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটি তাবুকের (বড় ইট) উপর শুয়ে জোরে জোরে কাঁদছিল। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই তুমি বাঙ্গালি? কান্না করছো কেন? অামার কথা শুনে অামাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ছেলেটি।

কান্না করার সময় কাউকে জড়িয়ে ধরলে আরো জোরে জোরে কাঁদা যায়। লোকটিও কাঁদছে তেমন করে। পিঠে হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম কী হইছে ভাই? কেঁদে কেঁদেই বলল, “আমার মা মারা গেছে।” দুই মিনিট স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই মূহূর্তে ওকে শান্তনা দেয়ার মত কোনো ভাষা পৃথিবীতে জন্ম হয়নি। দেশের বাইরে থেকে কেউ যদি হঠাৎ শুনে তার গর্ভধারিনী মা চিরদিনের জন্য মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আর সে দেশে যেতে পারছে না তার ভিসার সমস্যার জন্য। সে তার মায়ের মুখটিও শেষবারের মত দেখতে পারবে না। কবরে তিন মুঠো মাটিও দিতে পারবে না। ওর কান্না থামাব কী করে? এখন কি সে আবেগ ভুলে থাকতে পারবে?

আমি বহু প্রবাসীকে দেখেছি ইদের দিন কাজে থেকেও ফোনে বাবা মা’কে বলেছে আমি ঘুরতে বের হইছি। সকালে রুটি খেয়েও বলেছে, সেমাই খেয়েছি। গোস্ত দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুরতে বের হয়েছি। অনেকে ভিডিও কলে কথা বলার সময় লেপটপে হাত বাড়িয়ে নিজের ছোট সন্তানকে কোলে নেয়ার ব্যার্থ চেষ্টা চালায়।

নতুন বধূ কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে লাল শাড়ী পরে শ্বশুরবাড়ি যায়। কিছুদিন যাওয়ার পর যখন দেখে শ্বাশুড়ী কখনো মা হয় না। দেবর ননদ কখনো নিজের ভাই বোন হয় না। তখন বাস্তবতায় প্রথম পা রাখতে গিয়েও রাতের অন্ধকারে বধূটি নীরবে চোখের জল ফেলে বালিশ ভিজায়। মায়ের অনেক আদরের ছেলে বড় হয়। সেই ছেলেটি যখন নিজের বউকে ভালবেসে মায়ের সাথে ঝগড়া করে আলাদা সংসার পাতে। সেই মা জানে চোখের জল কত সস্তা আর কত সহজে ঝরে পড়ে। তবে অনেকে জানে সন্তানের কারণে মায়ের এক ফোটা চোখের পানি বের হলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে। কিন্তু পাপিষ্ট ছেলেটি শুধু মায়ের চোখের পানির মূল্য বুঝে না। আমি কয়েকজনকে নিজ গর্ভধারী মা’কে মারতে দেখেছি। আজ দূর প্রবাস থেকে সেই ছেলেগুলোর ধ্বংসের কাহিনীও শুনি।

অনেক মেয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে অন্যের বধূ সাজে। কেউ বাবা মায়ের ভয়ে কেউ বাবা মায়ের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে বিয়েতে রাজী হয়। যদিও বাইরে থেকে লাল শাড়ি পরা নববধূ দেখা যায়। তবে মেয়েটি জানে সে একটি জীবন্ত লাশ। তার চোখ দুটি না কাঁদলেও কাঁদে তার হৃদয়। লোকজন যদিও ভাবে বাবা মা’কে ছেড়ে যাচ্ছে তাই কাঁদে। কিন্তু মেয়েটির চোখের জল জানে তার ভালোবাসার কবর রচনা হতে যাচ্ছে। তেমনি করে সেই ছেলেটি জানে তার ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারো হবে। হয়তো কোনো বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে, নয়তো গভীর রাতে একা একা। কাঁদবে, খুব করে কাঁদবে ছেলেটি।

প্রতিটা হাসির পিছনে যেমন কারণ থাকে তেমনি প্রতি ফোটা চোখের জলেও থাকে অনেক লুকায়িত কষ্ট। হাসির কারণটি বলা গেলেও চোখের জল ঝরে পড়ার কারণটি অজা না থাকে অনেকের। কখনো কখনো কান্নায়রত মানুষটি বলে আমি কাঁদিনি তো, চোখে কী যেন একটা পড়েছে। না খেয়েও বলে একদম ক্ষিধে পায়নি আমার।
যতই বলুন আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমি বলি আবেগ ছাড়া কান্না আসে না। আর কান্নাও জীবনের একটা অংশ। যদি বলেন আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, তাহলে আপনি একবারও না কেঁদে জীবনটাকে পাড়ি দিয়ে দেখান। আপনি পাথরের মূর্তি নাকি রক্তে মাংসে গড়া এক মানুষ।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত