অপয়া

অপয়া

আমি তখন ৬ মাসের অন্তসত্ত্বা। ডাক্তার বললো, বাকি ৩ টা মাস যদি পুরোপুরি বেড রেস্ট এ না থাকি তাহলে যে কোনো সময় বাবুটা নষ্ট হয়ে যাবে। ভারাক্রান্ত মনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে হসপিটাল থেকে শশুড় বাড়ি চলে আসি। শত শত প্রশ্নবোধক চিহ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এ বাড়িতে আমি ঘুমানোর সময় ছাড়া সারাদিন দুই দন্ড দাঁড়াবার সময় পাই না! সেখানে বাকি ৩ মাস কি করে শুয়ে কাটাবো?! বিয়ের সময় আমার বাবা বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী যৌতুক দিতে পারে নি। উনার সামর্থ্য অতিক্রম করে গিয়েছিলো। দয়া করে আমার শশুড় বাড়ির মানুষ আমাকে দুবেলা দু মুঠো খেতে দেয়। বিনিময়ে সারাদিন আমার করে যেতে হয় অসহনীয় পরিশ্রম।

স্বামী আমার খুব মায়ের ভক্ত! যদিও মার প্রতি তার অনুরাগ ও শ্রদ্ধাকে আমি বরাবরই সম্মান করি। তবে আমিও তো তার অর্ধাঙ্গী? আমার পেটে তো তারই অনাগত সন্তান! সেই অনাগত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও আমার এই তিনটা মাস একটুখানি আয়েশ চাই। ইতস্তত করে বলেই ফেললাম শুভ্রকে। আমাদের বিবাহিত জীবনের তিন বছরে এই প্রথম সে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিলো।পরদিন সকালে খাবার টেবিলে বসে সে সবার সামনে শাশুড়িকে আমার সমস্যার কথা খুলে বললো।

: মা, নীরার শরীরটা ভালো না। তিনটা মাস ওকে একটু শুয়ে বসেই কাটাতে হবে। তাই ভাবছি ওকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসি। আমার শাশুড়ি নরম হয়ে মমতার জালে জড়িয়ে বলতে লাগলেন,

: সে কি! বৌমা তো আমাদের কিছু বলে নি! আগে জানলে তো কোনো কাজই করতে দিতাম না। এবার খানিকটা অভিমানের সুরে আরোও বললেন,

: তাছাড়া তুই এমন ভাবে বলছিস শুভ্র, যেনো তোর বউকে আমরা সারাদিন খাটাই!
: না মা আমি তো তা বলি নি! আমি বলতে চাইছি যে…
: থাক! সব বুঝি আমি। ওর কোথাও যেতে হবে না। বাসাতেই থাকবে।
: ঠিকাছে মা।

তারপর কয়েকদিন আমাকে দিয়ে বাড়ির কোনো কাজ করানো হয় নি। যখন আমার স্বামী বাসায় থাকতো, শাশুড়ি ফল কেটে ঘরে দিয়ে যেতেন। দুধ দিয়ে যেতেন। যত্নের কোনো ত্রুটি রাখতেন না। বিষয়গুলো আমার মনে সন্দেহের দেয়াল সৃষ্টি করে দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, কোনো বড় ঝড়ে সবকিছু লন্ডভন্ড হওয়ার আগে প্রকৃতিতে যে থমথমে রহস্যপূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে, ঠিক তেমনি নিশ্চুপ ও নির্জীবতা ঘিরে আছে আমায়।

তার কয়েকদিন পর আমার স্বামীর বিশেষ এক কাজে শহরে যেতে হলো। সেখানে তিনি কয়েকদিন থাকবেন। আমার শাশুড়ি এই কয়দিন আমার ঘরে একটু উঁকি দিয়েও দেখলেন না। যেদিন আমার স্বামী ফিরবেন সেদিন বিকেলে উনি আমার সন্দেহের দেয়ালে নির্মম এক সত্যের পোস্টার লাগিয়ে দিলেন। পর্যাপ্ত তরকারি না থাকার কারনে ভাতে পানি ও লবণ মিশিয়ে মরিচ ডলে খেয়ে উঠি। শরীর বেশি দুর্বল থাকায় মাথায় দুলুনি দিয়ে ওঠে। তাই বাসি বাসন না মেজেই ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানি না। হঠাৎ চুলে প্রচন্ড চাপ অনুভব করি। আমার চুল ধরে হেচকা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেন শাশুড়ি। যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠি। তিনি অনর্গল বলে চলেছেন,

: জমিদারের কন্যা হয়েছিস হ্যাঁ? খাবার খেয়ে বাসি বাসন কার জন্য রেখে দিয়েছিস তুই?
: মা আমার খুব খারাপ লাগছিলো তাই আমি…
: চুপ! তোর মতলব কি আমি বুঝি না? আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে আলাদা করার জন্য এই অসুস্থতার নাটক করছিস তুই! সারাদিন তোকে দিয়ে কাজ করাই এসব বলেছিস না তুই ওকে? উনি আমার পেটে অনবরত লাথি মারতে লাগলেন সাথে গালি দিতে লাগলেন।

: তোর বাপের তো মুরোদও ছিলো না টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দাওয়ার! দয়া করে তোকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিতাম, এখন তো দেখছি দুধ কলা দিয়ে কেউটে পুষেছি! আমি তার পা ধরে বললাম,

: মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা আমার বাচ্চাটার কথা ভাবুন। ছেড়ে দিন উনি আরো ক্ষীপ্ত হয়ে আমার পেট বরাবর লাথি মারলেন। আমি বুঝতে পারলাম আমার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। চোখদুটি ঘোলাটে হয়ে এলো। তারপর আর কিছু জানি না। যখন জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। পাশে আমার স্বামী। দেখলাম আমার শাশুড়ি চোখের জল ফেলছেন আর চিৎকার করে বলছেন,

: কত করে বললাম! কোনো কাজ করতে হবে না। শুনলই না আমার কথা। রান্নাঘরে পা পিছলে পড়ে কি সর্বনাশ টাই না করলো আমার ছেলের! মরামুখো মেয়ে অপয়া! স্বামীর দিকে তাকালাম সেও চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি সুস্থ হয়ে যাওয়ার কয়দিন পর শুভ্র বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে খোলাখোলি কথা বলে আমার সাথে। এই সমাজে আমি কলঙ্কিত। সর্বনাশী মহিলা। আমার সাথে আর সংসার করা তার সম্ভব নয়।

শুভ্রর সাথে বিচ্ছেদের পর আর বাপের বাড়ি যাইনি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে কাজ জোগাড় করেছি। এরই মাঝে এক আপার সাথে পরিচয় হয়। উনি যৌতুক বিরোধী এক সংস্থায় কাজ করেন। তার সাহায্যে তাদের সংস্থায় যোগ দেই। এখানে এসে আমার মতো অনেক নীরাকে পেয়েছি। আমার চেয়েও করুন কাহিনী অনেকের মুখে শুনেছি। শত কষ্টের মাঝেও সবার একটাই চাওয়া, একই প্রশ্ন_ কবে পাল্টাবে আমাদের এই সমাজ?

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত