রাত আটটার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি আর ভাই ছোট্ট প্রিয়ন্তির লাশ নিয়ে ফিরছি।প্রিয়ন্তি সদ্য জন্ম নেওয়া একটা বাচ্চা।সাত মাস চ্যাকআপে ডাক্তার যখন ভাবিকে জানালো তাদের মেয়ে হবে,ভাবি খুশি হয়ে মেয়ের নাম রেখেছিলেন প্রিয়ন্তি।যেখানে যায় ভাবি সারাক্ষণ প্রিয়ন্তির কথাই বলতো। চ্যাকআপ করতে এসে ডাক্তারের চেম্বারে একটা গোলোমুলো কিউট বাচ্চাকে দেখে ভাবি আমাকে বলেছিল,সর্ণা আমার প্রিয়ন্তি যেন দেখতে ওর মতো কিউট হয়।প্রিয়ন্তি দেখতে যাতে সুন্দর হয় সেজন্য ভাবির রুমে অনেকগুলো বিদেশি বাচ্চাদের ছবি দেয়ালে ফ্রেম বাঁধিয়ে প্যারেক মেরে রেখেছিল।
কারণ ভাবির কোন আত্মীয় নাকি ভাবিকে বলেছিল,সকালে ঘুম থেকে ওঠে প্রথমে যার চেহেরা দেখবে বাচ্চা দেখতে তার মতো হবে।ভাবির এরকম কুসংস্কারের উপর বিশ্বাস আনতে দেখে আমি খুব হেঁসেছি।প্রিয়ন্তি ছবির বাচ্চাদের মতো হয়নি, ভাবির মতোই হয়েছে।সেদিন ভাইয়া খুশি হয়ে পাড়াপড়শি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াই ছিলো।বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় নাতনির জন্য খেলনার পুতুল,টেডিবিয়ার,গাড়িসহ নানান ধরনের খেলনার জিনিস নিয়ে তারপর বাড়ি ফিরতো।এভাবে ভাইয়া আর বাবার কেনা প্রিয়ন্তির খেলনার জিনিসগুলো একটা রুম দখল করে ফেলে ।
যার আগমন উপলক্ষে দশমাস যাবত নানান জিনিসে আমাদের বাড়িটা সেজে ওঠেছিল আজ তাকে বাধ দিয়ে ভাইয়া ভাবিকে বাঁচাল। ডাক্তার বলেছিলো হয় মা বাঁচবে নাহয় বেবি।ভাইয়া কিছু না ভেবেই বলে ফেললেন, আমার বাচ্চার মাকে চাই।সিজার দিয়ে দিলো ডাক্তাররা।ভাবির হুঁশ ফেরেনি এখনো। হুশঁ ফিরলে যদি জানতে পারে তার প্রিয়ন্তি মৃত জন্ম নিয়েছে তবে উনি কি করে একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় জানে।শোকের সংবাদ নিয়ে এম্বুল্যান্স নিয়ে বাড়ি ফিরছি।হাসপাতাল থেকে বেশিদূর এগোইনি।রাস্তার মাঝখানে গাড়ি ব্রেক করলো।ভাইয়া গাড়ি থেকে নামলেন সাথে আমাকেও নামতে বললেন। মৃত প্রিয়ন্তিকে এতোক্ষণ আমার কোলে রেখেছিলাম কোনমতে ওকে সিটে রাখতে ইচ্ছে করছিলোনা।
প্রিয়ন্তি কার কাছে থাকবে এনিয়ে আমি আর ভাবির মাঝে তর্ক চলতো।প্রিয়ন্তি আজ পৃথিবীতে আসবে শুনে দুই রাকাত নামাজ পড়ে শপিংমলে গিয়েছিলাম।ওর জন্য কেনাকাটা করবো বলে।তর্কে ভাবির সাথে জিততে না পেরে বলেছিলাম প্রিয়ন্তির কাপড় চোপড়ের দায়িত্বটা যেন আমাকে দেয়।কথামত ওর জন্য ফ্রক,বেন্ট কিনেছিলাম। সবটাই এখন প্রিয়ন্তির সাথে চড়ে এম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রিয়ন্তিকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম রাস্তার পাশে ফুটপাতে একটা মহিলা প্রসব ব্যাথায় কাতরাচ্ছে।পাশে তার বুড়ো মা সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে।আরেকজন পুরুষ লোক একটু দূরে দাড়িয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব অসহায় তারা।আমাকে উনাদের কাছে যেতে বলে ভাইয়া দূরে দাড়িয়ে রইলেন।বৃদ্ধ মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথাও নিচ্ছেন না কেন? মহিলা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,টেহা নাই।আল্লাহ ভরসা। ভাইয়াকে বললাম টাকা নাই।
ভাইয়া বললেন নিয়ে আয় প্রিয়ন্তিকেতো তুই কোলেই নিয়েছিস।আমরা আবার হাসপাতালে যাবো। ভাইয়ার কথায় মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে আবার উল্টো হাসপাতালে যেতে হলো।বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের।মহিলার একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হলো।ভাইয়া হাসপাতালের বিলটা পেইড করে দিয়ে আবার চলে আসছিল। চোখের জল লোকাতে চাওয়া লোকটা ভাইয়ার পায়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,স্যার আপনি আমার কাছে যা চাইবেন তাই দিয়ে দিবো। আমার মেয়ে চাইলে তারে দিয়ে দিব স্যার।আমার স্ত্রী বেঁচে আছে এতে আমি অনেক খুশি।
সে থাকলে আমি আবার বাবা হতে পারব।ভাইয়া শোক কেটে হাসলেন।লোকটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,আমিও আপনার মতো আমার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসি।আমি তার খুশি এবং ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে,আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়েছি।আপনার স্ত্রীও নিশ্চয় আপনাদের সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে, আমি তার খুশিকে বাচিয়েছি ভাই। লোকটা বললেন স্যার মেয়েটার নামটা হলেও রেখেদিন। ভাইয়া চোখের জল মুছতে মুছতে বলললেন,তার নাম প্রিয়ন্তি।
প্রিয়ন্তির বাবার হাতে মৃত প্রিয়ন্তির জন্য কেনা ফ্রক,হেয়ার বেন্ট আর ছোট্ট একটা আংটি দিয়ে ভাইয়া আর আমি আবার শূণ্যহাতে শুধু মৃত প্রিয়ন্তির লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।মৃত্যু শোকের মধ্যেও আমরা আরেক শোককে সুখের শোকে রূপান্তর করেছি ভাবতে চোখের কোণের জল গড়িয়ে মৃত প্রিয়ন্তির গালে টপ করে পড়লো।প্রিয়ন্তি মায়ের জন্য জীবন বিসর্জন দিলো,আরেকটা প্রিয়ন্তিকে বাচিয়ে সে তাকে তার নাম এবং কাপড়গুলোও দিয়ে গেলো।